মাস্টারমাইন্ড সজিবের নেতৃত্বে প্রান্ত হত্যা
মামুনুর রশীদ/ফরিদপুর প্রতিনিধিঃ
পেশা মূলত ছিনতাই। উদ্দেশ্যে ছিনতাই করে অর্থ যুগিয়ে মাদক সেবন করা। একই সাথে বাড়তি বিনোদন পতিতালয়ে আমোদ প্রমোদ। ছিনতাইকারী কিশোর গ্যাং মাস্টারমাইন্ড সজিবের সাথে জেলখানা থেকে একে অপরের সঙ্গে সখ্যতা ও সংঘবদ্ধতা। ছিনতাইকারী সজিবের নেতৃত্বে ছিনতাইর ঘটনাচক্রে চাকু দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় প্রান্ত মিত্রকে।
ফরিদপুরে রাজেন্দ্র কলেজের অনার্স (উদ্ভিদবিদ্যা) তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী প্রান্ত মিত্র (২৩) নিহতের ঘটনায় পুলিশ তদন্তে এমনটি উঠে এসেছে। ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ৪ জনকে গ্রেপ্তারসহ পুলিশ উদ্ধার করেছে হত্যাকাণ্ড ও ছিনতাইয়ের কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন আলামত।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন তানভীর আহম্মেদ সজিব শেখ (২৩), ইসরাফিল মল্লিক (৩৪), সিফাতুল্লাহ বেপারী (১৯) ও মাসুম শেখ (৩৪)। প্রান্ত হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল, চাপাতি, সেভেন গিয়ার চাকু, রেঞ্জ, রক্তমাখা জামা-কাপড়, জুতা ও বেল্ট উদ্ধার করা হয়। তাদের মধ্যে প্রথম তিনজন ছিনতাই ও হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয় ও তাদেরকে মোটরসাইকেল সরবরাহ করেন অপর ছিনতাইকারী মাসুম শেখ। ঘটনার একইরাতে ছিনতাইকারী দলটি প্রান্তকে হত্যার পর একটি মোটরসাইকেলে ঘুরে ঘুরে শহরের বিভিন্ন এলাকায় আরও বেশ কয়েকটি ছিনতাই সংগঠিত করে।
আজ বুধবার দুপুরে ফরিদপুরের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান পুলিশ সুপার মো. শাহজাহান। সংবাদ সম্মেলনে নিহত প্রান্ত মিত্রের বাবা বিকাশ মিত্র,মা পুতুল মিত্রসহ পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও সংবাদ সম্মেলনে ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ এমদাদ হোসেন,সদর সার্কেল অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুমন রঞ্জন সরকার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শৈলেন চাকমা, ডিবির ওসি আবদুল কালাম, টি আই তুহিন লস্কর, কোতয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ আব্দুল জলিলসহ পুলিশের অন্যান্য কর্মকতা, প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়ার সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন
পুলিশ সুপার মোঃ শাহজাহান বলেন,গত ২৫ জুলাই রাত ২টার দিকে হৃদয় নামে এক বন্ধুর বোনের ডেলিভারি সংক্রান্ত জটিলতায় সহায়তা করতে প্রান্ত শহরের ওয়ারলেসপাড়ার বাসা থেকে বের হওয়ায় পর একটি রিকশায় হাসপাতালে যাওয়ার পথে আলিমুজ্জামান ব্রিজের ঢালে তিন ছিনতাইকারী তার থেকে স্মার্টফোন ও ২ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়। এ সময় ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে প্রান্তের বুকে ধারালা চাকু দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। ছিনতাইকারীরা প্রান্তকে হত্যার পরে রাত পৌনে ৪টার দিকে আলীপুর বাদামতলী সড়কে একজন সবজি বিক্রেতার ভ্যান থামিয়ে ৩ হাজার টাকা ছিনতাই করে।
এরপর রাত সোয়া ৪টার দিকে ঝিলটুলীতে পুরাতন পাসপোর্ট অফিসের সামনে ধুলদি মসজিদের ইমাম মুফতি আবু নাসিরের কাছ থেকে চাপাতির ভয় দেখিয়ে স্মার্টফোন ও নগদ টাকা ছিনতাই করে। ভোর ৫টার দিকে শহরের কমলাপুরে জেলা জাকের পার্টির সভাপতি মশিউর রহমান যাদু মিয়াকে কুপিয়ে জখম করে তার স্মার্টফোন ছিনতাই করে পালিয়ে যাওয়ার পথে ভোর ৫টার পর পূর্ব খাবাসপুর অন্ধকল্যাণ হাসপাতালের সামনে শরীফ উল্লাহ মাহমুদ মিয়া নামে একজন চিকিৎসকের কাছ থেকে একটি ল্যাপটপ, একটি স্মার্টফোন ও নগদ টাকা ছিনতাই করে।
পুলিশ গণ ছিনতাইয়ের অভিযোগ পেয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকতা, থানা পুলিশ ও ডিবির সমন্বয়ে একটি চৌকস টিম গঠন করে মামলার তদন্ত পরিচালনা করা হয়। তদন্ত টিম বিভিন্ন সিসি টিভি ফুটেজ পর্যালোচনা ও তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঢাকার শ্যামপুর থেকে তানভীর আহম্মদ সজিব শেখকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার কাছ থেকে নিহত প্রান্ত মিত্রের ছিনতাই হওয়া মোবাইল সেট উদ্ধার করা হয়। তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী মধুখালী থেকে আসামি ইসরাফিল মোল্লাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ তার কাছ থেকে যাদু মিয়ার ছিনতাই হওয়া মোবাইল সেট উদ্ধার করে। গ্রেপ্তারকৃতদের দেয়া সকল তথ্য অনুযায়ী পরবর্তীতে উদ্ধার করা হয় অন্যান্য মালামাল।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, কুপিয়ে আহত হওয়ার পর প্রান্তের শরীর রোড ডিভাইডারের ওপর হাঁটু ভাঙা অবস্থায় চিৎ হয়ে পড়েছিল। এজন্য তার শরীরে রক্তক্ষরণ হলেও তার বেশিরভাগই পেটের খালি স্থানে জমে ছিল বলে ময়নাতদন্তে দেখা যায়। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক জানান, আড়াই থেকে তিন লিটার রক্ত তার শরীরের মধ্যে জমা ছিল। অল্পকিছু রক্ত বাইরে বের হয় যা মাটিতে লেগে ছিল।
সংবাদ সম্মেলনে নিহত প্রান্ত মিত্রের বাবা বিকাশ মিত্র, মা পুতুল মিত্রসহ পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলন শেষে নিহত প্রান্তের মা পুতুল মিত্র কান্নায় ভেঙে পড়েন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে বলেন, আমার বাবা সারাজীবন পরের উপকার করতে করতে নিজের জীবন দিয়ে গেলো। আমার মত যেন কোন মায়ের বুক থেকে অপরাধীরা মায়ের সন্তানকে কেড়ে নিতে না পারে। এজন্য অপরাধীদের দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে সন্তান নিয়ে এদেশের মায়েরা নিরাপদে থাকতে পারবেন। ।
প্রসঙ্গত গত সোমবার (২৫ জুলাই) রাত আড়াইটার দিকে হৃদয় নামে এক বন্ধুর ফোন পেয়ে শহরের ওয়ারলেসপাড়ার বাসা থেকে রিকশায় করে শিশু হাসপাতালের উদ্দেশে যাচ্ছিলেন প্রান্ত মিত্র। পথিমধ্যে ছুরিকাঘাতে নিহত হন প্রান্ত। দুদিন পরে বুধবার (২৭ জুলাই) রাতে প্রান্তের বাবা বিকাশ মিত্র অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় এ মামলা করেন। মামলা নং-৮৬ ধারা- ৩৯৪/৩০২/৩৪ দণ্ডবিধি।
ফরিদপুরে রাজেন্দ্র কলেজের অনার্স (উদ্ভিদবিদ্যা) তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী প্রান্ত মিত্রর নিহতের ঘটনা মিডিয়ায় ফলাও করে সংবাদ প্রচারের পর থেকে সামাজিক মহলেও আলোচিত হয়ে উঠে চাঞ্চল্যর সৃষ্টি হয়। অবশেষে ফরিদপুরের পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ মামলাটি ব্যাপক গুরুত্বের সাথে তদন্ত সাপেক্ষ প্রান্ত মিত্র হত্যার সাথে জড়িত মাস্টারমাইন্ড কিশোর গ্যাং সজিবসহ তার চার সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে।