কর্ণফুলী ভরাট ও দখলের জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী শাহ আমানত ব্রিজে ৮৬৬ মিটার প্রস্থের কর্ণফুলী এখন ৪১০ মিটার। বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্ণফুলী খনন না করায় চাক্তাই, রাজাখালী খালের মোহনা ভরাট হয়ে গেছে। যে কারণে চাক্তাই থেকে বহদ্দার হাট মোড় পর্যন্ত জলাবদ্ধতা বেড়ে গেছে। ট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন সোমবার (২১ সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরে।
জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, শাহ আমানত ব্রিজ এলাকায় কর্ণফুলীর প্রস্থ ৪১০ ফুট হওয়ায় ধসে পড়তে পারে সেতুর দক্ষিণ প্রান্ত । কর্ণফুলী রক্ষায় মহাপরিকল্পনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ১ লাখ ৭৩ হাজার ২৬৩ বর্গফুট নদী মৎস্য সমিতিকে লিজ দিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। মাস্টারপ্ল্যান বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করে বন্দর ধ্বংস করছে কর্ণফুলী নদী।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কর্ণফুলী নদীর বন্দর শাসিত এলাকা হালদা মোহনা থেকে কর্ণফুলী মোহনা পর্যন্ত ১০ মাইল কর্ণফুলী রক্ষায় ২০১৪ সালে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ‘স্ট্রাটেজিক মাস্টার প্ল্যান ফর চিটাগাং পোর্ট’ শীর্ষক একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। বিএস জরিপ অনুযায়ী কর্ণফুলী নদীর প্রস্থ ঠিক রেখেই সেই পরিকল্পনা করা হয়। বন্দরের স্বাভাবিক গতিশীলতা ও কর্ণফুলীর নাব্যতা রক্ষায় এ প্রকল্প বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষ এই প্রকল্পকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজেদের খেয়াল খুশি মতো নদী লিজ দিয়ে কর্ণফুলীর সর্বনাশ করেছে।
বন্দর কর্তৃক নিজেদের ব্যবহৃত অংশে কর্ণফুলী নদী খনন, শাসন ও উভয়তীরে সীমানা প্রাচীর না দেওয়ায় কর্ণফুলী স্বাভাবিক গতি প্রবাহ ধ্বংস হয়েছে।
২১ দিন চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন কর্ণফুলী নদীর শাহ আমানত ব্রিজ থেকে ফিরিঙ্গিবাজার মনোহরখালী পর্যন্ত কর্ণফুলীর প্রস্থ জরিপ করেছে চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন। উক্ত জরিপে কর্ণফুলীর দখল ও ভরাট হওয়ায় ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে।
আরও পড়ুন ঃগাইবান্ধায় যৌতুক মামলায় এক পুলিশ সদস্য কারাগারে
জরীপে দেখা যায়, কর্ণফুলী ব্রিজ নির্মাণের সময় এডিবি মাস্টার প্ল্যান ও বিএস সিট অনুযায়ী কর্ণফুলী দৈর্ঘ্য ছিল ৮৮৬ দশমিক ১৬ মিটার। শাহ আমানত ব্রিজের নিচে বর্তমানে কর্ণফুলী নদী ভাটার সময় প্রস্থ মাত্র ৪১০ মিটার। জোয়ারের সময় চর অতিক্রম করে ৫১০ মিটার পর্যন্ত জোয়ারের পানি আসে।
ভরাট হয়ে যাওয়ায় সেই অংশে কোনো নৌযান চলাচল করে না। নদী ভরাট হওয়ায় শাহ আমানত সেতুর মাঝ পিলারের পাশে অঘোষিত একটি যাত্রী পারাপার ঘাট তৈরি করেছেন স্থানীয়রা। জোয়ার ভাটার সময় লিংক রোড থেকে অর্ধ কিলোমিটার নদীর অংশ পায়ে হেঁটে যাত্রীরা ব্রিজের নিচে কর্ণফুলী নদীর মাঝখানে এসে সাম্পানে উঠে।
চাক্তাই খালের মুখে এসে বিএস সিট ও এডিপি মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী নদীর প্রস্থ ৯৮২ মিটার। বাস্তবে ৫১০ মিটার নদী রয়েছে। এর পর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্মিত মেরিনার্স পার্ক এলাকায় কর্ণফুলীর প্রস্থ ৯৮১ মিটার। বন্দর কর্তৃপক্ষ বর্তমানে সেই অংশে খনন করেছে। খননের পর নদীর প্রস্থ দাঁড়িয়েছে মাত্র ৮৫০ মিটার। এরপর ফিরিঙ্গি বাজার মোড়ে কর্ণফুলী নদীর প্রস্থ ৯০৪ মিটার। বর্তমানে বন্দর খনন করার পর সেখানে নদী আছে ৭৫০ মিটার। বাকি অংশ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ গাইড ওয়াল নির্মাণ করে চিরতরে বিলুপ্ত করে দিয়েছে।
জরিপে দেখা যায়, কর্ণফুলী ব্রিজের উত্তর অংশে ৪৭৬ মিটার কর্ণফুলী নদী ভরাট হওয়ায় জোয়ার ভাটার সময় সেখানে ব্যাপক নদীর স্রোত হয়। স্রোতের এ তীব্রতার চাপ কর্ণফুলীর দক্ষিণ প্রান্তে শাহ আমানত ব্রিজের সংযোগ সড়কের বর্ধিত অংশ ও দুই পিলারে পড়ছে। যা শাহ আমানত সেতুর জন্য বিপজ্জনক। বন্যা বা সাইক্লোন হলে শাহ আমানত ব্রিজের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জরিপে প্রতিফলিত হয়, কর্ণফুলী ব্রিজের পশ্চিম পাশে রাজখালী খালের পাশে বেড়ামার্কেট বস্তি, রাজাখালী ও চাক্তাই খালের সংযোগস্থলে সোনালি মৎস্য আড়ৎ, চাক্তাই খালের পশ্চিম পাড় থেকে ফিরিঙ্গিবাজার পর্যন্ত মেরিন ফিশারিজ পার্ক সম্পূর্ণ কর্ণফুলী দখল করে গড়ে উঠেছে। এডিবি মাস্টার প্ল্যানে এই সব মার্কেটের অস্তিত্ব নেই। সেখানে নদী দেখানো হয়েছে। বন্দরের স্বাভাবিক গতি প্রবাহ, কর্ণফুলী ব্রিজ রক্ষা ও চাক্তাই খাতুনগঞ্জসহ নগরের বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়মিত প্লাবন থেকে রক্ষা করতে এবং কর্ণফুলীর স্বাভাবিক গতি প্রবাহ রক্ষা করতে এসব স্থাপনা উচ্ছেদ করে মেরিন সড়ককে কর্ণফুলীর তীর ধরে তা গাইড ওয়াল তৈরি করা জরুরি।
আরও পড়ুন ঃদীনেশ কার্তিকের বদলে ইয়ন মরগ্যান হবেন কলকাতার অধিনায়ক!
লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আলীউর রহমান। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সভাপতি, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় ভারপ্রাপ্ত প্রো ভিসি অধ্যাপক ইঞ্জিনিয়ার আলী আশরাফ, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হালদা গবেষক মনজুরুল কিবরীয়া, কর্ণফুলী গবেষক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী, জাইকা ও ডিএফআইডের সাবেক পরিবেশ কনসালটেন্ট অধ্যাপক নোমান আহমাদ সিদ্দিকী, চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক প্রদীপ কুমার দাশ, সদস্য অধ্যাপক মনোজ কুমার দেব প্রমুখ।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদারের বক্তব্য উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রাম বন্দর নদীর ভূমি ভোগদখল করতে পারবে, কিন্তু তারা অন্য কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দিতে পারে না। আমরা সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে কর্ণফুলী নদী দখল করে স্থাপনা নির্মাণের বিষয়টি দেখেছি। কোথাও মাটি কিংবা বালু দিয়ে নদী ভরাট করা হয়েছে।
নদী ভরাট দখল করা, প্রাকৃতিক জলাধার আইন, ২০০০/এসএটিএ ১৯৫০, পানি আইন ও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন, ২০১৩ অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ।
নদীর জমির মালিক নদী নিজেই। সেই জমি কাউকে আপনি দিতে পারবেন না। কর্ণফুলী নদী দখল করে নদীর পানিপ্রবাহ নষ্ট করা হয়েছে। এভাবে দেশে নদী দখল করে পানিপ্রবাহে বাধা তৈরি করলে ২০৫০ সালে মানুষ পানির জন্য হাহাকার করবে। সেজন্য কর্ণফুলী রক্ষায় আমরা কিছু সুপারিশ করেছি। সুপারিশ অনুযায়ী কর্ণফুলী নদী দখলকারীদের তালিকা তৈরি করাসহ সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে চট্টগ্রাম বন্দরকেই এগিয়ে আসতে হবে। জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে কর্ণফুলী রক্ষায় কর্ণফুলী মেরিনার্স পার্ক, মৎস্য সমিতির লিজ বাতিল ও উচ্ছেদ, বেড়া মার্কেট ও অন্যান্য অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে। মেরিন ড্রাইভ সড়ককে তীর হিসেবে চিহ্নিত করে নদীর পাড়ে স্থায়ী গাইড ওয়াল তৈরি করতে হবে। কালুরঘাট থেকে বন্দর মোহনা পর্যন্ত স্টাডির মাধ্যমে নদীর প্রবাহ ও নৌ-চলাচলের পথকে স্থিতিশীল করার জন্য প্রয়োজনীয় সব নদী শাসনের কাজ সম্পূর্ণ করতে হবে।