দল নয়, নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত তিনি! নরসিংদীর শিবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হারুনুর রশীদ খান। তিনি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানও। অভিযোগ রয়েছে, দলে কিংবা পরিষদে তাঁর একক স্বেচ্ছাচারিতায় অতিষ্ঠ সবাই। দলীয় পদ ব্যবহার করে তিনি করে যাচ্ছেন নানা অপকর্ম। এতে একদিকে যেমন বিব্রত দলের নেতাকর্মীরা, অন্যদিকে প্রশাসনে চাপা ক্ষোভ। সরকারি জমি দখল করে পাঁচতলা বাড়ি বানানো, নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করে বহিষ্কার হয়েও আবারও স্বপদে বহাল হয়ে বেপরোয়া তিনি। উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কমিটিতে ত্যাগীদের না রেখে অর্থের বিনিময়ে বিএনপি-জামায়াত থেকে আসা নেতাকর্মীদের পদ-পদবি দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে।
সরকারি জমিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির ভবন
হারুনুর রশীদ খানের বহুতল বাণিজ্যিক ভবনের একাংশ সরকারি জমির ওপর—এমন অভিযোগ এনে তা অপসারণে উপজেলা প্রশাসনের দেওয়া নোটিশ, এমনকি আদালতের নিষেধাজ্ঞাও আমলে না নিয়ে দলীয় প্রভাব খাটিয়ে ভবন নির্মাণ করেছেন।
উপজেলা ভূমি কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০১০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় চক্রধা ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয় এক প্রতিবেদনে সরকারি জমিতে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই পাকা ভবন নির্মাণ করার অভিযোগ আনা হয়। একই সঙ্গে সরকারি ভূমিতে ভবন নির্মাণ বন্ধ রাখার কথা উল্লেখ ছিল। ইউনিয়ন ভূমি অফিসের প্রতিবেদন পাওয়ার পর উপজেলা ভূমি কার্যালয় সার্ভেয়ার দিয়ে ভূমি পরিমাপ করে। ওই বছর ৪ এপ্রিল তাদের প্রতিবেদনে নির্মাণাধীন ভবনটির মধ্যে আরএস রেকর্ডে শিবপুর মৌজায় ১ নম্বর খতিয়ানে ৩৮৭ ও ৩৮৮ দাগে ৪ শতাংশ সরকারি জমি রয়েছে বলে উল্লেখ করে। একই বছর ২২ জুন আরেক প্রতিবেদনে বাধা দেওয়া সত্ত্বেও পাকা ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে উল্লেখ করে উপজেলা সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) অবহিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এরপর ১৪ অক্টোবর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) হারুনুর রশীদ খানকে সাত দিনের মধ্যে অবৈধ স্থাপনা সরানোর জন্য নোটিশ দেন। অন্যথায় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানানো হয়। নোটিশ পাওয়ার পরও সরকারি জমি থেকে স্থাপনা অপসারণ করা হয়নি। সেখানে বর্তমানে একটি পাঁচতলা বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
দলে স্বেচ্ছাচারিতা
শিবপুর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অনেকেই অভিযোগ করেছেন, উপজেলা সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দলীয় গঠনতন্ত্র উপেক্ষা করে স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে পরিচালনা করছেন হারুনুর রশীদ খান। ২০১৪ সালে এ কমিটি গঠন করা হলেও এখন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ কমিটির মুখ কেউ দেখেনি। সভাপতি নিজের খেয়ালখুশি মতো কমিটিতে যখন ইচ্ছা কাউকে বাদ দিচ্ছেন আবার অর্থের বিনিময়ে কমিটিতে সংযুক্ত করছেন। ছয় বছরে কার্যকর কমিটির কোনো মিটিং হয়নি। এ ছাড়া কোনো কারণ ছাড়াই বিভিন্ন সময় ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পরিবর্তন করেন। দলের আদর্শে বিশ্বাসী নয় এবং অনুপ্রবেশকারীদের ওয়ার্ড কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবি দিচ্ছেন। শিবপুর উপজেলার ৯০টি ওয়ার্ডের মধ্যে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করেছেন। কোনো কারণ ছাড়াই অবশিষ্ট ওয়ার্ডগুলোর কমিটি ঘোষণা করেননি। এতে একদিকে যেমন নেতৃত্ব শূন্যতা দেখা দিয়েছে, অন্যদিকে বাড়ছে অসন্তোষ।
নেতাকর্মীদের অভিযোগ, উপজেলার বাঘাব ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি কাউছার আহমেদ ছিলেন বিএনপির সক্রিয় সদস্য। পুটিয়া ইউনিয়ন ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক বুলবুল সরকার দলে অনুপ্রবেশকারী। তিনি বিএনপির সক্রিয় কর্মী ছিলেন। মাছিমপুর ইউনিয়নে সম্মেলনের মাধ্যমে সভাপতি মনির মাস্টার ও সাধারণ সম্পাদক কলিম উদ্দিন ভূঁইয়া নির্বাচিত হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদককে বাদ দিয়ে রমিজ উদ্দিন নামে একজনের নাম ঘোষণা করা হয়। দুলালপুর ইউনিয়নে কাউন্সিলরদের মতামত ছাড়াই একতরফাভাবে কমিটি ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক শফিক যুবদলের নেতা। এ ছাড়া জয়নগর ইউনিয়নে সম্মেলনের মাধ্যমে নির্বাচিত কমিটি কোনো কারণ ছাড়াই ভেঙে দিয়ে অর্থের বিনিময়ে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। আইয়ুব ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয় ২০১৯ সালে। সেখানে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শুধু সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও সাধারণ সম্পাদক ও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়নি।
নৌকার বিরুদ্ধাচরণ
আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকা। ১৯৯৬ সাল থেকে দলের উপজেলা সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন হারুনুর রশীদ খান। অভিযোগ রয়েছে, তিনি ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দল মনোনীত প্রার্থী মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়ার নৌকা প্রতীকের বিরোধিতা করেছেন। ওই সময় তৎকালীন বিএনপির প্রার্থী আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার পক্ষে নির্বাচন করার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। যার কারণে ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছিল, পাশাপাশি তাঁকে দলের সাধারণ সদস্য পদ থেকেও বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। কিন্তু কয়েক বছর পর কেন্দ্রীয় একজন প্রভাবশালী নেতাকে ধরে আবারও সেই সভাপতি পদটি বাগিয়ে নেন। তবে নৌকার বিরোধিতা থেকে সরেননি; ২০০৮, ২০১৪ ও সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তিনি দল মনোনীত প্রার্থী জহিরুল হক ভূঞা মোহনের নৌকা প্রতীকের বিরোধিতা করেন। ২০০৮ সালে নৌকার প্রার্থীর পক্ষে কাজ না করে বিএনপির মান্নান ভূঁইয়ার পক্ষে কাজ করেন; আর ২০১৪ ও ২০১৮ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
অপসারণযোগ্য অপরাধে মন্ত্রণালয়ের শোকজ
অপসারণযোগ্য অপরাধে শিবপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ খানকে শোকজ করেছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। গত ২১ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপজেলা-২ শাখার উপসচিব মোহাম্মদ জহিরুল ইসলামের সই করা এক নোটিশে তাঁকে শোকজ করা হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবিরের (সাবেক) বিরুদ্ধে মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন ও উপজেলা পরিষদের আওতাধীন ২০২০-২১ অর্থবছরের এডিপির বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় না হওয়ার বিষয়ে তাঁকে শোকজটি করা হয়। ১০ কার্যদিবসের মধ্যে কারণ দর্শানোর জবাব দিতে নির্দেশনায় বলা হয়।
জলবায়ু পরিবর্তন: পৃথিবী রক্ষায় জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রীর পাঁচ দফা প্রস্তাব
শোকজের ওই চিঠিতে সুনির্দিষ্ট চারটি বিষয়ের ওপর কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। এগুলো হলো প্রচলিত বিধান লঙ্ঘন করে উপজেলা পরিষদের মাসিক সভার কার্যবিবরণী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পরিবর্তে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তার মাধ্যমে লিপিবদ্ধ করার জন্য উপজেলা পরিষদের মাসিক সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ, উপজেলা পরিষদের মাসিক সভার কার্যবিবরণী উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে নিজেই স্বাক্ষর করে প্রচলিত বিধি-বিধান লঙ্ঘন করে আবার নিজেই ওই কার্যবিবরণীর পৃষ্ঠাংকনকরণ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কর্তৃক পরিচালিত উপজেলা হাট-বাজার তহবিলসংক্রান্ত ব্যাংক হিসাবটি উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার যৌথ স্বাক্ষরে পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রোশে ভাড়া করা লোক দিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ‘জমি আছে ঘর নেই’ বিষয়ে অসত্য বক্তব্য পেশ করে সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করা হয়।
শিবপুরের উপজেলা চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ খান বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও অসত্য। আমাকে স্থানীয় সরকার থেকে যে শোকজ করা হয়েছে তার প্রতিটির জবাব আমি লিখিতভাবে দিয়ে দিয়েছি।’