জিডিপিতে পাকিস্তানকে আগেই পেছনে ফেলে দিয়েছিল বাংলাদেশ। চলতি বছরের মধ্যে প্রতিবেশী দেশ ভারতকেও পেছনে ফেলতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এক প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হয়েছে।এমন খবরে স্বাভাবিকভাবেই হতাশ ভারত। শুধু জিডিপি নয়, ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে বাংলাদেশের এই বিশাল পরিবর্তন নিয়ে বেশ আলোচনাও হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এক প্রতিবেদনই সব আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। এ বিষয়ে টুইট করেছেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু। তিনি বলেছেন, ভারত এখন যে অবস্থানে আছে, তাতে তারা যদি চীনকে টেক্কা দিতে চায় তবে তাদের অবশ্যই আগে বাংলাদেশকে পরাজিত করতে হবে। পাঁচ বছর আগেও যাদের অর্থনীতি ২৫ শতাংশ এগিয়ে ছিল তাদের জন্য এটা মোটেও সুখবর নয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
আইএমএফ-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সামনে এসেছে। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২০ সালে বাংলাদেশের সম্ভাব্য মাথাপিছু জিডিপি চার শতাংশ বেড়ে হতে পারে এক হাজার ৮৮৮ ডলার। সেখানে ভারতের সম্ভাব্য মাথাপিছু জিডিপি ১০ দশমিক পাঁচ শতাংশ কমে হতে পারে এক হাজার ৮৭৭ ডলার। অর্থাৎ, এই প্রথম মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ ভারতের থেকে ১১ ডলার এগিয়ে যেতে পারে।
বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনীতির দেশ এখন ভারত। মোট জিডিপির দিক থেকে বিশ্বের প্রথম ৫টি দেশের একটি ভারত। বিশ্ব অর্থনীতিতে মোট জিডিপির দিক থেকে ভারতের অংশ ৩ দশমিক ২৮ শতাংশ, আর বাংলাদেশের অংশ দশমিক ৩৪ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশের তুলনায় ভারতের অর্থনীতি ১০ গুণ বড়। সুতরাং এতো বড় এক অর্থনীতির দেশকে মাথাপিছু আয়ে পেছনে ফেলে দেয়ার খবরটিই হয়তো অনেক বেশি আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এর ফলে ভারত সরকারকে এখন নানাভাবে ব্যাখ্যা দিতে হচ্ছে।
ভারতের অর্থনীতি মূলত উন্মুক্ত হয় নব্বই দশকে। তখন থেকেই চীনের দ্রুত বৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলা দেশটির স্বপ্ন ছিল। এ প্রচেষ্টায় তিন দশকের চেষ্টার পর বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে পড়ছে ভারত। এতে বিশ্বে ভারতের ভাবমূর্তিতে আঘাত লেগেছে। চীনের বিরুদ্ধে অর্থপূর্ণ একটি পাল্টা অবস্থান প্রত্যাশা করে পশ্চিমারা। কিন্তু সেই অংশীদারিত্বে এটা বলা হবে না যে, ভারত নিম্ন-মধ্যম আয়ের ফাঁদে আটকা পড়বে। তবে এতে দক্ষিণ এশিয়ায় এবং ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারতের প্রভাব হ্রাস পেতে পারে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।
বাংলাদেশ যেভাবে এগোচ্ছে আর ভারত কেন পিছিয়ে আছে? এ প্রশ্নের জবাবে নানাভাবে তর্ক-বিতর্ক হতে পারে। তবে ভারতীয় গণমাধ্যম দেশটির পিছিয়ে যাওয়ার জন্য তিনটি কারণের কথা বলেছে।
* ২০০৪ সাল থেকে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের অর্থনীতি এগিয়েছে দ্রুত গতিতে। আর এই প্রবণতা বজায় ছিল ২০১৬ সাল পর্যন্ত। ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ব্যবধান কমেনি। কিন্তু পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে ২০১৭ থেকে। এরপর থেকেই ভারতের অর্থনীতির এগিয়ে যাওয়ার গতি কমে যেতে থাকে। অন্যদিকে আগের চেয়েও দ্রুততার সঙ্গে এগোতে থাকে বাংলাদেশ। আর জিডিপির মাথাপিছু হিসেবে এর প্রভাব পড়ে।
* গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল কম, ভারতের বেড়েছে অনেক বেশি হারে। যেমন ১৫ বছরে ভারতের জনসংখ্যা বেড়েছে ২১ শতাংশ, আর একই সময়ে বাংলাদেশের বেড়েছে ১৮ শতাংশ। আমরা জানি, জিডিপিকে জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলেই মাথাপিছু জিডিপির হিসাব পাওয়া যায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির তারতম্যের কারণেই দুই দেশের মধ্যে ব্যবধান এমনিতেই কমে আসছিল। ২০০৪ সালে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ছিল বাংলাদেশের তুলনায় ৭০ শতাংশ বেশি। আর ২০০৭ সালে তা অর্ধেক হয়ে যায়। বেশ দ্রুত গতিতেই এই ব্যবধান কমিয়ে আনতে পেরেছে বাংলাদেশ। আর মহামারির প্রাদুর্ভাবের কারণে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ।
* মহামারির প্রভাব দুই দেশের জন্য সমান হয়নি। মহামারির এ সময়ে অর্থনীতিতে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের একটি ভারত। অন্যদিকে বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে ভালো করছে। আইএমএফের হিসাব অনুসারে, ২০২০ সালে ভারতের অর্থনীতি অতিমাত্রায় সংকুচিত হবে বলেই এর প্রভাব পড়ছে মাথাপিছু জিডিপির ক্ষেত্রে।
১৯৭১ সালে জন্মানো ছোট্ট বাংলাদেশকে দ্রুত বিকাশের জন্য দীর্ঘ লড়াই করতে হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রথম প্রতিবেদনটি ছিল ১৯৭২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। এতে বলা হয়, সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের উন্নয়ন সমস্যাটি অত্যন্ত জটিল। এখানকার মানুষ অত্যন্ত দরিদ্র। মাথাপিছু আয় ৫০ থেকে ৭০ ডলারের মধ্যে।
বাংলাদেশ এখনো অনেক বেশি শিল্প ও সেবা খাত নির্ভর। এই খাতই এখন কর্মসংস্থান তৈরি করছে, যা কৃষি খাত করতে পারছে না। অন্যদিকে, ভারত শিল্প খাতকে চাঙা করতে হিমশিম খাচ্ছে। তবে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার পেছনে শ্রমশক্তিতে নারীদের উচ্চতর অংশগ্রহণ একটি বড় ভূমিকা রাখছে। আর এখানেই ভারত যথেষ্ট পিছিয়ে। শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে তৈরি পোশাক খাত। এই পোশাক খাতকে নিয়েই বিশ্ববাজারে একটি ভালো স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশ। এ খাতে বাংলাদেশের নারীদের অংশগ্রহণের হার ৩২ শতাংশ, আর ভারতে তা মাত্র ২০ দশমিক ৩ শতাংশ।
ওই বিশ্লেষণে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো দেশটিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যেমন জিডিপির দিক থেকে বাংলাদেশ এখন অনেক বেশি শিল্প ও সেবা খাত নির্ভর। এই খাতই এখন কর্মসংস্থান তৈরি করছে, যা কৃষি খাত করতে পারছে না। অন্যদিকে, ভারত শিল্প খাতকে চাঙা করতে হিমশিম খাচ্ছে আর মানুষ এখনো অনেক বেশি কৃষি খাত নির্ভর। এর বাইরে আরো কিছু সামাজিক সূচকও বাংলাদেশকে এগিয়ে নিচ্ছে। যেমন স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ। এখানে একটি ভালো উদাহরণ দেয়া হয়েছে। যেমন স্যানিটেশনের দিক থেকে বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় পিছিয়ে। অথচ অনিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের কারণে যে মৃত্যুহার, তা ভারতে বেশি, বাংলাদেশে কম।
তবে ভারতের আশা এবার বাংলাদেশের তুলনায় পিছিয়ে পড়লেও আগামী বছরেই ঘুরে দাঁড়াবে তারা। যদিও গত কয়েক বছরে মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতের সঙ্গে ব্যবধান অনেক কমিয়ে এনেছে বাংলাদেশ। আবার পিছিয়ে পড়লেও আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশ ভারতকে চ্যালেঞ্জ দিতেই থাকবে।