ঢাকা ০৩:৪০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৩ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম:

তিনমাস বর্ষাবাসের পর মারমাদের প্রাণের উৎসব “ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে”

Astha DESK
  • আপডেট সময় : ০৩:০৫:৩৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৩
  • / ১০১৮ বার পড়া হয়েছে

তিনমাস বর্ষাবাসের পর মারমাদের প্রাণের উৎসব “ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে”

মোফাজ্জল হোসেন ইলিয়াছঃ

মারমা সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে (শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা)। প্রতিবছরের ন্যায় এই উৎসবকে কেন্দ্র করে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে ৩দিন ব্যাপী ধর্মীয় উৎসব পালন করবে বৌদ্ধ ধর্মালম্বী মারমা সম্প্রদায়। বছর পেরিয়ে আবারও প্রাণের এ উৎসবকে ঘিরে পাহাড়ী পল্লীগুলো যেন নতুন করে সেজেছে।

বৌদ্ধ ধর্মালম্বীরা জানায়, আদিকাল থেকে বৌদ্ধ অনুসারীরা তিন মাসব্যাপী বর্ষাবাস শেষ করে এবং শীল পালনকারীরা ধর্মীয় ভাবগম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে (প্রবারণা পূর্ণিমা) উৎসব পালন করে আসছে। কথিত আছে, বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা গৌতম বুদ্ধ এই আশ্বিনী পূর্ণিমায় তাঁর মাথার চুল আকাশে উড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং ঐ চুল স্বর্গে অবস্থিত মারমা ভাষায় “ছ্যাঙ দ আহ্রাং” অর্থাৎ চুলামনি জাদিতে স্থান পায়। তাই আশ্বিনী পূর্ণিমার এই তিথিতে বৌদ্ধ ধর্মালম্বীরা আকাশে শত শত ফানুস বাতি ওড়ানোর মধ্য দিয়ে উক্ত “ছ্যাঙ দ আহ্রাং” জাদিকে ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা গৌতম বুদ্ধকে স্মরণ বা পূজা করে থাকে। এই পূর্ণিমা দিনে নিজস্ব সামর্থ্য অনুযায়ী বিভিন্ন রংবেরঙে ফানুস বাতি বানিয়ে আকাশে উড়িয়ে থাকে বৌদ্ধ অনুসারীরা।

উৎসব উদযাপন পরিষদ সূত্রে জানা যায়, বান্দরবানে ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে উৎসবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে- মঙ্গল শোভা রথযাত্রা। এবারে বিশাল আকৃতির ড্রাগন তৈরি করে তার ওপর একটি বুদ্ধ মূর্তি স্থাপন করে রথটি টেনে পুরো শহর ঘুরিয়ে সাঙ্গু নদীতে বিসর্জন দেওয়া হবে। এ সময় বৌদ্ধধর্মের নর-নারীরা ভগবানের উদ্দেশে নগদ টাকা ও মোমবাতি জ্বালিয়ে পূজা করে বুদ্ধ মূর্তিকে। ওই সময় রথের পেছনে যুবক-যুবতীরা ঐহিত্যবাহী গান গেয়ে ঢোল বাজিয়ে সবাইকে উৎসাহ জোগায়।

অনুষ্ঠানের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিতে তৈরি করা হয় ভয়ঙ্কর আকৃতির পুতুল। আর নির্মিত পুতুলের ভেতরে মানুষ প্রবেশ করে নেচে-গেয়ে আনন্দ দেয়। রাতের মারমাদের ঐতিহ্য অনুষ্ঠান দেখার জন্য স্থানীয় পাশাপাশি পর্যটকরাও বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসে। ওই সময় রাস্তার দু’পাশে জমে উপচেপড়া ভিড়।

বান্দরবানে রথ কারিগর ক্যওয়ান মারমা বলেন, কয়েকজন বন্ধু মিলে ড্রাগন আদলে রথ আর পাঁচটি পুতুল তৈরি করেছি। প্রায় কাজগুলি সব শেষের দিকে। বৈরি আবহাওয়া কারণে রঙে কাজ করতে কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া মংক্যথোয়াই মারমা বলেন, অতি আগ্রহে দিন গুনতাম কবে আসবে আবারও মারমাদের ওয়াগ্যোয়াই উৎসব। এই বছর ভার্সিটির কয়েকজন সহপাঠি বাঙালি বন্ধুদের নিয়ে পাহাড়ে ঘুরতে যাচ্ছি। সবাই এক কাতারে মিলিত হয়ে ওয়াগ্যোয়াই উৎসবে মারমা ঐতিহ্যের পোশাক পরে ধর্মীয় অনুষ্ঠানমালার পাশাপাশি সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করবো।

এদিকে এবারেও ওয়াগ্যোয়াই পোয়েহ্-কে ঘিরে ২৯ অক্টোবর রাতে বান্দরবান শহরের বিভিন্ন পাড়ার অলি-গলিতে পিঠা তৈরির উৎসব আয়োজন করা হবে। রাতে পাহাড়ী তরুণ-তরুণীরা সারিবদ্ধভাবে বসে হরেক রকমের পিঠা তৈরি করে থাকে। পরদিন ভোরে নর-নারীরা সমবেত হয়ে ভগবান বুদ্ধের উদ্দেশ্যে বিহারে ছোয়েং (পিঠা আহার) দান করে। কিছু পিঠা, পায়েশ আবার প্রতিবেশীদের বাড়িতে বাড়িতেও বিতরণ করা হয়।

উৎসব উদযাপন পরিষদের সভাপতি হ্লাএমং থেওয়াং মারমা বলেন, প্রতি বছরের মতো এবারও মঙ্গল রথযাত্রা, হাজার প্রদ্বীপ প্রজ্বলন, পিঠা তৈরি উৎসব, ফানুস বাতি উড়ানো, পঞ্চশীল গ্রহণ, ধর্মীয় অনুষ্ঠানমালা এবং সামাজিক অনুষ্ঠানসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ২৯অক্টোবর বুধবার সন্ধ্যায় পুরাতন রাজবাড়ীর মাঠ থেকে মহারথ টেনে নিয়ে যাওয়া হবে বৌদ্ধ বিহারে, আর ৩০শে অক্টোবর সোমবার পুরো শহর ঘুরে মধ্যরাতে সাংগু নদীতে রথটি বিসর্জনের মধ্য দিয়ে মারমা সম্প্রদায়ের ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে (প্রবারণা উৎসব) ইতি টানা হবে।

বান্দরবান জেলা পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন জানান, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে প্রশাসন পক্ষ থেকে নিরাপত্তা জোরদারের যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

ট্যাগস :

তিনমাস বর্ষাবাসের পর মারমাদের প্রাণের উৎসব “ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে”

আপডেট সময় : ০৩:০৫:৩৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৩

তিনমাস বর্ষাবাসের পর মারমাদের প্রাণের উৎসব “ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে”

মোফাজ্জল হোসেন ইলিয়াছঃ

মারমা সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে (শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা)। প্রতিবছরের ন্যায় এই উৎসবকে কেন্দ্র করে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে ৩দিন ব্যাপী ধর্মীয় উৎসব পালন করবে বৌদ্ধ ধর্মালম্বী মারমা সম্প্রদায়। বছর পেরিয়ে আবারও প্রাণের এ উৎসবকে ঘিরে পাহাড়ী পল্লীগুলো যেন নতুন করে সেজেছে।

বৌদ্ধ ধর্মালম্বীরা জানায়, আদিকাল থেকে বৌদ্ধ অনুসারীরা তিন মাসব্যাপী বর্ষাবাস শেষ করে এবং শীল পালনকারীরা ধর্মীয় ভাবগম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে (প্রবারণা পূর্ণিমা) উৎসব পালন করে আসছে। কথিত আছে, বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা গৌতম বুদ্ধ এই আশ্বিনী পূর্ণিমায় তাঁর মাথার চুল আকাশে উড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং ঐ চুল স্বর্গে অবস্থিত মারমা ভাষায় “ছ্যাঙ দ আহ্রাং” অর্থাৎ চুলামনি জাদিতে স্থান পায়। তাই আশ্বিনী পূর্ণিমার এই তিথিতে বৌদ্ধ ধর্মালম্বীরা আকাশে শত শত ফানুস বাতি ওড়ানোর মধ্য দিয়ে উক্ত “ছ্যাঙ দ আহ্রাং” জাদিকে ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা গৌতম বুদ্ধকে স্মরণ বা পূজা করে থাকে। এই পূর্ণিমা দিনে নিজস্ব সামর্থ্য অনুযায়ী বিভিন্ন রংবেরঙে ফানুস বাতি বানিয়ে আকাশে উড়িয়ে থাকে বৌদ্ধ অনুসারীরা।

উৎসব উদযাপন পরিষদ সূত্রে জানা যায়, বান্দরবানে ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে উৎসবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে- মঙ্গল শোভা রথযাত্রা। এবারে বিশাল আকৃতির ড্রাগন তৈরি করে তার ওপর একটি বুদ্ধ মূর্তি স্থাপন করে রথটি টেনে পুরো শহর ঘুরিয়ে সাঙ্গু নদীতে বিসর্জন দেওয়া হবে। এ সময় বৌদ্ধধর্মের নর-নারীরা ভগবানের উদ্দেশে নগদ টাকা ও মোমবাতি জ্বালিয়ে পূজা করে বুদ্ধ মূর্তিকে। ওই সময় রথের পেছনে যুবক-যুবতীরা ঐহিত্যবাহী গান গেয়ে ঢোল বাজিয়ে সবাইকে উৎসাহ জোগায়।

অনুষ্ঠানের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিতে তৈরি করা হয় ভয়ঙ্কর আকৃতির পুতুল। আর নির্মিত পুতুলের ভেতরে মানুষ প্রবেশ করে নেচে-গেয়ে আনন্দ দেয়। রাতের মারমাদের ঐতিহ্য অনুষ্ঠান দেখার জন্য স্থানীয় পাশাপাশি পর্যটকরাও বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসে। ওই সময় রাস্তার দু’পাশে জমে উপচেপড়া ভিড়।

বান্দরবানে রথ কারিগর ক্যওয়ান মারমা বলেন, কয়েকজন বন্ধু মিলে ড্রাগন আদলে রথ আর পাঁচটি পুতুল তৈরি করেছি। প্রায় কাজগুলি সব শেষের দিকে। বৈরি আবহাওয়া কারণে রঙে কাজ করতে কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া মংক্যথোয়াই মারমা বলেন, অতি আগ্রহে দিন গুনতাম কবে আসবে আবারও মারমাদের ওয়াগ্যোয়াই উৎসব। এই বছর ভার্সিটির কয়েকজন সহপাঠি বাঙালি বন্ধুদের নিয়ে পাহাড়ে ঘুরতে যাচ্ছি। সবাই এক কাতারে মিলিত হয়ে ওয়াগ্যোয়াই উৎসবে মারমা ঐতিহ্যের পোশাক পরে ধর্মীয় অনুষ্ঠানমালার পাশাপাশি সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করবো।

এদিকে এবারেও ওয়াগ্যোয়াই পোয়েহ্-কে ঘিরে ২৯ অক্টোবর রাতে বান্দরবান শহরের বিভিন্ন পাড়ার অলি-গলিতে পিঠা তৈরির উৎসব আয়োজন করা হবে। রাতে পাহাড়ী তরুণ-তরুণীরা সারিবদ্ধভাবে বসে হরেক রকমের পিঠা তৈরি করে থাকে। পরদিন ভোরে নর-নারীরা সমবেত হয়ে ভগবান বুদ্ধের উদ্দেশ্যে বিহারে ছোয়েং (পিঠা আহার) দান করে। কিছু পিঠা, পায়েশ আবার প্রতিবেশীদের বাড়িতে বাড়িতেও বিতরণ করা হয়।

উৎসব উদযাপন পরিষদের সভাপতি হ্লাএমং থেওয়াং মারমা বলেন, প্রতি বছরের মতো এবারও মঙ্গল রথযাত্রা, হাজার প্রদ্বীপ প্রজ্বলন, পিঠা তৈরি উৎসব, ফানুস বাতি উড়ানো, পঞ্চশীল গ্রহণ, ধর্মীয় অনুষ্ঠানমালা এবং সামাজিক অনুষ্ঠানসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ২৯অক্টোবর বুধবার সন্ধ্যায় পুরাতন রাজবাড়ীর মাঠ থেকে মহারথ টেনে নিয়ে যাওয়া হবে বৌদ্ধ বিহারে, আর ৩০শে অক্টোবর সোমবার পুরো শহর ঘুরে মধ্যরাতে সাংগু নদীতে রথটি বিসর্জনের মধ্য দিয়ে মারমা সম্প্রদায়ের ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে (প্রবারণা উৎসব) ইতি টানা হবে।

বান্দরবান জেলা পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন জানান, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে প্রশাসন পক্ষ থেকে নিরাপত্তা জোরদারের যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।