একজন সত্যজিতের ‘নায়ক’, অপরজন সত্যজিতের পছন্দের অভিনেতা। উত্তম কুমার ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা বাঙালির আড্ডার রসদ হয়ে রয়েছে যুগের পর যুগ। থাকবেও। একটি মিথের মতো দুজনের আধিপত্য, এগিয়ে-পিছিয়ে থাকা নিয়ে গল্পগুলো থেকে যাবে দুই বাংলায়।
যদিও সৌমিত্র নিজে দাবি করে গেছেন উত্তম কুমারের ভক্ত তিনিও। সিনিয়র হিসেবে তাকে শ্রদ্ধা করেছেন। তার কাছ থেকে শিখেছেন। তবে মার্জিত ভাষায় নিজেকে উত্তম কুমারের থেকে আলাদাও করে গেছেন।
তিনি উত্তম কুমারকে নকল করেননি কোনোদিন। উত্তমকুমার হতেও চাননি। সেজন্যই উত্তমযুগেও সৌমিত্র তার নামকে সূর্যের মতোই উজ্জ্বল করতে পেরেছিলেন।
তর্ক-বিতর্কের বাইরে গিয়ে সৌমিত্রকে এগিয়ে রাখা যায় অনেক কিছুতেই। তিনি বহুমুখী। কবিতা, গল্প, চিত্রনাট্য, আবৃত্তি, ছবি আঁকাতেও তিনি অভিনয়ের মতোই পাকা। এতসব গুণ উত্তমকুমারের ছিলো তা জানা যায় না। তিনি অভিনয় দিয়েই দেবতার আসনে বসেছেন বাংলা সিনেমায়।
নতুন মিশনে নামছেন অভিনেত্রী পরীমনি
কাজ করার সুযোগের দিক থেকেও সৌমিত্রই এগিয়ে। বহু আগেই থেমে গেছেন উত্তম কুমার। আর গত ১৫ নভেম্বর সৌমিত্র থামলেন ৮৫ বছর বয়সে। আমৃত্যু কাজের সঙ্গে ছিলেন। শেষ বয়সে এসেও বাজিমাত করেছেন বেলাশেষে, প্রাক্তন, পোস্ত দিয়ে। আরও বেশি কিছু ভালো কাজের প্রস্তুতি চলছিলো। পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় বানাচ্ছিলেন তার বায়োপিক। তারও অভিনয় করার কথা ছিলো।
এতসব এগিয়ে থাকার ভিড়ে উত্তমের চেয়ে সৌমিত্র এগিয়ে রইলেন শেষযাত্রাতেও! এই সময় অনলাইনের এক ফিচারে এমনটাই দাবি করা হয়েছে। সেখানে লেখক অশোক বসু বলেন, ‘সৌমিত্র বাবুর শেষযাত্রার ছবি দেখে মহানায়ক উত্তম কুমারের শ্মশানযাত্রার দৃশ্যটা মনে পড়ে গেল। নিজের চোখে দেখা সেই দৃশ্য আজ মনকে খুবই ভারাক্রান্ত করে তুলল।
সৌমিত্র ত্রর শেষযাত্রায় দেখলাম মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তার মন্ত্রিসভার সতীর্থ মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং টলিউডের নানা ভূমিকার মানুষেরা হাঁটছেন। অনেক সাধারণ মানুষও হাঁটছেন দেখলাম। দেখে আরও ভালো লাগল, বাম দলের প্রথমসারির নেতারাও একই মিছিলে হাঁটলেন।
সৌমিত্রকে এতটুকু খাটো না করে, একটি বিষয়ে আলোকপাত করার প্রয়োজনে জানাচ্ছি, চার দশক আগে মহানায়কের শেষযাত্রায় মানুষের যোগদান এবং মহানায়কের শায়িত মুখটি এক ঝলক দেখার আকুতি অনেক বেশি ছিল। হয়তো তার কারণ, উত্তম কুমারের অনেক কম বয়সে, জনপ্রিয়তার শিখরে থাকাকালীন আচমকা চলে গিয়েছিলেন। এমন করোনা পরিস্থিতিও সেদিন ছিল না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উত্তমকু মারের শেষযাত্রা এবং অন্ত্যেষ্টিতেও লোকের ঢল নেমেছিলো। কিন্তু যা ছিল না তা হল সরকারি ব্যবস্থাপনা। মহানায়কের প্রতি দৃশ্যত উপেক্ষাই বরাদ্দ করেছিল তৎকালীন লালবাড়ি রাইটার্স বিল্ডিংস। এখনকার মতো তখনও বিশিষ্ট মানুষেরা মারা গেলে রবীন্দ্র সদনে দেহ রাখা হত যাতে সাধারণ লোকজন শেষ শ্রদ্ধা জানাতে পারেন।
কিন্তু উত্তম কুমারের দেহ সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়নি। খবরের কাগজে, পরে টলিউডের নানা জনের মুখেও শুনেছি, তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের আপত্তি ছিল। আপত্তির কারণ ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক। উত্তম কুমারের জনপ্রিয়তা, তার অভিনয় প্রতিভা কিছুই বিচার্য হয়নি শেষযাত্রায়।
সৌমিত্র র শেষযাত্রা সে দিক থেকে ভিন্ন মাত্রা পেল। একজন মহান শিল্পীর যে সম্মান, মর্যাদা প্রাপ্য তার সবটুকু আয়োজনই ছিল। শুনলাম, কেওড়াতলা শ্মশানঘাট সরকারি ব্যবস্থাপনায় সাজানো হয়েছিল। নবান্নের কর্তারা যাবতীয় উদ্যোগ আয়োজন করেছেন। অন্ত্যেষ্টির সময় মুখ্যমন্ত্রী সারাক্ষণ উপস্থিত ছিলেন।
উত্তম কুমার মারা যাওয়ার পর শুনেছিলাম, তার প্রতি বামফ্রন্ট সরকারের অমন আচরণের কারণ ছিল তিনি সরাসরি রাজনীতি না করলেও দক্ষিণপন্থীদের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। কংগ্রেসের নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল।’