জেলা প্রতিনিধি:দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম ভারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান মোবারকগঞ্জ চিনিকলে লুব্রিকেন্ট মবিল ক্রয়ে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সম্প্রতি মিলের ২০২০-২০২১ মাড়াই মৌসুমে ব্যবহারের জন্য ৪১ লাখ টাকা মূল্যের ৫৬ ব্যারেল লুব্রিকেন্টস ক্রয় করা হয়। যার প্রতি ব্যারেলে ২০ থেকে ২৫ লিটার কম পাওয়া গেছে। ঘটনা তদন্তে ২৪ ডিসেম্বর পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে মিল কর্তৃপক্ষ। ৫৬ ব্যারেলে প্রায় ১১৩৭০ লিটার লুব্রিকেন্ট আনা হয়েছে খুলনার যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড থেকে। তবে কম পড়া লুব্রিকেন্টের দ্বায়ভার নিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট চিনিকল বা সরবরাহকারী যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড। কম পড়া এ লুব্রিকেন্টের প্রতি লিটারের মূল্য ধরা হয়েছে ২৫০ থেকে ৬১০ টাকা। এসব মবিল আনার দায়িত্বে ছিলেন মিলের টিএলআর মাসুদ রানা। মিল কর্তপক্ষ ও তদন্ত কমিটি প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে লুব্রিকেন্ট আনার পথে হয়ত ব্যারেল থেকে এসব লুব্রিকেন্টস বের করে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তবে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এখনি তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্বাক্ষরিত তদন্ত কমিটিতে রয়েছেন মিলের ব্যবস্থাপক (হিসাব) মো. জাহিদুল ইসলাম, উপ-ব্যবস্থাপক (পরিবহন প্রকৌশল) রায়সুল ইসলাম, উপ-ব্যবস্থাপক (সংস্থাপন) আশেকুজ্জামান, উপ-ব্যবস্থাপক (উৎপাদন) জাকির হোসেন ও সহ-ব্যবস্থাপক (যন্ত্র কৌশল) সাধন কুমার মণ্ডল। কমিটিকে আগামী ১০ কর্ম দিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। তদন্ত কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মিলের যে কোনো মালামাল ক্রয়ে পৃথক দুটি কমিটি করা হয়। একটি কমিটি ক্রয় করেন বাকি একটি কমিটি বুঝে নেন। কিন্তু কীভাবে কম থাকা লুব্রিকেন্টস মিল স্টোরে ঢুকল, তা বোধগম্য নয়।
এদিকে মিলের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক (এডিএম) আনোয়ার হোসেন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, ঘটনা তদন্তে কমিটি করা হয়েছে। তদন্তে দোষী যেই হোক, তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মিল কর্তৃপক্ষ দুর্নীতি প্রতিরোধে তৎপর রয়েছে। সম্প্রতি তেল চুরির একটি ঘটনা জানার পরই জড়িতকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়া শুকনা আখ কেনার অপরাধে ইক্ষু ক্রয় কেন্দ্রের সিআইসি রায়হান উদ্দীন ও সিডিএ কাম সিআইসি কামাল হোসাইন নামে দু’জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, চলতি মাড়াই মৌসুমে দেশের ছয়টি মিল সরকার বন্ধ ঘোষণা করেছে। এরপরই মিলটি ঘুরে দাঁড়াতে তৎপর হয়ে ওঠে। এ ধারাবাহিকতায় মিলের চিনি উৎপাদনে গড় আহরণ বেড়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার চলতি মাড়াই মৌসুমের ২০ কার্যদিবসে চিনি আহরণের গড় ছিল ৫.৩০। যা একই কার্যদিবসে গত মৌসুমে ছিল ৪.৮৫। চলতি মাড়াই মৌসুমে মিলটি চিনি উৎপাদনে আশার থেকে বেশি ভালো করবে বলে আশা করছেন এডিএম আনোয়ার। তবে, দক্ষিণাঞ্চলের গুরত্বপূর্ণ এই ভারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানটি পরিচালনায় অব্যবস্থাপনা, মোটা অংকের ব্যাংক সুদ প্রদান ও মান্দাতার আমলের ম্যানুয়াল পদ্ধতির কারখানা ও আখের জাত উন্নয়ন না হওয়া চিনি আহরণ কমছে।
অন্যদিকে, চিনি উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের শ্রমিক মজুরি খরচ, আখ ক্রয়, মিলে অপরিষ্কার আখ সরবরাহ, রস ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত দৈনিক আখ মাড়াই, পরিবহন খরচ, কারখানা মেরামত এবং বয়লারের জ্বালানিসহ প্রায় অর্ধশতাধিক খাতের খরচ মিটিয়ে প্রতি বছরই বাড়ছে চিনি উৎপাদন খরচের এই অংক। সে তুলনায় বাড়েনি চিনির বিক্রয় মূল্য। ফলে বছরের পর বছর মিলটিকে লোকসান দিতে হচ্ছে।
উল্লেখ্য, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা শহরে ১৯৬৫ সালে ৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০৭.৯৩ একর নিজস্ব জমির ওপর নেদারল্যান্ড সরকার মোবারকগঞ্জ চিনিকলটি স্থাপন করে। এরমধ্যে ২০.৬২ একর জমিতে কারখানা, ৩৮.২২ একর জমিতে কর্মকর্তা ও শ্রমিক-কর্মচারীদের জন্য আবাসিক কলোনি, ২৩.৯৮ একর পুকুর এবং ১০৭ একর জমিতে পরীক্ষামূলক ইক্ষু খামার। এছাড়া ১৮.১২ একর জমিতে জুড়ে রয়েছে সাব জোন অফিস ও আখ ক্রয় কেন্দ্র। প্রতিষ্ঠাকালীন মৌসুমে পরীক্ষামূলকভাবে ৬০ কর্মদিবস আখ মাড়াই চলে। লক্ষ্য পূরণ হওয়ায় ১৯৬৭-১৯৬৮ মাড়াই মৌসুম থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদন শুরু করে। ঝিনাইদহের ৬ উপজেলা ছাড়াও যশোরের দুটি উপজেলা নিয়ে গঠিত মোচিক জোন মিলের আটটি জোনের আওতায় চাষযোগ্য জমির পরিমাণ রয়েছে সাড়ে তিন লাখ একর। আখ ক্রয় কেন্দ্র রয়েছে ৪৮টি।