দিল্লির মিডিয়ায় গুজবের ডালপালা আসল সত্য কি?
স্টাফ রিপোর্টারঃ
পঁচাত্তরের পুনরাবৃত্তি এই চব্বিশেও। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর পরই শেখ হাসিনা সপরিবারে ভারতের নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থান করে। তারপর দীর্ঘ মেয়াদে তিনি ভারতের রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে থেকে গিয়েছিলেন।
এবারো ঠিক তাই হয়েছে। ভারতের নীতিনির্ধারকরা হাসিনাকে নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য পর্যন্ত করছেন না প্রকাশ্যে। তবে শেখ হাসিনাকে যে রাষ্ট্রীয় অতিথি করে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় কোনো সেফ হাউসে রাখা হয়েছে তা সরকারি বিভিন্ন সূত্রে নিশ্চিত করা হয়েছে।
অবশ্য শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা ও একজন সামরিক উপদেষ্টাসহ ভারতে আসার পর থেকে তিন মাস হতে চললো, কিন্তু তাদের কোনো খবরই জানা যাচ্ছে না। তবে মিডিয়াতে নানা গুজব পাখা মেলেছে সরকারি স্তরে নিশ্চুপ থাকার সুযোগে।
কখনো তাকে দিল্লির লোদী গার্ডেনে হাঁটতে দেখা গেছে, কখনো মলে শপিং করতে দেখা গেছে বলে নানা ধরনের খবর প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু কোনো খবরের সত্যতা কেউ নিশ্চিত করতে পারেননি। বরং সাবেক কূটনীতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, হাসিনাকে এইভাবে প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করতে দেয়ার প্রশ্নই নেই।
হাসিনার ব্যাপারে ভারত সরকার এই ধরনের কোনো ঝুঁকিই নেবে না। তাছাড়া নিরাপত্তার স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী, নিরাপত্তা কর্মকর্তারা তাকে প্রথমেই ব্রিফিং করেছেন কী করা উচিত, কী করা উচিত নয়। সবই আসলে গুজব। গুজবের শেষ নেই।
হাসিনা নাকি ভারত সরকারের কাছ থেকে ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট পেয়েছেন এবং সেই ডকুমেন্টের সাহায্যে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলেও মিডিয়ায় খবর বেরিয়েছে। সেই খবরের কোনো সত্যতা বহু চেষ্টা করেও জানা যায়নি। তাহলে হাসিনা ও তার বোন উবে গেলেন কোথায়?
গত ৫ই আগস্ট বাংলাদেশে গণবিক্ষোভ ও বিদ্রোহের মুখে শেখ হাসিনা ভারতে চলে গেছেন-এটা গোটা বিশ্ব জানে। বাংলাদেশের বিমান বাহীনির বিমানে হাসিনা নেমেছিলেন ভারতের উত্তর প্রদেশের গাজিয়াবাদের হিন্দনে ঘাঁটিতে।
ভারতে পা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল হাসিনাকে প্রকারান্তরে স্বাগত জানিয়েছেন। তাদের মধ্যে কথোপকথনও হয়েছে। তারপর থেকে তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তারা।
তবে হাসিনা ও তার বোন রেহেনা কোথায় আছেন তা নিয়ে রহস্য তৈরি হয়েছে। প্রথমে হিন্দন সেনাঘাঁটির সেনাবাহিনীর অতিথি নিবাসে কয়েকদিন থাকলেও তাকে পরবর্তী সময়ে সরিয়ে নেয়া হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে। তাহলে কি দিল্লিতেই কোনো সেফ হাউসে তাকে রাখা হয়েছে? ভারতের কোনো প্রতিনিধি এ ব্যাপারে কিছুই জানাননি।
একমাত্র ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে গত ১৭ই অক্টোবর বলেছেন, হাসিনাকে খুব অল্প সময়ের নোটিশে চলে আসতে হয়েছিল নিরাপত্তার কারণে। তিনি সেভাবেই ভারতে অবস্থান করছেন বলেও তিনি নিশ্চিত করেছেন।
তবে হাসিনা ভারতে আসার আগে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছিলেন কিনা তা নিয়ে ভারতেও জোর চর্চা শুরু হয়েছে দৈনিক মানবজমিন-এর রাজনৈতিক সাপ্তাহিক-’জনতার চোখ’-এ রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের দেয়া সাক্ষাৎকারেও কোনো দালিলিক প্রমাণ না থাকার বক্তব্যে।
তারপর থেকেই রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন হয়েছে।
তবে ভারতে এইসঙ্গে আলোচনায় উঠে এসেছে হাসিনা কি স্বইচ্ছায় গিয়েছে নাকি তাকে জোর করে পাঠানো হয়েছে?
ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মধ্যে আলোচনা চলছে যে, হাসিনা পালিয়ে এসেছেন বলে যা বলা হচ্ছে তা কতোটা সঠিক? সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে বিমান বাহীনির বিমানে করেই তাকে ভারতে পাঠানো হয়েছে।
অবশ্য ভারতের বিশেষ অনুমতি চাওয়া হয়েছিল। এমনকি হাসিনাকে বহনকারী বিমানকে ভারতের আকাশসীমায় প্রবেশের অনুমতি চাওয়া হয়েছিল। এসবই কি হাসিনার ইচ্ছায় হয়েছিল নাকি সেনাবাহিনীই নিরাপত্তার স্বার্থে ভারতের সঙ্গে কথা বলে সব ব্যবস্থা করেছিল?
পরিস্থিতি যাই হোক, হাসিনাকে নিয়ে ভারত যে অস্বস্তিতে রয়েছে তা কূটনৈতিক মহল স্বীকার করেছে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সোনালী অধ্যায়ের দায় ভারতকে বহন করতে হচ্ছে হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে। এটা ঠিক যে, এর ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের তিক্ততার ঝুঁকি ভারতকে নিতে হয়েছে। বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতা এরমধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে শুভেচ্ছা বার্তায় সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেও এরপর থেকে গত আড়াই মাসে ছোটখাটো কিছু অভিযোগ ছাড়া পরিস্থিতি শীতলই থেকে গেছে। ইতিমধ্যেই ভারত সরকার চিকিৎসা ও জরুরি বিধায় সমস্ত ভিসা প্রদান বন্ধ রেখেছে।
তবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে ভারতের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের স্টেক রয়েছে, বহু প্রকল্প চলমান। পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজও চলছিল। ভারতের বেসরকারি সংস্থাগুলোরও অনেকগুলো দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প চলছিল। সেগুলোর কী পরিণতি হবে তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
সম্প্রতি কেনিয়া সরকারের সঙ্গে ভারতের আদানি শিল্পগোষ্ঠীর সঙ্গে করা একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন চুক্তি সেদেশের কোর্টের নির্দেশে বাতিল হয়েছে। এর আগে একটি বন্দরও আদানিদের হাতছাড়া হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারি শিল্পগোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশ নিয়ে বেশ চিন্তায় রয়েছে।
অবশ্য আগামী মাসে বঙ্গোপসাগরীয় দেশগুলোর আঞ্চলিক সহযোগিতা জোট বিমসটেকের থাইল্যান্ড সম্মেলনের ধারে মোদি ও ইউনূসের মধ্যে বৈঠকের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে বলে জানা গেছে। সেখানেই সম্পর্কের বিষয়টি আলেচিত হবে। আলোচনা হবে বিভিন্ন শঙ্কা নিয়েও।
অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ সরকার ভারতের প্রতি হাসিনাকে আশ্রয় দেয়ার জন্য বিরূপ হলেও এখনো বাংলাদেশ সরকার দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সম্পর্কের বিষয়ে কোনো চরম পন্থা অবলম্বন করেনি। বরং ভারত নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করে চলেছে। ঈদের আগে সেই চাহিদা আরও বাড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে।
সাবেক এক কূটনীতিকের কথায়, হাসিনাকে থাকতে দেয়ার বিষয়টি স্পর্শকাতর হলেও এছাড়া ভারতের সামনে বিকল্প কোনো পথ ছিল না। ভারত তাই বিষয়টি নিয়ে ভারসাম্য বজায় রেখে চলেছে।
তাই পঁচাত্তরের মতোই লম্বা সময়ের জন্য হাসিনাকে অতিথি হিসেবে ভারত থাকতে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। এটাই আপাত গ্রাহ্য গ্রহণযোগ্য সমাধান বলেই মনে করছেন নীতিনির্ধারকরা। অবশ্য এর মধ্যে হাসিনা নিজে থেকে যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেন সেটা আলাদা কথা।
তবে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল হাসিনাসহ ৪৫ জনকে গ্রেপ্তার করে হাজির করানোর যে নির্দেশ দিয়েছে তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে সেই চুক্তির ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার কি হাসিনাকে তুলে দেয়ার জন্য ভারতকে অনুরোধ করবে?
চুক্তি অনুযায়ী রাজনৈতিক কারণে সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করার অধিকার রয়েছে। এক্ষেত্রে যদি সত্যি সত্যিই অনুরোধ আসে তাহলে ভারতের সামনে একটাই পথ, টালবাহানা করে সময় কাটানো এবং শেষ পর্যন্ত তা প্রত্যাখ্যান করা, এমনটাই মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
কেননা, ভারতের উপর প্রতিবেশী অন্য দেশগুলোর আস্থায় যেন টাল না খায় সেদিকেও ভারতকে নজর রাখতে হচ্ছে। তাই চুপচাপ থাকাই ভারত সরকার একমাত্র পথ বলে মনে করছে। তবে প্রশ্ন হলো হাসিনা কি ভারতে নিশ্চুপভাবে দিন কাটাবেন?
আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন নিষিদ্ধ হয়েছে। আওয়ামী লীগকে আগামী দিনে নির্বাচন হলে তাতে যোগ দিতে দেয়া হবে না বলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতারা সোচ্চার হয়েছেন। অথচ দেশের ভেতরে ও বাইরে আওয়ামী লীগ নেতারা অধৈর্য হয়ে উঠেছেন।
বহু আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মী আগে থেকে নেয়া ভিসায় এবং বাকিরা গোপনে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে গেছে। অনেকে অন্য দেশে চলে গেছেন। ভারতের বিভিন্ন শহরে কয়েকজনকে দেখাও গেছে। তারা নানাভাবে হাসিনার নির্দেশ পাওয়ার চেষ্টায় রয়েছে।
ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীরা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে সমাবেশ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাতে নাকি হাসিনার ভাষণ দেয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এসব সংবাদকে ভারতের কোনো পর্যবেক্ষকই বিশ্বাসযোগ্য মনে করছেন না।
তাদের মতে, ভারত এমন কোনো হঠকারী কাজে মদত দেবে না যাতে করে আপাত শীতল সম্পর্ক বিস্ফোরণের আকার ধারণ করে।