খাগড়াছড়ি রিজিয়ন কমান্ডার পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে গবেষণায় তথ্য-উপাত্তের মাইলফলক
রহিম হৃদয়/খাগড়াছড়িঃ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি ও সশস্ত্র আন্দোলন (১৯৭২-১৯৭৫) এর উপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন ২০৩ পদাতিক ব্রিগেড ও খাগড়াছড়ি রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গোলাম মহিউদ্দিন আহমেদ মাহি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. এ টি এম আতিকুর রহমানের তত্ত্বাবধানে তার এ গবেষণাটি সম্পন্ন করেন। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মহিউদ্দিন’র এ গবেষণা হতে পারে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে তথ্যপিপাসুদের তথ্য-উপাত্তের নতুন এক মাইলফলক।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গোলাম মহিউদ্দিন আহমেদ মাহি জানান, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস, বিশেষত বাংলাদেশের অভ্যুদয় পরবর্তী অধ্যায়ে বিবৃত ঘটনাবলীর অনেক ক্ষেত্রেই দু’টি পরস্পরবিরোধী ধারা লক্ষণীয়। একদিকে পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালিদের প্রতি সহানুভূতিশীল। ধারা দুটোর বৈপরিত্যের প্রবলতায় অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে প্রকৃত সত্য যথাযথভাবে উঠে আসেনি বলে সমালোচনা রয়েছে।
এমনকি, এমন অভিযোগও রয়েছে যে, কিছু কিছু ঘটনা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে কিংবা ঘটনার উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভুল উপস্থাপন ছাড়াও পুরো সত্যের পরিবর্তে আংশিক সত্য উপস্থাপন করা হয়েছে। এমতাবস্থায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বাধীনতা-পরবর্তী ঘটনাবলির সঠিক ইতিহাস তুলে ধরাই এই গবেষণার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র আন্দোলনের প্রস্তুতিতে ভূমিকা ছিল। ১৯৭২-৭৫ সময়কালে সংঘটিত এমন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করার প্রয়াস নেয়া হয়েছে এ গবেষণায়।’
তিনি বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত সশস্ত্র আন্দোলনের যে যৌক্তিকতা দীর্ঘকাল ধরে প্রচারিত এবং সাধারণভাবে প্রচলিত, তার মধ্যে সশস্ত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপটের সম্পূর্ণ চিত্র ও প্রকৃত সত্য যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়নি। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের আমলে রাঙ্গামাটিতে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ ও পাকিস্তান সরকারের গৃহীত বিভিন্ন প্রশাসনিক ও সাংবিধানিক পদক্ষেপের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে সৃষ্ট বাঙালি মুসলিম বৈরিতা এবং রাজনৈতিক সচেতনতার উন্মেষকে উপজীব্য করে স্থানীয় জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের লক্ষ্যে সশস্ত্র আন্দোলনের প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছিলেন পাহাড়ে বসবাসরত বাম মতাদর্শে দীক্ষিত পাহাড়ি জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দরা।
সমকালীন আঞ্চলিক ভু-রাজনৈতিক পরিস্থিতি, উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন জনগোষ্ঠির সশস্ত্র আন্দোলন, যুদ্ধ-বিধ্বস্ত নব্য স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নাজুকতা একদিকে যেমন ষাটের দশক হতে বাম মতাদর্শে দীক্ষিত পাহাড়ি জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তেমনি অন্যদিকে, চোখের সামনে জাজ্বল্যমান মুক্তিকামী বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের সাফল্য তাদেরকে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। সর্বোপরি স্থানীয় জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দের স্বাতন্ত্র্যবোধ, রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও অদূরদর্শিতা সশস্ত্র আন্দোলনের এই প্রচেষ্টাকে জোরালো ও ত্বরান্বিত করতে ভূমিকা পালন করেছে। জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের এই আকাঙ্ক্ষার বাস্তব প্রতিফলন স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয় দ্রুততার সাথে সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তোলার মধ্যে।
ইতিহাস টেনে ব্রিগেডিয়ার মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত কিছু সহিংসতাকে সাধারণ মানুষের মনে সরকার বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি এবং সশস্ত্র আন্দোলনে যোগদানে অনুপ্রাণিত করার কাজে ব্যবহার করা হয়। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দেই শুরু হয় সশস্ত্র আন্দোলনের প্রস্তুতি। ১৯৭৩ সালের জানুয়ারিতে ‘শান্তি বাহিনী’ নামে এক সশস্ত্র সংগঠন আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। এরপর নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পাশাপাশি সশস্ত্র আন্দোলনের প্রস্তুতি দ্রুত গতিতে এগুতে থাকে।
তবে, একদিকে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের তুলনায় সশস্ত্র আন্দোলনের অগ্রগণ্যতা যেমন ছিল; তেমনি অন্যদিকে অব্যাহত ছিল কাঠামোগত প্রশিক্ষণ, প্রতিদ্বন্দ্বী সশস্ত্র দলগুলোকে নির্মূল বা নিরস্ত্র করার পাশাপাশি বহির্দেশের সমর্থন লাভের প্রচেষ্টা। ফলে, ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি বাহিনী একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়। কিন্তু তখন পর্যন্ত দেশের বাইরের সমর্থন অর্জিত হয়নি বিধায় প্রকাশ্যে সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭৫-এ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে, আনুষ্ঠানিকভাবে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরুর আর কোনো বাধা অবশিষ্ট থাকে না শান্তিবাহিনীর।’
পিএইচডি ডিগ্রি লাভকারী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গোলাম মহিউদ্দিন আহমেদ ১৯৭৫ সালের ২৮ জানুয়ারি ঢাকা জেলার সাভারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৮৯ সালের সাভার অধর চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় হতে এসএসসি পাস করেন। এরপর তিনি ১৯৯১ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল ও কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এইচএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল অর্জন করায় সে সময় তিনি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত `উপাচার্য স্বর্ণপদক’ লাভ করেন।
ব্রিগেডিয়ার মহিউদ্দিন ১৯৯৪ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতক পরীক্ষায় বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি হতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করে `ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ স্বর্ণপদক’ লাভ করেন।
তিনি বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনাল মিরপুর হতে মাস্টার অফ সাইন্স ইন মিলিটারি স্টাডিজ এবং মাস্টার অফ স্ট্রাটেজি অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি “এরপর তিনি ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তিনি ২০৩ পদাতিক ব্রিগেড খাগড়াছড়ি রিজিয়নের রিজিয়ন কমান্ডার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।