জামায়াতে এটিএম আজহারের গুরুত্ব কেন বেশি?
মোফাজ্জল হোসেন ইলিয়াছঃ
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সরকার গঠনের পর জামায়াতে ইসলামীর ১১ জন শীর্ষ নেতাকে ফাঁসি দেয় আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
জামায়াতে ইসলামীর যেসব শীর্ষ নেতাকে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী মনে করতেন মূলত তাদেরকেই সাজানো ও পাতানো ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। তাদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নেতা হচ্ছেন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম।
হাসিনা ক্ষমতায় থাকতে শীর্ষ এই জামায়াত নেতার ফাঁসির চূড়ান্ত্র রায় দেয়া হলেও তার সরকার তা কার্যকর করে যেতে পারেনি। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ফলে এই ন্যায়বিচার পাওয়ার সৌভাগ্য পেলেন তিনি।
এটিএম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ খারিজ করে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ তাকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদণ্ডের রায় বাতিল করে সর্ব্বোচ আদালত এ রায় দেন।
এই রায়ের পর আইনজীবী শিশির মনির বলেন, এটি কেবল একজন ব্যক্তির ন্যায়বিচার পাওয়া নয়—এটি একটি সময়কালব্যাপী ‘সিন্ডিকেটেড ইনজাস্টিস’-এর অবসান। আজহারুল ইসলাম এখন থেকে একজন নির্দোষ ব্যক্তি। সুপ্রিম কোর্ট সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, মিথ্যার পতন ঘটিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, অতীতে জামায়াত ও বিএনপির ছয়জন শীর্ষ নেতা মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে প্রাণ হারিয়েছেন, এবং কমপক্ষে পাঁচজন জেলে মারা গেছে, যা ইতিহাসে নজিরবিহীন একটি নির্যাতনের চিত্র। আজহারুল ইসলাম সৌভাগ্যবান, কারণ তিনি বেঁচে ছিলেন এবং ন্যায়বিচার পেয়েছেন।
এটিএম আজহারুল ইসলামের পুরো নাম আবু তোরাব মোহাম্মদ আজহারুল ইসলাম। বাবার নাম ডাঃ নাজির হোসেন আহমেদ। তিনি রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলার বাতাসিওন গ্রামে ১৯৫২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইতিহাসে এম এ পাশ করেন। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ছিলেন তিনি। একারণে ছাত্রশিবিরের মধ্যে তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও প্রভাব রয়েছে বলে মনে করা হয়।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের সাবেক জৈষ্ঠ্য নেতাদের মধ্যে একমাত্র এটিএম আজহারই বেঁচে রয়েছেন। ফলে তাকে নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ ও উচ্ছ্বাস দেখা গেছে জামায়াত শিবিরের মধ্যে। মেধাবী, পরিচ্ছন্ন ভাবমর্যাদা, অসাধারণ ও ত্যাগী নেতৃত্বের জন্য দলের ভেতরে তুলনামূলক জনপ্রিয়তা উপভোগ করছেন তিনি।
আপিল বিভাগ থেকে বেকসুর খালাস পাওয়ার পর জামায়াতের আসন্ন আমির নির্বাচনকে সামনে রেখে জৈষ্ঠ্য এই নেতাকে নিয়ে দলটির ভেতরে নতুন সমীকরণ শুরু হয়েছে। তাকে নিয়ে নতুন করে আশাবাদি ও আত্মবিশ্বাসী মনোভাব প্রকাশ করতে দেখা গেছে দলটির নেতাকর্মীদের। জামায়াতের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনে এটিএম আজহারের অবস্থান কোথায় হবে তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে। দলটির অনেকে তাকে আমির হিসেবে দেখতে চান। আবার কেউ কেউ চান, আমির নির্বাচিত না হলেও দলটির নিয়ন্ত্রণ যেন জৈষ্ঠ্য এই নেতার হাতেই থাকে।
এটিএম আজহারের খালাসের পর ঢাবি শিবির সভাপতি ফরহাদ বলেন, এটিএম আজহার বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন। তিনি দৈনিক সংগ্রামের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া, তিনি একাধারে মারুফ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান, রংপুরের আল-আমিন ট্রাস্টের ভাইস চেয়ারম্যান, তামিরুল মিল্লাত ট্রাস্টের সদস্য, বদরগঞ্জ উন্নয়ন সমিতির চেয়ারম্যান, বদরগঞ্জ ইসলামী পাঠাগার ও সমাজকল্যাণ সমিতির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
উল্লেখ্য, একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১২ সালের ২২ অগাস্ট মগবাজারের বাসা থেকে আজহারুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়। ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে রংপুরে সংঘটিত গণহত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ, নির্যাতনসহ ছয়টি মানবতাবিরোধী অপরাধে তাকে মৃত্যুদণ্ড ও বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন।
সে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। পরবর্তীতে ২০২০ সালের ১৯ জুলাই তিনি রিভিউ আবেদন করেন, যেখানে ১৪টি যুক্তি তুলে ধরা হয়।
চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ তার আপিল শুনানির অনুমতি দেন। এরপর নিয়মিত আপিলের শুনানি শেষে আজ রায় দেন আদালত, যেখানে তাকে অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া হয়। রায়ের মধ্য দিয়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে দীর্ঘ এক দশকের বেশি সময় ধরে চলা মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার বিচারিক প্রক্রিয়ার অবসান হয়।