রিয়াজুল হক সাগর, রংপুর জেলা প্রতিনিধিঃ রংপুরে তাজহাট মোল্লাপাড়ার মহেন্দ্র রায়ের প্রতিবন্ধী ছেলে জিতু রায়। তিনি তিন ভাই- বোনের মধ্যে সবার বড়। জিতু রায় ১৯৮৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর জন্ম গ্রহন করেন। তিনি তিন বছরের মাথায় পোলিও রোগে আক্রান্ত হন।
এরপর পোলিও রোগের কারণে শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য তার আর পড়াশুনা করা সম্ভব হয় নাই। জিতুর অনিশ্চিত জীবনের চিন্তায় পরিবারসহ বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন চিন্তিত হয়ে পড়েন। জিতু বুঝতে পারে তাকে নিয়ে পরিবারের কষ্টের বিষয়টির কথা। সেজন্য তার মাথায় নিজে কিছু একটা করার জেদ চেপে বসে। আট-দশজনের মত স্বাভাবিক হাঁটাচলা করতে না পাড়া জিতু বাবার সংগে প্রথমেই ভাংরির ব্যবসা শুরু করে। পরবর্তীতে মোবাইল সার্ভিসিং এর কাজ শুরু করেন।
কিন্তু মোবাইল সার্ভিসিং এর দোকান তিনতলায় হওয়ায় পরে সেকাজ করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে জিতু ফ্রিল্যান্সার হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। কিন্তু স্বপ্ন বাস্তবায়নে ফ্রিল্যান্সিং করতে প্রথমে একটি কম্পিউটারের প্রয়োজন। অভাবী পরিবারের সদস্য হিসাবে যা তার ক্রয় করার সামর্থ্য ছিলনা।
এমন অবস্থায় তিনি অনেক জায়গায় কম্পিউটার শেখার চেষ্টা করলেও বরাবর ব্যর্থ হন। সেই সময় কেউ তাকে ফ্রিল্যান্সিং শেখাননি আর শেখানোর সহানুভূতিও দেখাননি। একসময় বাল্যবন্ধু তৌফিক এগিয়ে আসেন। জিতুকে নিজের কম্পিউটার দিয়ে সহযোগিতা করেন। ফ্রিল্যান্সার হওয়ার জেদ থেকে টানা তিন থেকে মাস দিনরাত কম্পিউটারে গুগল ও ইউটিউব দেখে ফ্রিল্যান্সিং এর কাজ শেখেন জিতু রায়। সময়টা ২০১১ সালের শেষের দিকে। পরবর্তীতে মায়ের জমানো টাকা ও কিছু টাকা ধার করে একটি কম্পিউটার কিনেন তিনি। তারপর থেকে শুরু হয় জিতু রায়ের ফ্রিল্যান্সিং যুদ্ধ।
সফলতা হিসেবে ২০১২ সালে ফ্রিল্যান্সিং থেকে প্রথম আয় করেন প্রায় ৫০০ ডলারের মতো। তারপর শুধু এগিয়ে যাওয়ার গল্প। এখন জিতু রায়ের প্রতিষ্ঠানে তার তত্ত্বাবধানে ৩৫ থেকে ৪৫ জন কাজ করেন। জিতু রায় ইউএস’র প্রায় ৯৫ জন ক্লাইন্ডারের সাথে নিয়মিত কাজ করছেন । তবে শুরুটা সহজ ছিল না তাঁর। শারীরিক প্রতিবন্ধীসহ অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে এগিয়ে যাওয়ার পথে হাজারো প্রতিবন্ধকতায়ও দমে যাননি তিনি। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্নে প্রতিনিয়ত ছুটে চলেছেন। নিজ হাতে ধরেছেন সফলতার চাবি। এখন তিনি সফল ফ্রিল্যান্সার ও উদ্যোক্তা। দেশে আমদানি নির্ভরতা কমাতে ২০২১ সালে উদ্যোক্তা হিসেবে এ ব্যবসার সাথে জড়িত হন তিনি।
রকমারি শিশুঘর ডটকম নামে ওয়েবসাইট ও পেজ খুলে শিশুদের পোশাক সামগ্রী অনলাইনে বিক্রি করছে। জিতুর এই প্রতিষ্ঠানের অনলাইন মার্কেটিং এর কাজের জন্য কয়েকজন তরুণ রয়েছে। যারা অনলাইনে অর্ডার নিয়ে পণ্য ডেলিভারি করেন। শুরুতে বাড়ির আঙ্গিনায় অস্থায়ীভাবে শিশু সামগ্রী তৈরী করা হলো ভালো সাড়া পাওয়ায় বড় পরিসরে করার পরিকল্পনা থেকে তৈরি করেন স্থায়ী কারখানা। যেখানে কাজ করছেন প্রায় দুই শতাধিক কর্মী। এছাড়াও শিশুদের জন্য নকশি কাঁথা তৈরি করে অনলাইনে বিক্রি করা হচ্ছে। জিতু রায়ের কাছ থেকে নকশি কাঁথার কাজ নিয়ে সেলাইয়ের কাজ করেন প্রায় শতাধিক নারী। নিজ নিজ বাড়িতে তারা কাজের ফাঁকে ফাঁকে সেলাই করেন সেই নকশি কাঁথা। প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকলেই সমাজে আর দশ জনের মত প্রতিবন্ধীরাও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তার প্রমাণ দেখিয়েছে জিতু রায়। প্রতিবন্ধী জিতু সমাজের বোঝা না হয়ে নিজেই নিজেকে স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তোলেননি। নিজের বুদ্ধিমত্তায় অনেকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে না পারা জিতু এখন জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়া একজন সফল উদ্যোক্তা।
অনিশ্চিত জীবনের প্রতিবন্ধী জিতুর এখন সফল উদ্যোক্তা। সময় পেলেই এখন ব্যক্তিগত গাড়িতে ঘুরে বেড়ান, রেখেছেন গাড়ির জন্য ড্রাইভার। এছাড়াও আছে দুটি তিন চাকার মোটরসাইকেল। যা তিনি নিজেই চালান। তিন তলার ভিত্তি দেওয়া দুই ইউনিটের বাড়ির প্রথম তলা সম্পন্ন করেছেন। স্ত্রী সহ ছেলে মেয়ে, ভাই বোন বাবা-মা নিয়ে সচ্ছল ও সুখের সংসারে প্রধান এখন জিতু রায়। নিজের পাশাপাশি কাজের মাধ্যমে অসহায় মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনসহ দেশের চাহিদা মিটিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশীয় স্বনির্ভরতা বাড়াতে সরকারের সহযোগিতা কামনা চান তিনি। জিতু রায় বলেন, আমি ছোট থেকে দেখতেছি বন্ধু- বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া- প্রতিবেশীরা আমাকে অবহেলা ও তাচ্ছিল্য করে।
প্রায় লোকেই বাবা- মাকে বলেছে আমাকে দিয়ে ভিক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করা সম্ভব হবে না। মানুষদের ত্রিস্কার মূলক কথা আমাকে কাজ করার প্রেরণা যুগিয়েছে। পরবর্তীতে জিতু রায় নিজের চেষ্টায় এতদূর এসেছেন। তিনি আরো বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিবন্ধীদের নিয়ে অনেক কাজ করছেন। আমার স্বপ্ন পূরণে প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা প্রয়োজন। তাহলে শিশুদের পোশাক সামগ্রী তৈরীর পরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। এ বিষয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুল মতিন বলেন, জিতু রায় প্রতিবন্ধী হয়েও সমাজে আর দশজন স্বাভাবিক মানুষের মত ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে অবশ্যই তা প্রসংশানীয়। জিতু রায়কে সরকারি যে কোনো ধরনের সহযোগিতা করতে সমাজসেবা অধিদপ্তর পাশে থাকবেন। সেক্ষেত্রে জিতু রায়কে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।