পিআর পদ্ধতির সুবিধা অসুবিধা! কতোটা যৌক্তিক?
স্টাফ রিপোর্টার
দেশের রাজনীতিতে নতুন আলোচনার বিষয় সংসদের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর)। এ ধারণার ভোটিং পদ্ধতি চেয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে জামায়েত ইসলাম, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল।
অন্যদিকে বিএনপি এ পদ্ধতির বিরোধিতা করে প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ পদ্ধতি এখনই বাংলাদেশের জন্য উপযুক্ত নয়। এ পদ্ধতিতে সংসদে বিরোধী দলকে উপেক্ষা করার সুযোগ না থাকলেও এ পদ্ধতির নির্বাচন দুর্বল সরকার গঠনের পরিস্থিতি তৈরি করবে। তবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হলে আগামীতে এটি অনুসরণ করা যেতে পারে।
এ পদ্ধতিতে একক রাজনৈতিক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। তখন জোট সরকার গঠন বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার গঠন হলে এই সরকার মাঝে ভেঙে যাওয়ারও আশঙ্কা থেকে যায়।
রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কমিশনগুলো গঠন করার পর থেকেই নির্বাচন ব্যবস্থায় সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের দাবি তুলেছে বেশ কিছু রাজনৈতিক দল। এটি এমন এক পদ্ধতি যার মাধ্যমে নির্বাচনে যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে সে দল সংসদে তত শতাংশ আসন পাবে।
বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেও এটির প্রচলন রয়েছে- যেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ শক্তিশালী। উদাহরণ স্বরূপ কোনো দল মোট প্রদত্ত ভোটের শতকরা ৩০ শতাংশ ভোট পেলে সে দল সংসদের ৩শ আসনের মধ্যে ৯০টি পাবে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইলেক্টোরাল রি-ফরম সোসাইটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ‘পিআর পদ্ধতি কীভাবে কাজ করে’- শীর্ষক একটি আর্টিকেলে বলা হয়, প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) নিজে কোনো নির্দিষ্ট ভোটিং সিস্টেম নয়। বরং এটি একটি ধারণা, যার উদ্দেশ্য হলো- একটি পার্লামেন্টে যেসব আসন থাকে, তা যেন ভোটের অনুপাতে বিভিন্ন দলের মধ্যে বণ্টিত হয়।
এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিভিন্ন ধরনের ভোটিং পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে-সিঙ্গেল ট্রান্সফারেবল ভোট। এই পদ্ধতি বর্তমানে স্কটল্যান্ড (স্থানীয় সরকার) এবং নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডে (স্থানীয় সরকার ও বিধানসভা নির্বাচন) ব্যবহার করা হয়।
এটি হচ্ছে বড় আকারের এলাকা থেকে একাধিক প্রতিনিধি নির্বাচন করা হয়। ব্যালটে ভোটাররা প্রার্থীদের নামের তালিকা পান, এবং তাদের পছন্দক্রমে নম্বর (১, ২, ৩) দিয়ে ভোট দেন। একজন প্রার্থী নির্বাচিত হতে হলে নির্দিষ্ট ভোটের কোটায় পৌঁছাতে হয়।
দ্বিতীয়টি হচ্ছে অ্যাডিশনাল মেম্বার সিস্টেম। যেটি ওয়েলস পার্লামেন্ট, লন্ডন অ্যাসেম্বলি এবং স্কটিশ পার্লামেন্টে ব্যবহার হয়। এক্ষেত্রে ভোটাররা দুইটি ব্যালট পান। একটি দিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য নির্বাচন করেন। অন্যটি দিয়ে তারা একটি দলকে ভোট দেন।
প্রথম ব্যালটে জয়ী ব্যক্তি সরাসরি নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় ব্যালট থেকে নির্বাচিত হয় ‘অতিরিক্ত সদস্যরা’, যাতে পুরো পার্লামেন্টে ভোটের অনুপাতে দলগুলো আসন পায়। তৃতীয়টি হচ্ছে পার্টি লিস্ট প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন।
এই পদ্ধতি সারা বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয়। প্রতিটি এলাকায় একাধিক প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। দলগুলো একটি প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করে। ভোটাররা হয় একটি দলকে ভোট দেন, অথবা তালিকাভুক্ত প্রার্থীদের থেকে পছন্দ করেন। এক্ষেত্রে তিন ধরনের পার্টি লিস্ট পদ্ধতি রয়েছে।
সেগুলো হলো ক্লোজ লিস্ট যা ভোটার শুধু দলকে ভোট দেন; ওপেন লিস্ট যা ভোটার প্রার্থীদেরও বেছে নিতে পারেন এবং সেমি ওপেন লিস্ট যা কিছু সীমিত প্রার্থী পছন্দের স্বাধীনতা থাকে। এই পদ্ধতিতে ফলাফল বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খুব অনুপাতিক হয় যত ভোট, তত আসন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. সাব্বির আহমেদ বলেন, ভালো দিক হচ্ছে সবার অংশগ্রহণে সুযোগ বাড়বে রাজনীতিতে। ছোট ছোট দলের রাজনীতিতে গুরুত্ব পাবে। আমার মনে হয় এটা হবে না। এখন এটা সম্ভবও নয়। যারা এটি ভাবছেন তাদের হয়তো অন্যকোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. নুরুল আমিন বেপারী বলেন, এ পদ্ধতির খারাপ-ভালো দুটো দিকই রয়েছে। আমাদের মতো দেশে এটি চালু করতে কমপক্ষে ২০ বছর সময় নেয়া উচিত। যাতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হয়। এটা ঠিক এ পদ্ধতি অবলম্বন করলে ছোট ছোট দলগুলো গুরুত্ব পাবে। সংসদে আসন পাবে। তখন তাদের দর কষাকষি বেড়ে যাবে।