আগের গ্রামাঞ্চলের বিনোদনের এক প্রধান মাধ্যম ছিলো পুতুন নাচ। কালের বিবর্তিনে আজ এই ঐতিহ্য যেনো আমরা হারাতে বসেছি। হয়তো নতুন প্রজন্মের কারো কারো গ্রামাঞ্চলে সরাসরি দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, কেউ বা আবার লোকমুখে শুনে শুনে বা টিভির পর্দায় দেখেই বেশ কৌতুহল এবং রোমাঞ্চিত বোধ করেছে। আসলে নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছে পুতুলনাচ আজ গল্পগাথা। আজ আমরা আমাদের সেই পুরোনো ঐতিহ্য নিইয়ে কিছু তথ্য জেনে নেই চলুন।
উপ-মহাদেশে প্রথম পুতুল নাচ
আসলে পুতুল নাচের উৎপত্তি কোথায়, কখন, কীভাবে তার সঠিক ইতহিাস এখনও পাওয়া যায়নি তেমন ভাবে। তবে পুতুল নাচ লোকনাট্যের একটি প্রাচীন মাধ্যমের অংশ। বাংলাদেশে পুতুল নাচের হাজার বছরের ঐতিহ্য রয়েছে।
পুতুল নাচের জন্মকথা সম্পর্কে যতোদূর জানা যায়, আমাদের উপ মহাদেশে প্রথম পুতুল নাচের প্রচলন করেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে এক বাঙালির। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় গড়ে ওঠা এক জনপদের নাম ছিলো কৃষ্ণ নগর । এই কৃষ্ণ নগর পল্লীতে বিপিন পাল নামক এক ব্যক্তির হাত ধরেই পুতুল নাচের জন্ম বলে ধরা হয়।
বিপিন পাল সেসময়ের সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় পৌরানিক কাহিনী অবলম্বন করে পুতুল নাচ করতেন বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন। এই কৃষ্ণনগরেই আবার ছিলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী একটি জমিদার বাড়ি। বিপিন পাল শুরুতেই তাদের পৃষ্ঠপষোকতা লাভ করেন।
গোবিন্দ পুতুলনাচ
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়,বিপিন পালের দলের নাম ছিল গোবিন্দ পুতুলনাচ।গোবিন্দ ছিল বিপিন পালের ছেলের নাম। বিপিন পালবিভিন্ন পূজা – পার্বণে পুতুল নাচের মাধ্যমে বিভিন্নধর্মীয় পালা পরিবেশন করতেন। দেশভাগের কিছুদিনপর বিপিন পাল মারা গেলে তার পুত্র গোবিন্দ পাল।সপরিবারে দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান। তাদের অনুপস্থিতিতে দল মারাত্মক সংকটে পড়ে। এ সময়েদলের হাল ধরেন গিরিশ আচার্য।
বিভিন্ন পুতুল নাচের দল
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জনপদে আরো কয়েকজনের নাম জানা যায়, তারা হলেন মো. তারু মিয়া, ধন মিয়া, কালু মিয়া, মো. রাজ হোসেন এবং পৌর শহরের কাজীপাড়া এলাকার শরীফ মালদার। এদের অনেকেই এখন আর জীবিত নেই। এদের হাত ধরেই বাংলা পেয়েছে পুতুল নাচের মতন ঐতিহ্যকে। কিন্তু তারা পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষোকতা পানি নি।
স্বাধীনতা যুদ্ধে পুতুল নাচ
ধরণা করা হয় বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় শরণার্থী শিবিরে শিবিরে পুতুল নাচের মাধ্যমে সেই সময়কার পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কাহিনী তুলে ধরা হতো। পুতুল নাচের মাধ্যমে শরণার্থী শিবিরের অসহায় মানুষ নতুন দেশের স্বপ্ন দেখত। এমমাত্র বিনোদনের মাধ্যম ছিলো তখন এই পুতুন নাচ।
পুতুল নাচের অতীত ও বর্তমান
আসলে আগের পুতুল নাচের সঙ্গে এখনকার পুতুল নাচের বিস্তর ফারাক ঘটে গিয়েছে৷ নানা ধরনের আর্ট এতে এসে মিশেছে৷ শুধু পুতুল নাচ ছাড়াও এখন থিয়েটার, চলচ্চিত্র হচ্ছে ।পুতুল নাচের নাটক বা সিনেমার ক্ষেত্রে প্রথমে গল্প বাছা হয় ৷
চিত্রনাট্যও লেখা হয় ।এরপর চরিত্র বুঝে পুতুলের ছবি আাঁকা হয়৷ সেই অনুযায়ী কাপড়, কাঠ, থার্মোকল, ফোম, পেপার ম্যাস বা পাল্প দিয়ে পুতুল বানানো হয় মনমতো করে ৷ এরপর তাকে রং, গয়না, কাপড় পরিয়ে সাজানো হয়৷
এরপর সেই পুতুলগুলো দিয়ে মঞ্চে অনুষ্ঠান করানো হয়৷ চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে ক্যামেরা ব্যবহার করা হয় নানা লোকেশনে নিয়ে গিয়ে৷ আবার শো-এর সময় পুতুলের হয়ে কথা বলেন পাপেটিয়ার নিজে৷ অনেক সময় রেকর্ড বাজানো হয়৷ পুতুল নাচের জন্য আবহ, গান এমনকি কোরিওগ্রাফ পর্যন্ত করা হয়৷ এছাড়া, পাপেট শো তো পড়াশোনার আঙিনায়ও ঢুকে পড়েছে৷
বিদেশে অনেক আগেই পাপেট শো কোর্সে রয়েছে । আসলে পুতুন নাচের এই ঐতিহ্যের সাথে আধুনিকতার মিশেল এসে একে দিনে দিনে দিচ্ছে এক ভিন্ন রূপ।
পুতুলনাচ আমাদের ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যকে আমাদের ধরে রাখতে হবে। বাঁচিয়ে রাখতে হবে তরুণ প্রজন্মের মাঝে। এরজন্য দরকার পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতা।