বছরের দ্বিতীয় স্কাইপে বৈঠকে নতুনত্ব আনলেন লন্ডনে থাকা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। হাসি-খুশি, খুনসুটি দিয়ে নগর বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সাথে বৈঠক শুরু করলেও যখনই বুঝলেন বড় নেতাদের সামনে অন্য নেতারা কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন না— তখন একজন একজন করে স্কাইপেতে কথা বলার ব্যবস্থা নিলেন।
তার আগে সবাই একসাথে বসা অবস্থায় নগর বিএনপির কমিটি নিয়ে মতামত চাইলে নগর বিএনপির সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেনের অনুসারীরা নির্বাচনের পরে কমিটি ভাঙ্গার অনুরোধ করলে তারেক রহমান ধমকের সুরে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের অধীনে কিসের নির্বাচন? প্রহসনের নির্বাচনে অংশ নিয়ে কী হবে? দ্রুত দল গোছাতে হবে।’
দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের এমন কঠোর অবস্থানে শুক্রবার (৯ অক্টোবর) বিকেল ৪টা থেকে রাত প্রায় ২টা পর্যন্ত চলা স্কাইপে বৈঠকে অংশ নেওয়া চট্টগ্রাম নগর বিএনপির নেতাদের মধ্যে যারা ‘ডা. শাহাদাতপন্থী’ ছিলেন তারা অনেকটা অসহায় অবস্থায় পড়েন বলে দলীয় একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
তারেক রহমানের সাথে প্রায় ১০ ঘন্টা স্কাইপে বৈঠকের পর নগর বিএনপির সবার কাছে পরিস্কার হয়ে ওঠে, নির্বাচন যখনই হোক ডা. শাহাদাত হোসেনকে নগর বিএনপির চেয়ার ছাড়তে হচ্ছে চলতি মাসেই। নগর বিএনপির আহ্ববায়কও ঠিক করে রেখেছেন দলের হাইকমান্ড। যা চলতি অক্টোবর মাসেই ঘোষণা হবে বলে দলের শীর্ষ নেতারা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে নিশ্চিত করেন।
নগর বিএনপির আহ্ববায়ক কমিটি গঠন হচ্ছে জানিয়ে দলের একাধিক নীতিনির্ধারক চট্টগ্রাম প্রতিদিনের কাছে বলেন, ডা. শাহাদাত হোসেন ও আবুল হাশেম বক্করের নেতৃত্বাধীন কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে গত বছরের ৬ আগস্ট। তখনই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আহ্বায়ক কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপনির্বাচন এবং চসিক নির্বাচনে দল অংশ নেওয়ায় কমিটি গঠন প্রক্রিয়াটা থেমে যায়।
নীতিনির্ধারক পর্যায়ের এক নেতা বলেন, ‘মাঝে করোনার কারণে দীর্ঘদিন দলীয় কর্মকাণ্ডের ওপর হাইকমান্ডের স্থগিতাদেশ ছিল। নির্দেশ ছিল জনগণের পাশে দাঁড়ানোর। যার যা সামর্থ্য ছিল তা দিয়ে নেতাকর্মীরা জনগণের পাশে ছিল। করোনার প্রকোপ কমার পর আমরা দলীয় কার্যক্রম শুরু করেছি। লন্ডন থেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সব তদারকি করছেন। দলে গতি আনতে পরিবর্তনের কোন বিকল্প নেই। শিগগিরই মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে তিন মাসের জন্য আহ্বায়ক কমিটি দেওয়া হবে।’
গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য ধানের শীষে ভোট দেয়ার আহ্বান আলালের
ওই নেতা আরও বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কমিটি নিয়ে সবার মতামত চাইলে কেউ কেউ চসিক নির্বাচনের পর কমিটি গঠনের কথা বলেন। আওয়ামী লীগের অধীনে কী ধরনের নির্বাচন হয় সেটা তো সবার দেখা। তাই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সাহেব নির্বাচনের জন্য দলের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটকে অচল করে রাখতে মোটেই ইচ্ছুক নয়। তিনি নির্বাচনের কারণে দলের কার্যক্রম বন্ধ রাখার কথা শুনে আমাদের হালকা ধমকের সুরে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের অধীনে কিসের নির্বাচন? প্রহসনের নির্বাচনে অংশ নিয়ে কী হবে? দ্রুত দল গোছাতে হবে। দল গঠন প্রক্রিয়া শেষে জনগণকে সাথে নিয়ে অবৈধ, রাতের ভোটের সরকারকে হটিয়ে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
অন্যান্যবার সব নেতা একসাথে বসায় কেউ কারও বিরুদ্ধে কোন কথা বলতে না পারলেও এবারের বৈঠকে গত ৪ বছর নগর বিএনপির হালচাল সচিত্রভাবে নেতারা তুলে ধরেন তারেক রহমানের কাছে। তাদের অনেকেরই দাবি, ডা. শাহাদাত হোসেন নগর কমিটি গঠন নিয়ে শুধু স্বেচ্ছাচারিতাই করেননি, দলের প্রবীণ ও ত্যাগী নেতাদের পদপদবিতে যেমন অবমূল্যায়ন করেছেন, তেমনি গত চারটি বছর দলকে অকার্যকর করে রেখেছেন।
প্রবীণ এক নেতা বলেন, ‘আমি সুযোগ পেয়ে মন উজাড় করে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে অনেক কথা বলেছি। উনি মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন। আমি তাকে বলেছি, নগর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল্লাহ আল নোমান, মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন এবং বর্তমান স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীরা যেসব নেতার ওপর নির্ভর করতেন, পরামর্শ নিতেন— শাহাদাত-বক্কর তাদেরকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। কয়েকটা চ্যাঙড়া পোলাপাইন গাড়িতে ঘোরালে যে দল চলে না— সেটা সবাই বুঝলেও উনাদেরকে কে বোঝাবে?
এই নেতা আরও বলেন, ‘চার বছর পদে থেকে নতুন নেতা তৈরি দূরে থাক, আগের নেতারা মহানগরকে যে অবস্থায় রেখে গেছেন তারা তো তার থেকে কয়েকগুণ পিছনে নিয়ে গেছেন। পাজেরো গাড়িতে চড়ে ক্লাবে আর বাসা-বাড়িতে দাওয়াত খেয়ে ফেসবুকে ছবি দেওয়ার নাম রাজনীতি নয়। যা গত চার বছর যাবত আমাদের মতো রাজনৈতিক কর্মীদের ব্যথিত করেছে। সুযোগ পেয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে সব বলেছি। ছবিও দেখিয়েছি। তার চেহারায় পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। আশা করি দলে পরিবর্তন আসবে।’
স্কাইপে বৈঠকের বিস্তারিত জানিয়ে আরেক নেতা বলেন, ‘বৈঠকে মূল দলের সাথে সহযোগী সংগঠনগুলোর দূরত্বের বিষয়টি তুলে ধরেছি। আমার মনে হলো তারেক রহমান সাহেব আমি বলার আগ থেকেই জানতেন। কারণ বিগত দিনগুলোতে আমরা সহযোগী ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, শ্রমিক দলের মতো শক্তিগুলোকে আমাদের কাছে পাইনি। সবকটি সহযোগী সংগঠনের সঙ্গে আমাদের দূরত্ব তৈরি হয়ে আছে। এটার জন্য আমাদের নগর নেতৃবৃন্দই দায়ী। কারণ ওরা আমাদের ছোট ভাই-সন্তানের মতো। তাদের কাজে লাগাতে না পারা পরিবারের কর্তাদের ব্যর্থতা। নগর বিএনপি সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে।’
প্রসঙ্গত, একমাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে নির্দেশনা দিয়ে ২০১৬ সালের ৬ আগস্ট কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে তিন সদস্যের চট্টগ্রাম নগর কমিটি ঘোষণা করেছিল দলটির কেন্দ্রীয় কমিটি। এক মাসের পরিবর্তে ১১ মাস সময় নিয়ে গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে ১৫১ সদস্যের স্থলে ২৭৫ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়। নিজেদের ৪ বছর দুই মাস সময়ে থানা কমিটিগুলো তারা রেখে দিয়েছে ‘সুপার ফাইভের’ নেতৃত্বে।
মেয়াদের তিন বছরে আকবরশাহ ও ডবলমুরিং থানা কমিটি ঘোষণা করতে পারলেও অন্য থানাগুলো থেকে তিন থেকে পাঁচজনে। মেয়াদ শেষে কোতোয়ালী থানা কমিটি ঘোষণা দিয়েছিল নগর কমিটি। অন্যান্য চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ, বায়েজিদের কমিটি ঘোষণা করতে চাইলে তাদের সেই ক্ষমতায় লাগাম টানা হয় মেয়াদ উত্তীর্ণ বলে। হাইকমান্ড থেকে শাহাদাত-বক্করের স্বাক্ষর ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে শুধু নিয়ম রক্ষার কর্মসূচিতে তাদের ক্ষমতা সীমিত করা হয়। এবার স্কাইপে বৈঠকের পর কমিটি বিলুপ্তিও চূড়ান্ত হলো। আর নগর বিএনপিতে শেষ হতে যাচ্ছে দলের ভেতরেই সবচে সমালোচিত শাহাদাত-বক্কর জুটির।
চট্টগ্রাম প্রতিদিন