সম্পাদকীয়:ভয়ঙ্কর এক দুঃস্বপ্নের বছর পার করল পৃথিবীর মানুষ। এমন বিধ্বংসী বছর আগে আর কোনোদিন এই গ্রহে আসেনি। বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ নামের যে প্রাণী সভ্যতার ক্রমবিকাশ ঘটিয়েছে সমাজ সৃষ্টি করে, ২০২০ মানুষের সেই সভ্যতাকেই বিলীন করে দিয়েছে। সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি করে পুরো পৃথিবীটাকেই স্তব্ধ করে দিয়েছে। মানুষখেকো করোনা ভাইরাস পরিচয় করিয়ে দিয়েছে- লকডাউন, আইসোলেশনের মতো চরম বাস্তব কয়েকটি শব্দের সঙ্গে। যা কোনোভাবেই এই গ্রহের সভ্যতার সাথে যুৎসই ছিল না।
অথচ ভীষণ এক সুন্দর রূপে প্রবেশ করেছিল ২০২০। ছন্দময় এই বছরটি নিয়ে কতশত স্বপ্ন বুনেছিল মানুষ। যে ছন্দের কারণে বছরটিকে টুয়েন্টি টুয়েন্টি ভিশন হিসেবেই দেখেছিল সবাই। কিন্তু দু’মাস পরই সব বিষাদে রূপ নিল। ভয়ঙ্কর দানবের বেশে পৃথিবীতে হানা দিল অদৃশ্য এক অনুজীব। তছনছ করে দিল যাবতীয় স্বাভাবিকতা। চোখের সামনে কতশত প্রিয়জনকে গিলে খেল ঘাতক ভাইরাস।
২০২০ বছরটিকে অভিশপ্ত বছর হিসেবেই গণ্য করা যেতে পারে। সবচেয়ে দুঃখের কথা, শুধু যে প্রিয় মানুষেরা মারা গেছেন তা নয়, তাদের মৃত্যুর পর আমরা যে তাদের জন্য আমাদের ভালোবাসাটুকু দেখাবার সুযোগ হয়নি। ভাইরাসের কারণে অনেক সাধারণ রোগীও মৃত্যুবরণ করেছেন বিনা চিকিৎসায়। তাদের অনেকেই হয়তো সরাসরি করোনা ভাইরাসে মারা যাননি, কিন্তু করোনার কারণে ঠিকভাবে চিকিৎসা নিতে না পেরে তারা মারা গেছেন, দায়টুকু ঘুরে ফিরে করোনাকেই নিতে হবে। পুরো বছরই ছিল করোনাময়। মার্চ-এপ্রিলের দিকে প্রথমবার যে ভয়ানক হামলা করেছিল, সেই হামলা সামলে নিঃশ্বাস ফেলার আগেই দ্বিতীয় হামলা করল বছরের শেষ সময়েও।
২. তবে আশার কথা করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় বাংলাদেশ সাহস দেখিয়েছে। পৃথিবীর তাবৎ উন্নত দেশ যেখানে ব্যর্থ, কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে আমাদের সাফল্য সেখানে ঈর্ষণীয়। সবচেয়ে বড় সাফল্য-এই কঠিন বছরেও বাংলাদেশ এক সুঠাম অর্থনৈতিক প্লাটফর্ম তৈরিতে সক্ষম হয়েছে। করোনা ভাইরাসের কারণে সব খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ইতিবাচক।
বিগত ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। স্থির মূল্যে এই জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ২৭ লাখ ৯৬ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। আর মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়ে ২ হাজার ৬৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রাথমিক এই তথ্য প্রকাশ করেছে।
‘কৃষি খাত, কল-কারখানায় শ্রমিকদের কাজে ফেরা, সঠিক পথে রেমিট্যান্সের পাঠানো অব্যাহত ছিল বলে প্রবৃদ্ধি হার ইতিবাচক ছিল’ ভাবা যায়? মাথাপিছু আয়ে ভারতকেও টপকে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সবচেয়ে বড় সুখবর- স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটেছে বাংলাদেশের।
৩. একইসাথে শূন্যতা এবং পূর্ণতার হিসেব-নিকেশের অদ্ভুত একটি বছর শেষে শুরু হল ২০২১। একুশ সংখ্যাটি বাঙালির জীবনে এক বিশেষ তাৎপর্যের। ১৯৫২ সালে তাজা রক্তে যে ইতিহাস রচিত হয়েছিল- ২০২১ সালে এসে তা অনেকভাবেই পূর্ণতা পাচ্ছে। অদ্ভুত এবং অবিশ্বাস্যভাবে মিলে যাচ্ছে সব। বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সংখ্যাটি ঘিরেই ‘ভিশন ২১’ স্বপ্ন বুনেছিলেন। অবাক বিস্ময়, যার অনেকটাই আজ সত্যি।
চোখের সামনে দৃশ্যমান পদ্মা সেতু যার বাস্তবতা। ২১-কে ঘিরে যে স্বপ্ন দেখেছিল বাংলাদেশ- সেই পথ থেকে বিচ্যুত হয়নি। পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। বাংলাদেশের বিস্ময়কর এক উত্থান দেখছে সবাই। সবচেয়ে অদ্ভুত তথ্য- স্বাধীনতার ৫০তম এ বছরটির প্রতিটি দিন মিলে গেছে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি দিন ও বারের সঙ্গে।
ক্যালেন্ডার বলছে, ১৯৭১ সালের ১ জানুয়ারি ছিল শুক্রবার আর ২০২১ সালের বছরের প্রথম দিনটিও শুক্রবার হবে। বছরের শেষ দিনও পড়েছে শুক্রবারের ঘরে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরও ছিল শুক্রবার। শুধু প্রথম কিংবা শেষ দিন নয়, বছরের প্রতিটি দিনের তারিখ ও বারের মধ্যে হুবহু মিল দেখা গেছে।
অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ যে বার ছিল, ঘুরেফিরে এ বছর ২৬ মার্চেও সেই একই বার দেখবে বাংলাদেশিরা। তবে কি প্রতি ৫০ বছরে একবার করে হুবহু মিলে যায় বার-তারিখ? তা নয়, কেননা ১৯৭১ ও ২০২১ সালের ভেতর এ ৫০ বছরেই ১৯৮২, ১৯৯৩, ১৯৯৯ ও ২০১০ সালসহ মোট ৪ বার দেখা গেছে একই তারিখ।
এর নেপথ্যে গাণিতিক যুক্তিও রয়েছে। পৃথক বছরের দিন বা বারের মধ্যে হুবহু মিল থাকলেও তাকে বলা হয় আইডেন্টিক্যাল ক্যালেন্ডার ইয়ারস বা যমজ দিনপঞ্জির বছর। শুধু নির্দিষ্ট কোনো বছর নয়, যে কোনো বছরের জন্য এমন অনেক যমজ বছর সম্ভব। স্রেফ গাণিতিক নিয়মেই এমনটা ঘটে। অন্যভাবে বলা যায়, গ্রেগরীয় বা খ্রিস্টীয় বর্ষপঞ্জির যে কোনো বছরের প্রথম দিন (১ জানুয়ারি) স্বাভাবিকভাবে সপ্তাহের নির্দিষ্ট সাতটি দিনের (রবি-শনি) একটি দিনে হবে। আর বছরটি হয় ৩৬৫ দিনের সাধারণ বছর হবে, অথবা ৩৬৬ দিনের লিপ ইয়ার বা অধিবর্ষ।
সাধারণ বছর সাতটি দিনের একেক দিনে শুরু হলে সাতটি সম্ভাব্য দিনপঞ্জি পাওয়া যাবে। আবার অধিবর্ষের ক্ষেত্রেও একইভাবে আরো সাতটি সম্ভাব্য দিনপঞ্জি পাওয়া যাবে। এভাবে দুই ধরনের বছরে মোট ১৪টি সম্ভাব্য দিনপঞ্জি আছে। যে কোনো বছরের দিনপঞ্জি এই ১৪টি দিনপঞ্জির যে কোনো একটির সঙ্গে হুবহু মিলে যাবে।
ক্যালেন্ডারের পাতায় যেভাবে একাত্তর ফিরেছে। বাঙালির চেতনায়ও ২০২১ ফিরবে সেই সাহস নিয়েই। দুঃসময় ভুলে মানুষ আবার ঘুরে দাঁড়াবে। দুষ্কাল গিয়ে আবার রঙিন হয়ে উঠবে পৃথিবী। আজ ২১ সালের প্রথম সূর্য সেই বার্তা নিয়ে আসুক করোনায় ব্যথিত এই গ্রহে।
দৈনিক মানবকণ্ঠের অগণিত পাঠক, বিজ্ঞাপনদাতা, হকার, এজেন্ট ও শুভানুধ্যায়ী- সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা।