খিলক্ষেতের ঘটনায় ৫ হাজার জনকে আসামি করে মামলা দায়ার
আস্থা ডেস্কঃ
রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) রাতে ধর্ষণের অভিযোগে আটক কিশোরকে ছিনিয়ে নিয়ে গণপিটুনি ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
খিলক্ষেত মধ্যপাড়ার ছয় বছরের একটি শিশুকে ধর্ষণের ঘটনায় রবিউল ইসলাম ওরফে জান মিয়াকে (১৬) আসামি করে খিলক্ষেত থানায় একটি মামলা দায়ের করেছে শিশুটির পরিবার।
অপরদিকে অভিযুক্ত রবিউল ইসলামকে পুলিশ হেফাজত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গণপিটুনি ও পুলিশের ওপর হামলা এবং গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় দুজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত পাঁচ হাজার জনকে আসামি করে আরেকটি মামলা দায়ের করেছে খিলক্ষেত থানা পুলিশ।
এ ঘটনায় মোবারক হোসেন সজীব (১৮) ও ইউসুফ (১৮) নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
বুধবার (১৯ মার্চ) খিলক্ষেত থানায় পৃথক দুটি মামলা দায়ের করা হয়। এর আগে মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) রাত সাড়ে ১০টার দিকে খিলক্ষেত বাজার এলাকায় পুলিশ হেফাজত থেকে ধর্ষণের অভিযুক্ত কিশোরকে ছিনিয়ে নিয়ে গণপিটুনি ও পুলিশের ওপর হামলা ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনার কয়েকটি ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এসব ফুটেজ দেখে মব সৃষ্টিকারীদের খুঁজে বের করা হচ্ছে হলে জানিয়েছে পুলিশ।
এছাড়া ছয় বছরের শিশু ধর্ষণের অভিযোগে শিশুটির বাবা বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। মামলায় অভিযুক্ত ওই কিশোর রবিউল ইসলাম ওরফে জান মিয়া (১৬) ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। ভুক্তভোগী শিশুটির নমুনা সংগ্রহের পর প্রাথমিকভাবে নির্যাতনের আলামত পাওয়ার কথা জানিয়েছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের চিকিৎসকরা।
মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, মঙ্গলবার দুপুরে খিলক্ষেত দক্ষিণ মধ্যপাড়া এলাকায় অভিযুক্ত রবিউল ইসলাম ওরফে জান মিয়া (১৬) তাদের বাসায় কেক চকলেটের প্রলোভন দেখিয়ে শিশুটিকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। এসময় শিশুটি কান্নাকাটি শুরু করলে তাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে রুম থেকে বের করে দেয় জান মিয়া। শিশুটিকে চিকিৎসার জন্য ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে যান তার স্বজনরা।
পুলিশ বলছে, শিশু ধর্ষণের ঘটনার পর আলম ও খলিল নামে স্থানীয় প্রভাবশালী দুই ব্যক্তি অভিযুক্ত কিশোরের পরিবারের ওপর চড়াও হয়। বিকালে এ ঘটনার সমাধান বা বিচারের কথা বলে কিশোরকে আটকে রাখা হয়। এরপর রাত সাড়ে ৯টার দিকে খবর পেয়ে কিশোরকে আটক করে পুলিশ। তাকে নিয়ে থানার আসার পথে খিলক্ষেত এলাকায় হামলার ঘটনা ঘটে।
আটক কিশোরকে ছিনিয়ে নিয়ে গণপিটুনি ও পুলিশের ওপর হামলা ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়ে, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ধর্ষণের অভিযোগে আটক কিশোরকে নিয়ে থানায় ফেরার সময় খিলক্ষেত বাজারে (মান্নান প্লাজা সংলগ্ন চৌরাস্তা মোড়) আগে থেকে ওত পেতে থাকা দুই-তিন হাজার বিক্ষুব্ধ জনতা পুলিশের গাড়ি আটকে দেয়।
তারা পুলিশের টহল গাড়ি ভাঙচুর করে এবং আটক কিশোরকে ছিনিয়ে নিয়ে এলোপাতাড়ি পিটুনি দেয়। সৃষ্ট মব থামাতে গেলে কয়েক হাজার বিক্ষুব্ধ জনতা পুলিশ সদস্যদের ওপর লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা, ইটপাটকেল নিক্ষেপসহ মারধর করে।
এতে থানার ওসি, পরিদর্শক (তদন্ত) এবং চার জন এসআই ও দুই জন কনস্টেবল গুরুতর আহত হন। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য গিয়ে অভিযুক্ত কিশোর ও পুলিশ সদস্যদের আহত অবস্থায় উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য অভিযুক্ত কিশোরকে ঢামেক হাসপাতালে পাঠানো হয়।
পুলিশ বলছে, মব সৃষ্টি করে আটক কিশোরকে গণপিটুনি ও পুলিশের ওপর হামলা ঘটনায় রাতে ঘটনাস্থল থেকে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরপর এ ঘটনায় জড়িত অন্যদের শনাক্ত করতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সহযোগিতা নিয়ে আসামিদের শনাক্ত করা হয়েছে। এছাড়া এই বিশৃঙ্খলার নেপথ্যে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অংশ নেওয়ার অভিযোগও তদন্ত করা হচ্ছে।
এদিকে মব সৃষ্টির পেছনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে দাবি করেছেন স্থানীয় বিএনপি ও ছাত্রদলের একাধিক নেতাকর্মী। তাদের মধ্যে ঢাকা মহানগর উত্তর শ্রমিক দলের কর্মী দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি ঘটনার সময় খিলক্ষেত বাজারেই ছিলাম। পুলিশের গাড়িতে ধর্ষণের আসামি ছিল। শুরুতে কয়েকজন তাকে মারতে এগিয়ে আসেন। বিক্ষুব্ধ জনতার সঙ্গে আওয়ামী লীগের কর্মীরাও ছিল। তারা স্থানীয় আওয়ামী লীগের চিহ্নিত কর্মী। তারা মব তৈরি কিংবা পুলিশের ওপর হামলা করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার কাজে লিপ্ত।’
এ ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিও ক্লিপে এক ব্যক্তিকে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলতে শোনা যায়, খিলক্ষেতের ভেতরে যাতে এরকম ঘটনা আর না হয়..। পরে জানা যায়, ওই ব্যক্তি নাম ইউসুফ। পুলিশের হেফাজত থেকে আটক কিশোরকে ছিনিয়ে নেওয়া ও পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ রিয়াজুল হক বলেন, খিলক্ষেতে ধর্ষণের অভিযোগে আটক যুবককে ছিনিয়ে নিয়ে গণপিটুনি ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আইন অনুযায়ী যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। মব জাস্টিসের নামে আইন হাতে তুলে নেওয়ার সুযোগ নেই। যুবককে মারধরে জড়িতদের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে শনাক্ত করা হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনা আগেই দিয়েছে।
ধর্ষণের শিকার শিশুটির নানি জানান, ওই শিশুর বাবা পিকআপ-চালক, আর মা একটি এনজিওতে চাকরি করেন। এ জন্য শিশুটি দিনের বেলায় তার কাছেই থাকে। পাশের বাসার ওই কিশোর তাকে ধর্ষণ করেছে। এ ঘটনায় কিশোরের উপযুক্ত বিচার দাবি করেন তিনি।
মব তৈরি প্রসঙ্গে শিশুটির নানি বলেন, লোকলজ্জার ভয়ে ঘটনাটি কাউকে জানানোর ইচ্ছে ছিল না আমাদের। স্থানীয় দুটি হাসপাতালে নেওয়ার পর ধর্ষণের ঘটনা শুনে তারা ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে যেতে বলেন। সেখানে নেওয়ার সময়ই লোকজন জেনে যায়। এরপর কিশোরকে আটক ও তাকে নিয়ে যাওয়ার পথে মারধরের খবর পাই। আমরা তখন জানতামই না এমন ঘটনা ঘটছে।
এদিকে ধর্ষণের শিকার ছয় বছরের শিশুটির ফরেনসিক সম্পন্ন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢামেক হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) সমন্বয়ক ডা. সাবিনা ইয়াসমিন। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে নির্যাতনের আলামত পাওয়া গেছে। তাকে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
পুলিশের পাহারায় ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অভিযুক্ত রবিউল ইসলামের মাথা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর জখম রয়েছে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন ঢামেক হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার ডা. শিশির কুমার ঘোষ।
এদিকে কিশোরের পরিবার অভিযোগ করেছে, তাকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে না।