নতুন সাংবিধানিক ব্যবস্থার প্রবর্তন ক্যু হিসেবে গণ্য হবে-বিএনপি
- আপডেট সময় : ১১:১৩:০৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / ১১৬৯ বার পড়া হয়েছে
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন, নির্বাচনের আগে সাংবিধানিক সংস্কার করা যাবে না। আগামী সংসদে গঠিত সরকার পরবর্তী দুই বছরে সংবিধান সংস্কার করবে। জুলাই সনদে সব দল এই অঙ্গীকার করবে। নতুন সাংবিধানিক ব্যবস্থার প্রবর্তন বিপ্লব নয়, ক্যু হিসেবে গণ্য হবে।
স্টাফ রিপোর্টারঃ
জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে দেওয়া চিঠিতে এমন মতামত দিয়েছে বিএনপি। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে তারা এই মতামত জানায়।
গত ১৬ আগস্ট প্রণীত সনদের সমন্বিত পূর্ণাঙ্গ খসড়া গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে কমিশনের সভায় চূড়ান্ত করা যায়নি। সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, আগামী রোববার আইন উপদেষ্টা, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠকে সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নির্ধারণ করা হবে। বাস্তবায়ন পদ্ধতি যা-ই হোক, সনদ বাস্তবায়নের আইনি বাধ্যবাধকতা রাখা হবে।
বিএনপি আগের মতো বলেছে, যেসব সংস্কারের জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন নেই, অন্তর্বর্তী সরকার সেগুলো অধ্যাদেশ, প্রশাসনিক আদেশের মাধ্যমে নির্বাচনের আগেই করতে পারে। দলটি ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে জুলাই সনদের স্বপ্নদ্রষ্টা বলেও চিঠিতে উল্লেখ করেছে।
বিএনপির এই মতামতের বিষয়ে কমিশনের কেউ কাছে কোনো মন্তব্য করেননি। কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ শুধু বলেছেন, সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নির্ধারণে সব দলের মতামত পাওয়া গেছে। তা সমন্বয় করছে কমিশন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, কমিশনকে বিস্তারিত মতামত জানানো হয়েছে। সংবিধান সংশোধন সংসদেই হতে হবে। এ জন্য বিএনপির প্রস্তাব, সরকার গঠনের দুই বছরের মধ্যে সাংবিধানিক সংস্কার বাস্তবায়নে সব দল অঙ্গীকার করবে। এর বাইরে বৈধ কোনো আইনি পথ থাকলে বিএনপি সে বিষয়ে আলোচনা করতে রাজি আছে।
কমিশনের কাছে পাঠানো মতামতে বিএনপি তিনবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্য উদ্ধৃত করেছে। সরকারপ্রধান একাধিক ভাষণে বলেছিলেন, যেসব সংস্কার প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হবে, শুধু সেগুলোই জুলাই সনদে থাকবে। অন্তর্বর্তী সরকার তা বাস্তবায়ন শুরু করবে। অবশিষ্ট কাজ নির্বাচিত সরকার করবে।
বিএনপি ড. ইউনূসের এ বক্তব্যকে সমর্থন করেছে। মতামতে তারা বলেছে, ‘জুলাই সনদের বাস্তবায়ন বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার অবস্থান অত্যন্ত সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত। বিএনপি তাই দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে বর্ণিত বাস্তবায়ন কৌশলকে সমর্থন করে। এ ক্ষেত্রে কোনো অন্যথা করার সুযোগ বা প্রয়োজন নেই।’
জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টিসহ কয়েকটি দল জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি চায়। এ দলগুলোর দাবি, সংবিধান সংস্কারসহ জুলাই সনদ নির্বাচনের আগে বাস্তবায়ন করতে হবে। সনদের ভিত্তিতে নির্বাচন হবে।
জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের এ অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, সনদ বাস্তবায়ন ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণের পথ সংকুচিত হবে। প্রধান উপদেষ্টাকে গত রোববারের বৈঠকে তা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। এর বিপরীতে কমিশনকে দেওয়া মতামতে বিএনপি বলেছে, কয়েকটি রাজনৈতিক দল বাস্তবায়ন প্রশ্নে সনদের স্বপ্নদ্রষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সুচিন্তিত ধারণার বাইরে গিয়ে নানা নিত্যনতুন ধারণা, পন্থার কথা বলছে। বিএনপি মনে করে, এসব ধারণা সুচিন্তিত ও বাস্তবসম্মত নয়।
নতুন সাংবিধানিক ব্যবস্থার প্রবর্তন হবে ক্যু
বিএনপির মতামতে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকার বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে গঠিত হয়েছে। ঐতিহাসিক জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন হয়নি। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা থাকায়, সনদকে সংবিধানের ওপর প্রাধান্য দেওয়া আইনি ও সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে অসম্ভব, অসংগত ও অগ্রহণযোগ্য। সংবিধানের অধীনে গঠিত কোনো সরকার রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে নতুন সাংবিধানিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করলে তা বিপ্লব নয় ক্যু হিসেবে গণ্য হয়।
বিএনপি লিখিতভাবে জানিয়েছে, গৌরবময় জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গঠিত সরকারকে কোনো দল বা গোষ্ঠী এরূপ অসম্মানজনক পথে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করলে তা হবে জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন করার বিপজ্জনক চেষ্টা বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাস্তবসম্মতও নয়।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সাংবিধানিকভাবে গঠিত সরকার অন্য কোনো উপায়ে সংবিধান বদলে ফেলতে পারে না। সংসদ ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে সংবিধান পরিবর্তন হলে তা ক্যু হিসেবেই গণ্য হয় সারা দুনিয়ায়। আর সংবিধানের ওপরে সনদ প্রাধান্য পেতে পারে না।
সমন্বিত পূর্ণাঙ্গ খসড়ার আট দফার অঙ্গীকারের দ্বিতীয় দফায় বলা হয়েছিল, সনদ আইন ও সংবিধানের ওপরে প্রাধান্য পাবে। চতুর্থ দফায় বলা হয়েছিল, সনদ নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। কমিশনের গত বুধবারের সভাতে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, এই দুটি দফায় পরিবর্তন আনা হবে। গতকাল তা চূড়ান্ত হয়েছে। এখন বলা হচ্ছে–সংবিধান নয়, বিদ্যমান বিধানের ওপরে প্রাধান্য পাবে সনদ। সালাহউদ্দিন আহম বলেছেন, এসব পরিবর্তনের বিষয়ে কমিশন তাদের এখনও জানায়নি।
আগে কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সনদে বাস্তবায়ন পদ্ধতি থাকবে না। পটভূমি, সংস্কারের যে ৮৪ সুপারিশে নোট অব ডিসেন্টসহ (আপত্তি) রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো এবং অঙ্গীকারনামা থাকবে সনদে। বাস্তবায়ন পদ্ধতি পৃথকভাবে থাকবে। তা রাজনৈতিক দল নয়, সরকারকে দেওয়া হবে।
সূত্র জানায়, জামায়াত, এনসিপিসহ কয়েকটি দল কমিশনকে জানিয়েছে বাস্তবায়ন পদ্ধতি না থাকলে সনদে সই করবে না তারা। জামায়াত নেতা ডা. তাহের বলেছেন, ‘বাস্তবায়ন পদ্ধতি নির্ধারণ করা না হলে সনদে সই করা অর্থহীন। যে সনদ বাস্তবায়নের নিশ্চিয়তা নেই, তাতে কেন সই করবে জামায়াত?’
দলগুলোর এ মনোভাবের কারণে কমিশন আগের অবস্থান পরিবর্তন করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সনদে বাস্তবায়ন পদ্ধতি রাখা হবে। গণভোট, সাংবিধানিক আদেশ, গণপরিবষদসহ যেসব বাস্তবায়ন পদ্ধতির প্রস্তাব রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে, এর কয়েকটি বিকল্প হিসেবে রাখা হবে এবং সরকারকে সুপারিশ আকারে দেওয়া হবে। সরকার সিদ্ধান্ত নেবে, কোন পদ্ধতিতে সনদ বাস্তবায়ন করা হবে। কমিশন সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, দল এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত করা হবে।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, সনদ ইতোমধ্যে চূড়ান্ত হয়েছে। বাস্তবায়ন পদ্ধতি নির্ধারণের পর, তা পূর্ণাঙ্গ সনদে তথ্যাকারে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোকে পাঠানো হবে। এরপর তাদের আলোচনায় আমন্ত্রণ করা হবে। তবে সব কাজ আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর কমিশনের মেয়াদ পূর্তির আগেই সম্পন্ন করা হবে।
কমিশন জানিয়েছে, সনদে যেসব সংস্কারের বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ঐকমত্য হয়েছে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করে সই করবে দলগুলো। তবে পিআর পদ্ধতিতে ১০০ আসনের উচ্চকক্ষ গঠনসহ যে ৯ সংস্কারের সিদ্ধান্তে নোট অব ডিসেন্ট আছে, সেগুলো বাস্তবায়নে রাজি নয় বিএনপি।
দলটি মতামতে বলেছে, সনদে সই করা দলগুলো নির্বাচনী ইশতেহারে সংস্কারের সুপারিশগুলো উল্লেখ করে জাতির কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবে। যদিও জামায়াতসহ অন্যরা বলছে, নির্বাচনী ইশতেহার না মানা বাংলাদেশে সাধারণ ঘটনা। তাই সনদ বাস্তবায়নের আইনি বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে। কমিশন সূত্র বলছে, কোনো একটি পন্থায় বাস্তবায়ন পদ্ধতিতে আইনি বাধ্যবাধকতার বিষয়টি রাখা হবে।