বৈজ্ঞানিক পথযাত্রার শুরু তথা প্রাচীনকাল থেকেই পৃথিবী এবং সৌরজগতের উদ্ভব সম্পর্কে একাধারে বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিকগণ নানা প্রকার মত প্রকাশ করেন গেছেন। সূর্য, বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহ প্রভৃতি যে নীহারিকা হতে সৃষ্ট সে বিষয়ে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত যতগুলাে মতবাদের রয়েছে তার মধ্যে কান্ট হাইপোথিসিস, ল্যাপ্লাসের নীহারিকা মতবাদ এবং জোয়ার-ভাটা মতবাদ বিশেষ উল্লেখযােগ্য।
জার্মান দার্শনিক ইমুনয়েল কান্ট অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে (১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে) নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে সৌরজগত সৃষ্টি সম্পর্কিত মতবাদ প্রকাশ করেন। তার ধারণা, অতীতে একটি ঘূর্ণায়মান প্রসারিত নীহারিকা ছিল। প্রথমের দিকে নীহারিকাটি শীতল থাকলেও এর অভ্যন্তরস্থ বস্তুগুলাে পরস্পর পরস্পরকে আকর্ষণ করতে থাকে এবং কোনাে নির্দিষ্ট কেন্দ্রে ওদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এর ফলে সময় শীতল নীহারিকাটি উত্তপ্ত হতে থাকে এবং এর কৌনিক ভরবেগ বড়তে থাকে। অভ্যন্তরের বস্তুগুলাের ক্রমাগত সংঘর্ষের জেরে কেন্দ্রাতিক শক্তির সাহায্যে পর পর কয়েকটি অংশ মূল নীহারিকা হতে নির্গমনের মাধ্যমে পৃথক হয়ে পড়ে। পূর্ববর্তীতে এই নির্গত বস্তুগুলাে ঘনীভূত হয়ে গ্রহসমূহের সৃষ্টি করে। নীহারিকাটির কেন্দ্রের অবশিষ্টাংশ বর্তমান সূর্যের আকার ধারণ করে। একইভাবে গ্রহগুলাে হতে আবারও উপ-গ্রহসমূহের সৃষ্টি হয়। কান্টের মতবাদ অনুযায়ী এভাবে সৌরজগতের উৎপত্তি হয়।
১৭৯৬ খ্রিষ্টাব্দে বিখ্যাত ফরাসী জ্যামিতজ্ঞ ল্যাপ্লাস তার লেখা “এক্সপ্লোশন অব দ্যা ওয়াল্ড সিস্টেম” নামক গ্রন্থে সৌরজগত সৃষ্টির কথা উল্লেখ করেন। এ সময় তিনি নীহারিকা মতবাদে বলেন, পূর্বের মতোই গ্যাসীয় অবস্থায় বিরাজমান নীহারিকাটি ঘূর্ণায়মান অবস্থায় প্রথমে উত্তপ্ত অবস্থায় ছিল। এরপর হঠাৎ তাপ বিকিরণের ফলে নীহারিকাটি ক্রমেই ঠান্ডা হতে থাকে। এর ফলে নীহারিকাপিণ্ড ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকে এবং এর আবর্তন বেশ বৃদ্ধি পেতে পেতে এমন একটা সময় উপস্থিত হয় যখন এর নিরীক্ষা অঞ্চলে কেন্দ্রাতিক শক্তি মহাকর্ষ শক্তির সমান হয়ে পড়ে। অবশেষে নিরক্ষীয় এলাকা হতে আংটির আকার ধারণ করা (এক্সেস ম্যাটার) নীহারিকাটির কিছু অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি বাষ্পীয় গ্রহের উৎপত্তি হয়। কালক্রমে এরূপে কয়েকটি গ্রহের উৎপত্তি। নীহারিকাটির কেন্দ্রীয় অবশিষ্টাংশ বর্তমান সূর্যের আকার ধারণ করে। গ্রহগুলাে সৃষ্টি হবার পরেও উত্তপ্ত গ্যাসীয় অবস্থায় ছিল। পরবর্তীতে তাপ বিকিরণের ফলে প্রথমে তরল ও অবশেষে ওদের পৃষ্ঠদেশে কঠিন আবরণ সৃষ্টি হল। সূর্য গ্রহগুলাের মধ্যে অবস্থিত রইলাে এবং গ্রহগুলাে সূর্যের চারিদিকে ও উপগ্রহগুলাে নিজ নিজ গ্রহের চারিদিকে পরিভ্রমণ করতে থাকে। অর্থাৎ ল্যাপ্ল্যাসের মতাবাদ অনুযায়ী গ্রহগুলাের উৎপত্তির সময় ওদের বিচ্ছিন্ন অংশ আবার গ্রহগুলাের মতাে উপগ্রহে পরিণত হয়েছে।
আরও পড়ুনঃ চাঁদে কিছুক্ষণ থাকলেই মহাকাশচারীদের প্রাণ সংশয়ের আশঙ্কা
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে জেইন্স এর করা জোয়ার-ভাটা মতবাদকে সামনের এগিয়ে নিয়ে পরিপূর্ণতা দেন জেফরি (১৯২৬)। এই মতবাদ অনুযায়ী, মহাকাশে সূর্য অনেক উত্তপ্ত অবস্থায় ছিল। অপরদিকে সূর্যের চেয়ে অনেক অনেক গুন বড় একটা নক্ষত্র সূর্যের কাছাকাছি এসে যায় এবং সূর্যকে প্রবলভাবে আকর্ষন করতে থাকে। এর ফলে সূর্যের ভেতর চন্দ্র-সূর্যের আকর্ষণের তারতম্যের কারণে পৃথিবীর সাগরে জোয়ার-ভাটা হয় মত জোয়ারের সৃষ্টি হয়। এসময় সূর্য থেকে বেশ কিছু অংশ বের হয়ে আসে এবং বিচ্ছিন্ন বস্তুর আকার ধারণ করে। পরবর্তীতে এই বিচ্ছিন্ন বস্তু ক্রমেই ঠান্ডা হতে থাকে। এক পর্যায়ে এ বস্তু বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে গ্রহ, উপগ্রহ ইত্যাদিতে পরিনত হতে থাকে।
সৌরজগতের উৎপত্তি সম্বন্ধে আরও অনেক মতবাদ আছে। কিন্তু বর্তমানে এখন পর্যন্ত এই মতামত গুলোর কোনটাই শতভাগ নির্ভুল হিসেবে প্রমাণিত হয়নি।
লেখকঃ- মোঃ আকিক তানজিল জিহান (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়)