ফরিদপুরে নৃশংস দুটি হত্যাকাণ্ড নিয়ে পুলিশের সংবাদ সম্মেলন
ফরিদপুর প্রতিনিধিঃ
জিহাদ ওরফে জয় (১৬) ও নয়ন সরদার (২০)। পেশায় দুজন অটোভ্যান চালক। খুনী তাদেরকে গলা কেটে হত্যার পর অটো ছিনতাইয় করে পালিয়ে যায়। পৃথক ঘটনা দুটি মধুখালী উপজেলায়। একটি মাসের ব্যবধানে আলোচিত ও নৃশংস এ দুটি হত্যাকাণ্ড। পুলিশ বেশ উৎকণ্ঠায়! অবশেষে পৃথক দুটি হত্যাকাণ্ডের ভয়ঙ্কর খুনীকে বিশেষ কৌশল অবলম্বনে গ্রেপ্তার ও মামলার তদন্তর অগ্রগতি নিয়ে ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মোঃ শাহজাহান আজ মঙ্গলবার (২৯ আগষ্ট) সংবাদ সম্মেলন করেন।
উল্লেখিত দুটি হত্যাকাণ্ডের সাথে একই ব্যক্তি জড়িত থাকার অভিযোগে রাশেদ কবিরকে আটক করা হয়েছে বলে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান পুলিশ সুপার মোঃ শাহজাহান।
পুলিশ সুপার বলেন, গত ৪ জানুয়ারি জেলার মধুখালী থানা পুলিশ সংবাদ পায় যে, মধুখালী থানাধীন জাহাপুর ইউনিয়নের মুরারদিয়া গ্রামের জনৈক কাশেম মোল্লার জমি সংলগ্ন পাকা রাস্তার ঢালে গলাকাটা মৃতদেহ পড়ে আছে। এমন খবর পেয়ে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে। পরে লাশের সনাক্তকরনে জানা যায় নিহতের পরিচয় জিহাদ ওরফে জয়। তিনি পেশায় একজন ব্যাটারী চালিত অটোভ্যান চালক। মোসাঃপাচি বেগম তার নাতি মোঃ জিহাদ ওরফে জয় এর মৃতদেহ ও পরিচয় সনাক্ত করেন।
সূত্র পুলিশকে জানায়, জিহাদ নিজ ব্যাটারী চালিত অটোভ্যান নিয়ে বাড়ী হতে বের হয়ে ঘটনার দিন রাতে বাড়িতে না ফেরায় তাকে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুজি করা হয়। পরের দিন ৪ জানুয়ারি সকালে উক্ত স্থানে তার গলাকাটা মৃত দেহ পাওয়া যায়। মোঃ জিহাদ ওরফে জয়কে হত্যা করে দুষ্কৃতিকারী তার ব্যবহৃত ব্যাটারী চালিত অটোভ্যান ছিনতাই করে নিয়ে যায়। জিহাদের নানী মোসাঃ পাচি বেগম অজ্ঞাতনামা আসামীর বিরুদ্ধে মধুখালী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মধুখালী থানার মামলা নং-০৬ তারিখ-০৫/০১/২০২৩ ধারা-৩০২/৩৯৪/২০১/৩৮ পেনাল কোড রুজু হয়।
অপরদিকে গত ৯ ফেব্রুয়ারি সকালে মধুখালী থানাধীন রায়পুর ইউনিয়নস্থ বকসীপুর সাকিনস্থ জনৈক অমৃত দাসের পতিত জমির মাথায় ইটের রাস্তার উত্তর পাশে গলাকাটা মৃতদেহ পড়ে আছে। লাশ উদ্ধারের পর নিহতের পরিচয় পাওয়া যায় নয়ন শিকদার। তিনি পেশায় একজন অটোভ্যান চালক। তার পিতা মোঃ লুৎফর সরদার ঘটনাস্থলে গিয়ে তার ছেলে নয়ন সরদারের বলে লাশ সনাক্ত করেন।
তিনি পুলিশকে জানান, গত ৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ব্যাটিরী চালিত অটোভ্যান নিয়ে নিজের বাড়ী থেকে বের হন। রাতে বাড়ীতে না ফেরায় বিভিন্ন স্থানে খোজাখুজি করেন। একদিন পর ৯ ফেব্রুয়ারি সকালে তার ছেলের গলাকাটা মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। ওই সময়ে দুস্কৃতিকারী অটোভ্যানটি ছিনতাই করে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় নয়ন সরদারের পিতা অজ্ঞাতনামা আসামী করে মধুখালী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা নং-০৭ তারিখ ধারা-৩০২/৩৯৪/২০১/৩৪ পেনাল কোড রুজু হয়।
এদিকে দুই মাসে দুইটি নৃশংস হত্যাকান্ড। আবার একইভাবে হত্যা কাণ্ড ও অটোভ্যান ছিনতাইর ঘটনায় মধুখালী থানা পুলিশ ও জেলা পুলিশকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়ে ভাবনায় ফেলে দেয়। অবশেষে পুলিশ গোপনীয় ও আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার মাধ্যমে খুনীদের বিষয়ে জোর তৎপরতায় মুল বিষয়টি পুলিশের কাছে উঠে আসে এবং খুনের মুল হোতাকে আটক করে।
মধুখালী থানা পুলিশ মামলা তদন্তকালে পৃথক দুইটি হত্যাকান্ডের ঘটনায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত ৫ মার্চ আসামী মিজানুর রহমান নিঝুমকে আটক করে। নিঝুম মধুখালী উপজেলার গদাধরদী গ্রামের আলেমখার ছেলে। তার স্বীকারোক্তি মোতাবেক তার গ্যারেজ হতে লুণ্ঠিত অটোভ্যান উদ্ধার করা হয়। আসামী মিজানুর রহমান নিঝুম পুরাতন ভ্যানক্রয় বিক্রয় ও মেরামত ব্যবসা করত। আদালতে তাকে হাজির করার পর মোঃ মিজানুর রহমান নিঝুম স্বেচ্ছায় বিজ্ঞ আদালতে ফৌঃকাঃবিঃ ১৬৪ ধারা মোতাবেক দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। এসময় আসামী রাশেদ কবিরের নিকট হতে ভ্যানটি ক্রয় করার কথা স্বীকার করে।
পুলিশ সুপার জানান, আসামী রাশেদ কবির ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানার বৈলর চরপাড়া গ্রামের মৃত ইসমাইল হোসেনের ছেলে। পুলিশ গত ৬ মার্চ ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানা এলাকায় তার নিজ বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করে তাকে গ্রেপ্তার করে। উল্লেখিত আসামী প্রায় ৭/৮ বছর ত্রিশাল এলাকায় বসবাস না করায় তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা থানা, গাজীপুর জেলার জয়দেবপুর থানা এলাকা, ডিএমপি-ঢাকা মিরপুর-১ এবং মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর থানা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হলেও অভিযানের বিষয়টি টের পেয়ে গা ঢাকা দেয়।
রাশেদ কবির ২০২১ সাল হতে তার ভগ্নিপতি আনোয়ার হোসেন ওরফে ইলিয়াস গাজী মধুপুরের বাড়িতে বসবাস করতো।
তার শ্বশুর বাড়ি মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর থানা এলাকায় হলেও স্ত্রী কাতারে থাকে। ২৮ আগস্ট সকালে উল্লেখিত আসামীকে উন্নত তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ঢাকা মেট্রোপলিটন গুলশান-২ এলাকা হতে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামী রাশেদ কবির ডিসিষ্ট জিহাদ ওরফে জয় এবং নয়ন সরদারকে ধারালো ছোরা দিয়ে হত্যা করে ব্যাটারী চালিত অটোভ্যান লুণ্ঠন করার কথা স্বীকার করে। গ্রেপ্তারকৃত আসামীকে বিধি মোতাবেক বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করা হবে বলে জানিয়ে পুলিশ সুপার জানান, মামলার তদন্ত অব্যাহত আছে।
রাশেদ কবিরের পিসিপিআরে দেখাযায়, তার নামে, ঢাকা জেলার ধামরাই থানার মামলা নং-৩, তারিখ-০৪/১০/২০১৬ ধারা- আইন-শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুতবিচার) আইন, ২০০২ (সংশোধনী/২০১৭) এর ৪(১) অভিযুক্ত এবং ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানার মামলা নং-১৩, তারিখ-০৯/০৭/২০১৮ ধারা- ১৪৩/৩৪১/৩২৩/৩২৬/৩০৭/৩৭৯ / ৫০৬/১১৪ পেনাল কোড সংক্রান্তে আটকের পরোয়ানা অব্যাহত রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার (এসপি) ছাড়াও অতিরিক্ত পুলিশ (প্রশাসন ও অর্থ) মোহাম্মদ ইমদাদ হুসাইন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) শৈলেন চাকমা, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) শেখ মোঃ আব্দুল্লাহ বিন কালাম, সহকারী পুলিশ সুপার (মধুখালী সার্কেল) মোঃ মিজানুর রহমান, মধুখালী থানার ওসি মোঃ শহিদুল ইসলামসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং প্রিন্ট-ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন।