দুর্ভাগা শব্দ টা লিটন দাসের সাথেই সুন্দর মানায়। জাতীয় দলে ধারাবাহিকতার অভাবে সবসময়ই পেয়ে এসেছেন দুয়োধ্বনি, সেই তুলনায় সমর্থন পেয়েছেন খুবই কম। পাবে কিভাবে? ২০১৫ সালে অভিষেক হলেও ধারাবাহিক ছিলেন না যে কখনওই!
কিন্তু সে যতটা দুয়োধ্বনি পেয়েছেন, ততটা দুয়োধ্বনির কি সে আসলেই যোগ্য? জানার জন্য ফিরে যেতে হবে অতীতে।
বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে অনূর্ধ্ব ১৫,১৭,১৯ সব দলেই খেলেছেন, খেলেছেন অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ ২ বার! এটা থেকে বুঝায় যায় প্রতিভা তার শুরু থেকেই ছিল।

ভারতের বিপক্ষে বৃষ্টি বিঘ্নিত টেস্ট ম্যাচে একমাত্র ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ৪৫ বলে করেন ৪৪ রান
২০১৪-১৫ সিজনে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ১৫ ম্যাচে রান করে ১১৩৬ রান। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ভালো করার সুবাদে ডাক পেয়ে যায় ভারতের সাথে টেস্ট খেলার জন্য। এর আগে ডাক পেলেও দলে জায়গা পায় নি, তবে এবার মুশফিকের ইঞ্জুরির জন্য প্রথম একাদশেই জায়গা পান তিনি।
ভারতের বিপক্ষে বৃষ্টি বিঘ্নিত টেস্ট ম্যাচে একমাত্র ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ৪৫ বলে করেন ৪৪ রান যেখানে ৮ চার এবং ১ ছয় ছিল।
একই বছর আফ্রিকার সাথে টিটুয়েন্টি খেলার সুযোগও পেয়ে যান। ম্যাচে ২৬ বলে ২৬ রান করেন তিনি।
২০১৫ সালে অভিষেক হলেও ২০১৮ সাল পর্যন্ত তার জাতীয় দলে পারফর্মেন্স ছিল সাদামাটা।

২০১৫ সালে অভিষেক হলেও ২০১৮ সাল পর্যন্ত তার জাতীয় দলে পারফর্মেন্স ছিল সাদামাটা
বেশিরভাগ ম্যাচেই নিষ্প্রভ থাকতেন তিনি। রান করতে না পারার জন্য সবসময়ই সমালোচনা শুনতে হয়েছিল কিন্তু বাস্তবতা হলো প্রতিভার অভাব কখনওই তার ছিল না।
কিন্তু প্রতিভার কথা বলে আর কত যদি ধারাবাহিক ভাবে রানই না আসে ব্যাটে!
২০১৫ সালে অভিষেক হওয়ার পর সেই বছর ওডিয়াই ম্যাচ খেলে ৯ টা। ৯ ম্যাচে রান করে মাত্র ১২৪, যেখানে গড় ১৬ থেকেও কম! এরকম বাজে খেলার পর দলে জায়গা পান নি অনেকদিন। ২০১৭ তে যখন দলে ফিরে আসে তখন ৩ ম্যাচ খেলে রান করেন মাত্র ৪১!
অর্থাৎ তার বাজে রান করাই চলছিল। রানই পাচ্ছিল না ওডিয়াই ক্রিকেটে। ২০১৮ সালে এশিয়া কাপ ফাইনালের আগ পর্যন্ত তার গড় ছিল ২০ এর কম।
আরও পড়ুন ইতিহাস গড়তে চান তামিম

২০১৫ সালে অভিষেক হওয়ার পর সেই বছর তিনি ওডিয়াই ম্যাচ খেলেন ৯ টা।পরিবর্তনের শুরুটা যেন সেই ফাইনাল থেকেই দেখা যায়। অসাধারণ এক সেঞ্চুরি তে ১২১ রান করে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে রান আউট হয় লিটন। কেন তিনি অসাধারণ প্রতিভা তা এই ম্যাচে কিছু দৃষ্টিনন্দন শটের মাধ্যমেই দেখিয়েছিলেন।
একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশ টিটুয়েন্টি ক্রিকেটে বড় টার্গেট তাড়া করতে দেখা ছিল ভক্তদের জন্য হতাশাজনক। তাদের ব্যাটিং দেখে কখনওই মনে হত না তারা জিতার জন্য ব্যাট করছে। একটা সময় যেই ১৮০ মানেই বাংলাদেশের কাছে পাহাড় সমান টার্গেট সেই বাংলাদেশ তাদের ইতিহাসে প্রথমবার ২১০+ টার্গেট টপকাতে সক্ষম হয়। যদিও দলের পক্ষে সর্বোচ্চ রান কিংবা ম্যান অব দ্য ম্যাচ কিছুই সে পায় নি তবে যেই ঝড়ো শুরুর প্রয়োজন ছিল সেটা ঠিকই এনে দেয় লিটন।
শ্রীলংকার দেয়া ২১৫ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে ১৯ বলে ৪৩ রান করে লিটন। যেখানে ২ টি ৪ এবং ৫ টি ৬ ছিল।
একই বছর আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ৩২ বলে ৬১ রানের এক অসাধারণ ইনিংস খেলে টিটুয়েন্টি ক্রিকেটে প্রথম ম্যাচ সেরা পুরষ্কার পায় তিনি।

ভাগ্য পরিবর্তনের শুরুটা সম্ভবত এই ২০১৮ থেকেই ছিল তার
ভাগ্য পরিবর্তনের শুরুটা সম্ভবত এই ২০১৮ থেকেই ছিল। ২০১৮ তে খুব ভালো না করলেও কিছু প্রভাবিত ইনিংসের কল্যানেই জায়গা পেয়ে যায় ২০১৯ সালের বিশ্বকাপ দলে।
প্রথমে কিছু ম্যাচে দলে জায়গা না পেলেও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ম্যাচে একাদশে জায়গা পান তিনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ বাংলাদেশ কে ৩২২ রানের বিশাল টার্গেট দেয়। ১৩৩ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে যখন বাংলাদেশ পরাজয়ের চিন্তায় ছিল তখন পিচে আসেন লিটন।
সাকিব আল হাসানের সাথে সেদিন বাংলাদেশের হয়ে রেকর্ডে ১৮৯ রানের পার্টনারশিপ করে দল কে সহজ জয় এনে দিতে সাহায্য করে লিটন। ৮.৩ ওভার হাতে রেখেই জয়ের বন্দরে পৌছে যায় বাংলাদেশ।

তার ক্যারিয়ার গড় যেখানে ৩০ ছুঁইছুঁই সেখানে ২০১৯ বিশ্বকাপ শেষ করে ৪৬ গড় নিয়ে
১২৪ করে ম্যাচ সেরা হন সাকিব এবং তাকে সমান ভাবে সাপোর্ট দিয়ে যান লিটন। ৯৪ রান করে অপরাজিত থাকেন সে। বিশ্বকাপে এরকম একটা জয় বাংলাদেশের জন্য স্মরণীয়ই বটে।
২০১৯ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশ বাদ পরে যায় তবে লিটনের জন্য বিশ্বকাপ টা ভালো ছিল বলা চলে। তার ক্যারিয়ার গড় যেখানে ৩০ ছুঁইছুঁই সেখানে ২০১৯ বিশ্বকাপ শেষ করে ৪৬ গড় নিয়ে।
২০২০ সালের শুরুতে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে লিটন তার ব্যক্তিগত সেরা ইনিংস এবং বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড গড়েন। একই ম্যাচে তামিম ইকবালের সাথে ওপেনিং জুটিতে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ রানও করেন।
সিরিজে ২ টা সেঞ্চুরি, ১৭৬ রানের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ইনিংস এবং একই ম্যাচে তামিমের সাথে ২৯২ রানের রেকর্ড পার্টনারশিপ করেন নি।ক্যারিয়ার জুড়ে বেশিরভাগ সময়েই তার ব্যাট ধারাবাহিকতা দেখতে পায় নি, তাই সমালোচনাই ছিল তার নিয়তি।
কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটে সবসময়ই ছিলেন অসাধারণ। তার ঘরোয়া ক্রিকেটের রেকর্ড আমাদের দলের প্রধান কাণ্ডারিসাকিব,তামিম,মুশফিক,মাহমুদুল্লাহর চেয়েও ভালো। কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটের অসাধারণ খেলা এবং ধারাবাহিকতা টেনে আনতে পারেনি জাতীয় দলে, তাই দুয়োধ্বনিই ছিল তার ভাগ্য।

২০১৯ বিশ্বকাপ থেকে শুরু করে তার ওডিয়াই গড় ৮১!
তবে পরিবর্তন হতে শুরু করেছে তার ভাগ্যে।
২০১৯ বিশ্বকাপ থেকে শুরু করে তার ওডিয়াই গড় ৮১! অবশ্যই এটা লিটন এবং দলের জন্যই ভালো কিছু।
তার ব্যাটিং এর টেকনিক, কোয়ালিটি সব কিছুই বলে সে একজন ওয়ার্ল্ডক্লাস ক্রিকেটার। শুধু অভাব ছিল ধারাবাহিকতার। কিছুদিন আগে অ্যানালাইসিস করা হয়েছিল দর্শনীয় ৫ ক্রিকেটারের নাম থাকবে তাতে জায়গা হয়েছিল লিটনের।
আশা করি সে তার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে একদিন ক্রিকেট কিংবদন্তীতে পরিণত হবে।
২০১৫ সালে যখন ভারতের বিপক্ষে খেলেছিল তখন ধোনি তার ব্যাটিং দেখে বলেছিল ,বাংলাদেশের উচিত তার যত্ন নেয়া, সে হবে বাংলাদেশের ভবিষ্যত ব্যাটিং কাণ্ডারি!
শুভ কামনা রইলো লিটনের জন্য।