জেলা প্রতিনিধিঃ
একদিনে সাড়ে ১১ বিঘা জমি কিনে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছেন এক নাইটগার্ড। আলোচিত এই নাইটগার্ডের নাম তরিকুল ইসলাম। চাকরী করেন আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে নিবন্ধন অধিদপ্তরের নৈশ প্রহরী কাম ঝাড়ুদার পদে। ‘নো ওয়ার্ক নো পে’ ভিত্তিতে তার দিন হাজিরা মাত্র ৬০ টাকা। সে হিসেবে প্রতি মাসে (৮ দিন ছুটি বাদে) তিনি বেতন পান ১ হাজার ৩২০ টাকা আর বছরে পান ১৫ হাজার ৮৪০ টাকার মতো।
এই বেতনে চাকরি করেও আয়কর ফাইল খুলে তিনি আয়কর দিচ্ছেন। নামে বেনামে মহেশপুর শহরে তাঁর একাধিক মুল্যবান জমি রয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে কোথায় পেলেন তিনি এতো টাকা? শুনতে রুপকথার গল্পের মতো মনে হলেও কোটিপতি এই নাইটগার্ড চাকরি করেন মহেশপুর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে। কথা-বার্তায় তিনি অফিসারের মতোই।
অফিসের কাউকে তিনি পরোয়া করেন না। একহাতে শাসন করেন গোটা সাব-রেজিস্ট্রি অফিস।সর্বক্ষণ তাঁর ভয়ে তটস্থ থাকেন সবাই। অফিসার, অফিস স্টাফ ও দলিল লেখক তাঁর কাছে জিম্মি। কথামতো কাজ না করলে কারণে-অকারণে স্টাফদের মারধর ও বিশ্রী ভাষায় বকাবকি করেন। সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে আসা মানুষরা তাই মনে করেন নাইটগার্ড তরিকুল এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী সম্রাট।
প্রায় ২০ বছর তরিকুল ইসলাম এভাবেই একক রাজত্ব কায়েম করে রেখেছেন মহেশপুর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে। তরিকুল মহেশপুর উপজেলার নেপা ইউনিয়নের সেজিয়া গ্রামের রবিউল কারিগরের ছেলে। বর্তমান মহেশপুর শহরের অভিজাত এলাকা জমিদারপাড়ার মালিপুকুরপাড়ে বসবাস করছেন।
সরেজমিনে সেজিয়া গ্রাম পরিদর্শন করে জানা গেছে, নাইটগার্ড তরিকুলের পিতার মাঠে ৫-৬ বিঘা জমি ছিল। ৫ ভাই ও ৪ বোনের মধ্যে উক্ত জমি বণ্টন হওয়ার পর এখন দু’আড়াই বিঘা জমি থাকতে পারে। এমন তথ্য জানান তরিকুলের প্রতিবেশি নেপা ইউনিয়ন পরিষদের দফাদার শফিকুল ইসলাম।
নেপা ইউনিয়ন ভূমি অফিস ও মহেশপুর ভূমি অফিসও তরিকুলের পিতার পৈত্রিক সম্পত্তির তথ্য দিতে পারেনি। তবে মহেশপুর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে তথ্যানুসন্ধান করে জানা গেছে, ২০২০ সালের ৩ ডিসেম্বর একদিনে মহেশপুর পৌর এলাকার ১১২ নম্বর বগা, ১০৮ নম্বর হামিদপুর ও ১১০ নং জলিলপুর মৌজায় ৬ দলিলের (দলিল নম্বর ৯৩২৬, ৯৩২৭, ৯৩২৮, ৯৩২৯, ৯৩৩০ ও ৯৩৩১) মাধ্যমে সাড়ে ১১ বিঘা জমি (৩৮৪.৭৫ শতক) কিনে তুমুল আলোচনায় আসেন নাইটগার্ড তরিকুল।
এই জমির দালিলিক মূল্য ৬৮ লাখ ১০ হাজার দেখানো হলেও প্রকৃত দাম কয়েক কোটি টাকা। এদিকে, বিপুল পরিমান অর্থ দিয়ে একজন নাইটগার্ডের জমিকেনা নিয়ে হৈচৈ পড়ে যায়। শুরু হয় তর্কবিতর্ক। উপজেলা পরিষদ চত্বর এলাকার চায়ের দোকানে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
কোথায় পেলেন এতো টাকা? কি তার আয়ের উৎস? এমন হাজারো প্রশ্নের মধ্যেও তরিকুলের জমি কেনার মিশন কিন্তু থেমে নেই। বিতর্ক এড়াতে তিনি এখন তাঁর ভাইরাভাই মুদির দোকানদার হাফিজুরের নামে জমি কিনে চলেছেন। সম্প্রতি নাইটগার্ড তরিকুল মালিপুকুর পাড়ে ৫০ লাখ টাকা দিয়ে ১০ শতক ও দুইশতক জমিসহ ৩১ লাখ টাকা দিয়ে বাড়ি কিনে ভাইরার নামে রেজিস্ট্রি করেছেন বলে কথিত রয়েছে। নাইটগার্ড তরিকুলের আয়ের উৎস কি তা নিয়েও রয়েছে রহস্য।
অভিযোগ উঠেছে, চাকরি ঝাড়ুদার ও নাইটগার্ডের পদে হলেও রাতে তিনি অফিস পাহারা দেন না। ঝাড়ু দেন না অফিস। অর্থবিত্ত ও টাকার জোরে তিনিই এখন সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের রাজাধিরাজ।
বিষয়টি নিয়ে মহেশপুর উপজেলা সাব-রেজিস্টার সঞ্জয় কুমার আচার্য্য জানান, একদিনে তরিকুলের সাড়ে ১১ বিঘা জমি কিনেছেন। তিনি এই জমি তাঁর ভাই শফিকুল ইসলামের কাছ থেকে হেবা দলিল করে নেন। তবে নাইটগার্ড তরিকুল অফিসে কোনো ঝামেলা বা রাম-রাজত্ব চালান না বলে দাবি করে সাব-রেজিস্ট্রার জানান, ‘সে কে যে, তার কথায় আমরা এই অফিস চলবে?’
ঝিনাইদহ জেলা রেজিস্ট্রার আসাদুল ইসলাম জানান, ‘আমি যোগদানের পর নাইটগার্ড তরিকুল ইসলামের দুর্ব্যবহারের বিষয়ে অবগত হয়েছি। বিষয়টি আমি তদন্ত করার উদ্যোগ নিয়েছি। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে আমি সরেজমিনে মহেশপুর উপজেলা সাব-রেজিস্টার অফিস তদন্ত করবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে চাকরি নেওয়া এসব কর্মচারীরা স্থানীয় হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় না। মাঝেমধ্যে এমন এমন জায়গা থেকে তাদের ব্যাপারে তদবির আসে আমরা তখন নিরুপায় হয়ে পড়ি।’
দুর্নীতি দমন কমিশন যশোর সমন্বিত অফিসের উপ-পরিচালক নাজমুস সায়াদাত বলেন, ‘গত বছর নাইটগার্ড তরিকুলের বিষয়ে একটি অভিযোগ পেয়ে ঢাকায় পাঠিয়েছিলাম। সেখান থেকে কোনো নির্দেশনা পায়নি।’ তিনি বলেন, ‘নতুন করে অভিযোগ পেলে তদন্ত করে দেখবো।’
নাইটগার্ড তরিকুল ইসলাম তাঁর সম্পদ নিয়ে বলেন, ‘অনেকেই আমার সম্পদের কথা প্রচার করেন, কিন্তু আমার কিছুই নেই। ভাইকে বিদেশ যেতে টাকা দিয়েছিলাম। বিদেশে গিয়ে সে জমি কিনেছিল। পরে সে তাঁর নামে থাকা জমি হেবা দলিল করে নিয়েছে। তিনি বলেন, আমি একটি ঐতিহ্যবাহী পরিবারের ছেলে। আইএ পাশ করেছি। ক্বারী মানুষ, ৬ বছর মসজিদে আজান দিয়েছি।
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। আমার অপরাধ আমি নাইটগার্ডের চাকরিা করি। এটা মানুষের চক্ষুশুল। আমি কারও কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছি কেও প্রমাণ দিতে পারবে না। শত্রুতা করে আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ দিয়েছে। এই রটনার সঙ্গে দলিল লেখকরাই জড়িত। এখানে অন্তত ২০ জন দলিল লেখক আছে যারা সাংবাদিকতাও করেন। আমিও জব নামের একটি টিভির কার্ড নিয়েছি। ২-১ মাসের মধ্যে চাকরি ছেড়ে সাংবাদিক হবো।’
তরিকুল আরও বলেন, ‘আমার আয়কর ফাইল আছে যার টিন নম্বর ১৮৫৫০৮৮৮৪৩০৫। গত বছর আমি ৩ হাজার টাকার আয়কর দিয়েছি। এই চাকরিতে আমার চলে না বলে আমি ‘আমানা’ গ্রুপের ডিলার নিয়েছি।’
এদিকে, তিন হাজার টাকার আয়কর দেওয়া নিয়ে ঝিনাইদহ সার্কেলের অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার অনাথ বন্ধু সাহা জানান, ‘বছরে ৩ লাখের উপরে আয় হলেই কেবল একজন ব্যক্তি ৩ হাজার টাকা আয়কর দিতে পারেন। অথচ নাইটগার্ড তরিকুল বছরে সাকুল্যে বেতন পান মাত্র ২১ হাজার ৬০০ টাকা।
তিনি আমানা গ্রুপের ডিলারশীপ নিয়েছেন এক বছর। সে হিসেবে একের পর এক তার জমি কেনা ও আয়ের উৎস নিয়ে কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়।’