ঢাকা ১২:২০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর ২০২৫, ৬ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

হঠাৎ আওয়ামী বন্দনার নেপথ্যে কারা

Astha DESK
  • আপডেট সময় : ০৩:১৩:০৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৩ অগাস্ট ২০২৫
  • / ১১৭৪ বার পড়া হয়েছে

হঠাৎ আওয়ামী বন্দনার নেপথ্যে কারা

স্টাফ রিপোর্টারঃ

আওয়ামী দুঃশাসনের সময়ে যারা বৈরী পরিবেশে নানারকম ঝুঁকি নিয়ে সাহসী বক্তব্য দিয়েছেন। দিনের পর দিন ইউটিউবে কন্টেন্ট বানিয়ে লাখ লাখ মানুষের মন জয় করেছেন। তারাই টকশো ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কিছু জনপ্রিয় চরিত্র হঠাৎ ইউটার্ন নিয়েছে, যা দেখে অনেকে বিস্মিত। সাধারণ মানুষও বিভ্রান্ত। বাতাসে ঘুরপাক খাচ্ছে নানা প্রশ্ন ও সন্দেহ।

এতদিন যারা আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, তাদের মুখেই এখন আওয়ামী লীগের জন্য মায়াকান্নার জিগির। তারা আওয়ামী লীগকে সরাসরি ভোটের ব্যালটে পুনর্বাসন করতে চান। এমনকি সগৌরবে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনতেও আপত্তি নেই।

এভাবে হঠাৎ ইউটার্ন নেওয়া তালিকায় বর্ণচোরা ও দলদাস সাংবাদিক ছাড়াও একে একে যুক্ত হচ্ছেন শিক্ষক, অবসরপ্রাপ্ত আমলা, আইনজীবীসহ একশ্রেণির বুদ্ধিজীবীও। কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতাও ভোল পালটে হুক্কা হুয়া আওয়াজ তুলছেন। এমনকি বর্ষীয়ান রাজনীতিকদের কেউ কেউ প্রকাশ্যে এসে রাজনীতির খেলা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন।

প্রথম শ্রেণির আওয়ামী সুবিধাভোগী হওয়ার কারণে তাদের এখন কারাগারে থাকার কথা। কিন্তু প্রকাশ্যে এসে কথা বলছেন বিদায়ি ফ্যাসিস্টের ভাষায়। কেউ কেউ আবার নিজেদের আঞ্চলিক ভাষায় গালিও দিচ্ছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন।

রাজনীতিক ও বিশ্লেষকগন বলেছেন, এগুলো ভালো কোনো আলামত নয়। নিখুঁতভাবে তাদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে এমনটাই মনে হবে যে, সবকিছু একই সূত্রে গাঁথা। সূক্ষ্ম পরিকল্পনার অংশ হিসাবে একযোগে সমাজের বিভিন্ন সেক্টর থেকে কিছু ব্যক্তিকে পরিকল্পিতভাবে মাঠে নামানো হচ্ছে। কিছু দিনের মধ্যে তারা বিভিন্ন ব্যানারে মাঠে নামতেও দ্বিধা করবে না এবং নামবেই।

তারা মনে করেন, লক্ষণ সুবিধাজনক ভাবার কোনো কারণ নেই। তারা আসলে এতদিন ফিনিক্স পাখির মতো বালুর মধ্যে মাথা গুঁজে ছিলেন। এখন খোলস ছেড়ে ধীরে ধীরে মাথা উঁচু করে প্রকৃত চরিত্রে আবির্ভূত হচ্ছেন। তাদের সঙ্গে ‘আওয়ামী লীগের কালচারাল প্রজেক্ট’গুলো যুক্ত হবে। এই প্রজেক্টে বাম ঘরানার কিছু রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনও আছে।

যারা সময়ে সময়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কথা বললেও বাস্তবিক অর্থে এসব দল আওয়ামী লীগের বি-টিম হিসাবে কাজ করে। তারা ভোটে দাঁড়ালে তাদের জামানত থাকবে না। কিন্তু শুরু থেকেই আওয়ামী অক্সিলারি ফোর্স হিসাবে কাজ করছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হাসান নাসির পিএনজি বলেন, হঠাৎ করেই দেখছি কিছু নয়া মতলববাজ বিভিন্ন টেলিভিশনে টকশোতে অংশ নিয়ে, কিংবা নিজেদের ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুকে নিরপেক্ষতার ছদ্মাবরণে আওয়ামী লীগের পক্ষে নানাভাবে সাফাই গাইছেন।

মূলত তারা আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনার কথা বলছেন। দাবি জানাচ্ছেন তাদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিতে। অথচ গত সাড়ে ১৫ বছর বিএনপি, জামায়াতসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে ছাড়াই আওয়ামী লীগ নির্বাচন করেছে। তখন এই টকশোওয়ালাদের অনেকে কোনো কথা বলেননি।

তিনি বলেন, হঠাৎ করে এখন তাদের এত প্রেম আওয়ামী লীগের জন্য জাগ্রত হলো কেন, তা খতিয়ে দেখতে হবে। তিনি মনে করেন, তারা আসলে নয়া মতলববাজ। জনগণকে উসকে দিয়ে দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে চায়। তাদের মূল উদ্দেশ্য-দেশকে অস্থিতিশীল করে নির্বাচন ভন্ডুল করা। তাই তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। সামাজিকভাবেও তাদের বয়কট করার সময় এসে গেছে।

এ প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সিনিয়র সহকারী প্রেস সচিব ফয়েজ আহমদ বলেন, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘসময় অবৈধভাবে প্রভাব খাটিয়ে রাজনীতি করেছে। এ সময়ের মধ্যে তারা সংস্কৃতিসহ নানা পরিমণ্ডলে নিজেদের লোক তৈরি করেছে। যারা আমাদের সমাজে এখনো নানাভাবে সক্রিয়। তাদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগকে এখন পুনর্বাসনের চেষ্টা করছেন।

টাকশোসহ বিভিন্ন ফ্ল্যাটফর্মে কথা বলার সময় তারা এমনভাবে কথা বলেন, যেন মনেই হয় না যে গত বছর জুলাই-আগস্টে আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। অথচ এই হত্যাযজ্ঞের ঘটনা এখনো দেশের মানুষের কাছে তাজা স্মৃতি। তারা মূলত নিরপেক্ষতার ভান করে আওয়ামী লীগের কর্মী ও সমর্থকদের মতোই কাজ করছেন।

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, টকশোসহ সামাজিক মাধ্যমে কেবল গুণগান হচ্ছে, এমনটা আমি মনে করি না। আমি নিজেও অনেক টকশোতে অংশ নিই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আগামী দিনে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলছে। বিদেশিরাও তাই বলছে।

কিন্তু কীভাবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, বিষয়টি সরকারসহ কেউই খোলাসা করে বলছে না। আমি মনে করি, আওয়ামী লীগের সমর্থক একটি বিশাল জনগোষ্ঠী দেশে আছে। তাদের কোথায়, কীভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, সেটাও ভেবে দেখতে হবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের ৬ মাস পর থেকে এ চক্রের ধীরে ধীরে যাত্রা শুরু হয়। প্রথমে একজন সিনিয়র সাংবাদিক ও জনপ্রিয় ইউটিউব কন্টেন্ট ক্রিয়েটর আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান নেওয়া শুরু করেন। তখনই বিষয়টি নিয়ে অনেকের মধ্যে কানাঘুষা শুরু হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের শেষদিকে কয়েক বছর টেলিভিশন টকশোতে সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য দিয়ে সাধারণ মানুষের মন জয় করেন। এরপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

এ সুবাদে তার নিজের ইউটিউব চ্যানেলও দ্রুত ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়। কারণ, ওই সময় আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে টিকে থাকা সত্যিই কঠিন ছিল। নিঃসন্দেহে গণ-অভ্যুত্থানের পরও মিডিয়াযোদ্ধা হিসাবে তিনি সহজ স্বীকৃতি পেয়ে যান। তার গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়তে থাকে। এ কারণে টিভি চ্যানেলগুলো তাকে টকশোতে আনতে ব্যস্ত। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, ওই সিনিয়র সাংবাদিক আওয়ামী লীগের পক্ষে নিজের জোরালো অবস্থানকে আরও জোরেশোরে জানান দিচ্ছেন।

আওয়ামী ঘরানার আরও একজন সিনিয়র সাংবাদিক অনেকটা স্ট্রেট ফরোয়ার্ড কথা বলেন। যে কারণে আওয়ামী লীগ আমলে তেমন একটা সুবিধায় ছিলেন না। ইরাক যুদ্ধের সময় তিনি বেশ সাহসী সাংবাদিকের খ্যাতি অর্জন করেন। ইদানীং তিনিও আওয়ামী লীগের পক্ষে নিজের জোরালো বয়ান নিয়ে বেশ সক্রিয়।

এদিকে গত কিছুদিন থেকে সাবেক একজন সচিবও আওয়ামী লীগের পক্ষে বেশ জোরালোভাবে যুক্তিতর্কে শামিল হচ্ছেন। যদিও তিনি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একজন কট্টর সমালোচক ছিলেন। ওই সিনিয়র সাংবাদিকের মতো তিনিও অনেক আগে থেকে আওয়ামী ঘরানার আমলা হিসাবে পরিচিত। কিন্তু আওয়ামী লীগের শেষদিকে অনেকটা সাহস ও ঝুঁকি নিয়ে দিনের পর দিন তাদের নানা অন্যায়-অপকর্মের যৌক্তিক সমালোচনা করেছেন।

যে কারণে তিনিও আওয়ামী দুঃশাসনের সময় বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এর ফলে তার আওয়ামী ঘরানার বদনাম অনেখানি ঘুচে যায়। কিন্তু এখন এই আমলার হঠাৎ ইউটার্ন দেখে অনেকে বলতে শুরু করেছেন, ঘরের ছেলে কি শেষ পর্যন্ত ঘরেই ফিরে যাচ্ছে?

এভাবে আরও বেশ কয়েকজন জনপ্রিয় আলোচক এখন নানা কৌশলে আওয়ামী লীগের পক্ষে বয়ান তৈরি ও ওকালতি করছেন। এর মধ্যে একজন ডাক্তারও রয়েছেন। তবে তাদের এমন ইউটার্ন সমাজের অনেককে রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে। কেউ কেউ মনে করছেন, সুপরিকল্পিভাবে কারা যেন পর্দার আড়াল থেকে তাদের এসব বলার জন্য প্রস্তুত করছে। কোনো একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে তাদের মাঠে নামানো হয়েছে।

কেউ বলছেন, তারা কিছু বক্তব্য যুক্তি ও বাস্তবতার নিরিখে বলছেন, যা দেশের ভবিষ্যৎ বহুদলীয় গণতন্ত্র বিকাশের স্বার্থে এবং নির্বাচনকে সত্যিকারার্থে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হিসাবে চিত্রায়িত করতে হলে প্রয়োজনও বটে। ফলে এ সুশীলদের এমন অবস্থান নেওয়ার মধ্যে যদি ষড়যন্ত্রের বিষবৃক্ষ না থাকে, তাহলে আওয়ামী লীগের মধ্যে এখনো যারা ভালো রাজনীতিক রয়েছেন, তাদের জন্য কিছুটা স্পেস থাকা দরকারও আছে।

এ বছরের গোড়ার দিকে বিদেশে অবস্থানরত কয়েকজন সাংবাদিকও হঠাৎ ইউটিউব চ্যানেল খুলে আওয়ামী বয়ানের পয়গাম নিয়ে হাজির হন। তারা রীতিমতো আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়ে প্রতিদিন যা ইচ্ছে বলে যাচ্ছেন। প্রথমদিকে কিছুটা মুখোশ পরে থাকলেও তিন মাস ধরে তারা অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। অতিথি আলোচক হিসাবে নানা শ্রেণির আওয়ামী পান্ডাদেরও যুক্ত করছেন।

তাদের অনেকে সাংবাদিক নামধারী আওয়ামী ক্রীতদাস হিসাবে পরিচিত। জীবনে কখনো মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় কাজ না করেও ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ জমানায় একজন নারী সাংবাদিক গণমাধ্যমসংশ্লিষ্ট একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে বড় পদ বাগিয়ে নেন। প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে যিনি দালাল সাংবাদিকদের মধ্যে অন্যতম তালিকার একজন। আওয়ামী মুখপাত্র হিসাবে তাকে প্রায় বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের টকশোতে আনা একরকম বাধ্যতামূলক ছিল।

আরও যে দুজন সাংবাদিক প্রতিদিন বিদেশে বসে আওয়ামী লীগের পক্ষে বয়ান তৈরি করছেন, কাকতালীয়ভাবে তারাও নারী সাংবাদিক। তাদের মধ্যে একজন দেশে থাকাবস্থায় টেলিভিশন চ্যানেলের জনপ্রিয় উপস্থাপক ছিলেন। সাংবাদিক হিসাবে তার পেশাদারির বেশ সুনামও ছিল। কিন্তু তিনি এখন বিদেশে বসে ইউটিউব চ্যানেলে যেভাবে কথা বলছেন তাতে তার সেই পেশাদারির খোলসটা খসে পড়েছে।

অপরজন যখন বাংলাদেশে ছিলেন, তখন তিনি একজন মধ্যমমানের টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক ছিলেন। বিএনপি ঘরানার টিভি চ্যানেলে কাজ করে পরিচিতি পান এবং আপাদমস্তক বিএনপির পক্ষে সাফাই গাইতেন। সেই নারী সাংবাদিক এখন নাকি আওয়ামী রত্ন(!) নিজেকে একজন নিবেদিত আওয়ামী দাস সাংবাদিক হিসাবে জাহির করতে মরিয়া।

অপর একজন সিনিয়র সাংবাদিক নারী না হলেও তিনি দীর্ঘদিন থেকে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। দেশে থাকা অবস্থায় তিনি সাংবাদিকতার নামে গুজব-গল্প লেখার মাস্টার ছিলেন। টেবিলে বসেই নানান গসিব লেখায় যার জুড়ি ছিল না। শুরু থেকেই এই সাংবাদিকও একজন স্বীকৃত আওয়ামী ল্যাসপেন্সার। তিনি তার ইউটিউব চ্যানেলে প্রতিদিন আওয়ামী লীগের পক্ষে বয়ান তৈরি করতে ব্যস্ত।

এদিকে বিশ্লেষকদের অনেকে বলেন, এ বিষয়গুলো খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। গণ-অভ্যুত্থানের অর্জন ধরে রাখতে হলে এসব নিয়ে চিন্তা করার যথেষ্ট কারণ আছে। কেননা এসব কন্টেন্ট একদিকে ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠীকে যেমন উজ্জীবিত করছে, তেমনই গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষে থাকা সাধারণ মানুষের মধ্যে নানারকম সন্দেহ, হতাশা ও উদ্বেগ উৎকণ্ঠা তৈরি করতে ভূমিকা রাখছে।

ট্যাগস :

হঠাৎ আওয়ামী বন্দনার নেপথ্যে কারা

আপডেট সময় : ০৩:১৩:০৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৩ অগাস্ট ২০২৫

হঠাৎ আওয়ামী বন্দনার নেপথ্যে কারা

স্টাফ রিপোর্টারঃ

আওয়ামী দুঃশাসনের সময়ে যারা বৈরী পরিবেশে নানারকম ঝুঁকি নিয়ে সাহসী বক্তব্য দিয়েছেন। দিনের পর দিন ইউটিউবে কন্টেন্ট বানিয়ে লাখ লাখ মানুষের মন জয় করেছেন। তারাই টকশো ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কিছু জনপ্রিয় চরিত্র হঠাৎ ইউটার্ন নিয়েছে, যা দেখে অনেকে বিস্মিত। সাধারণ মানুষও বিভ্রান্ত। বাতাসে ঘুরপাক খাচ্ছে নানা প্রশ্ন ও সন্দেহ।

এতদিন যারা আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, তাদের মুখেই এখন আওয়ামী লীগের জন্য মায়াকান্নার জিগির। তারা আওয়ামী লীগকে সরাসরি ভোটের ব্যালটে পুনর্বাসন করতে চান। এমনকি সগৌরবে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনতেও আপত্তি নেই।

এভাবে হঠাৎ ইউটার্ন নেওয়া তালিকায় বর্ণচোরা ও দলদাস সাংবাদিক ছাড়াও একে একে যুক্ত হচ্ছেন শিক্ষক, অবসরপ্রাপ্ত আমলা, আইনজীবীসহ একশ্রেণির বুদ্ধিজীবীও। কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতাও ভোল পালটে হুক্কা হুয়া আওয়াজ তুলছেন। এমনকি বর্ষীয়ান রাজনীতিকদের কেউ কেউ প্রকাশ্যে এসে রাজনীতির খেলা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন।

প্রথম শ্রেণির আওয়ামী সুবিধাভোগী হওয়ার কারণে তাদের এখন কারাগারে থাকার কথা। কিন্তু প্রকাশ্যে এসে কথা বলছেন বিদায়ি ফ্যাসিস্টের ভাষায়। কেউ কেউ আবার নিজেদের আঞ্চলিক ভাষায় গালিও দিচ্ছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন।

রাজনীতিক ও বিশ্লেষকগন বলেছেন, এগুলো ভালো কোনো আলামত নয়। নিখুঁতভাবে তাদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে এমনটাই মনে হবে যে, সবকিছু একই সূত্রে গাঁথা। সূক্ষ্ম পরিকল্পনার অংশ হিসাবে একযোগে সমাজের বিভিন্ন সেক্টর থেকে কিছু ব্যক্তিকে পরিকল্পিতভাবে মাঠে নামানো হচ্ছে। কিছু দিনের মধ্যে তারা বিভিন্ন ব্যানারে মাঠে নামতেও দ্বিধা করবে না এবং নামবেই।

তারা মনে করেন, লক্ষণ সুবিধাজনক ভাবার কোনো কারণ নেই। তারা আসলে এতদিন ফিনিক্স পাখির মতো বালুর মধ্যে মাথা গুঁজে ছিলেন। এখন খোলস ছেড়ে ধীরে ধীরে মাথা উঁচু করে প্রকৃত চরিত্রে আবির্ভূত হচ্ছেন। তাদের সঙ্গে ‘আওয়ামী লীগের কালচারাল প্রজেক্ট’গুলো যুক্ত হবে। এই প্রজেক্টে বাম ঘরানার কিছু রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনও আছে।

যারা সময়ে সময়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কথা বললেও বাস্তবিক অর্থে এসব দল আওয়ামী লীগের বি-টিম হিসাবে কাজ করে। তারা ভোটে দাঁড়ালে তাদের জামানত থাকবে না। কিন্তু শুরু থেকেই আওয়ামী অক্সিলারি ফোর্স হিসাবে কাজ করছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হাসান নাসির পিএনজি বলেন, হঠাৎ করেই দেখছি কিছু নয়া মতলববাজ বিভিন্ন টেলিভিশনে টকশোতে অংশ নিয়ে, কিংবা নিজেদের ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুকে নিরপেক্ষতার ছদ্মাবরণে আওয়ামী লীগের পক্ষে নানাভাবে সাফাই গাইছেন।

মূলত তারা আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনার কথা বলছেন। দাবি জানাচ্ছেন তাদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিতে। অথচ গত সাড়ে ১৫ বছর বিএনপি, জামায়াতসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে ছাড়াই আওয়ামী লীগ নির্বাচন করেছে। তখন এই টকশোওয়ালাদের অনেকে কোনো কথা বলেননি।

তিনি বলেন, হঠাৎ করে এখন তাদের এত প্রেম আওয়ামী লীগের জন্য জাগ্রত হলো কেন, তা খতিয়ে দেখতে হবে। তিনি মনে করেন, তারা আসলে নয়া মতলববাজ। জনগণকে উসকে দিয়ে দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে চায়। তাদের মূল উদ্দেশ্য-দেশকে অস্থিতিশীল করে নির্বাচন ভন্ডুল করা। তাই তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। সামাজিকভাবেও তাদের বয়কট করার সময় এসে গেছে।

এ প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সিনিয়র সহকারী প্রেস সচিব ফয়েজ আহমদ বলেন, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘসময় অবৈধভাবে প্রভাব খাটিয়ে রাজনীতি করেছে। এ সময়ের মধ্যে তারা সংস্কৃতিসহ নানা পরিমণ্ডলে নিজেদের লোক তৈরি করেছে। যারা আমাদের সমাজে এখনো নানাভাবে সক্রিয়। তাদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগকে এখন পুনর্বাসনের চেষ্টা করছেন।

টাকশোসহ বিভিন্ন ফ্ল্যাটফর্মে কথা বলার সময় তারা এমনভাবে কথা বলেন, যেন মনেই হয় না যে গত বছর জুলাই-আগস্টে আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। অথচ এই হত্যাযজ্ঞের ঘটনা এখনো দেশের মানুষের কাছে তাজা স্মৃতি। তারা মূলত নিরপেক্ষতার ভান করে আওয়ামী লীগের কর্মী ও সমর্থকদের মতোই কাজ করছেন।

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, টকশোসহ সামাজিক মাধ্যমে কেবল গুণগান হচ্ছে, এমনটা আমি মনে করি না। আমি নিজেও অনেক টকশোতে অংশ নিই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আগামী দিনে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলছে। বিদেশিরাও তাই বলছে।

কিন্তু কীভাবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, বিষয়টি সরকারসহ কেউই খোলাসা করে বলছে না। আমি মনে করি, আওয়ামী লীগের সমর্থক একটি বিশাল জনগোষ্ঠী দেশে আছে। তাদের কোথায়, কীভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, সেটাও ভেবে দেখতে হবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের ৬ মাস পর থেকে এ চক্রের ধীরে ধীরে যাত্রা শুরু হয়। প্রথমে একজন সিনিয়র সাংবাদিক ও জনপ্রিয় ইউটিউব কন্টেন্ট ক্রিয়েটর আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান নেওয়া শুরু করেন। তখনই বিষয়টি নিয়ে অনেকের মধ্যে কানাঘুষা শুরু হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের শেষদিকে কয়েক বছর টেলিভিশন টকশোতে সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য দিয়ে সাধারণ মানুষের মন জয় করেন। এরপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

এ সুবাদে তার নিজের ইউটিউব চ্যানেলও দ্রুত ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়। কারণ, ওই সময় আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে টিকে থাকা সত্যিই কঠিন ছিল। নিঃসন্দেহে গণ-অভ্যুত্থানের পরও মিডিয়াযোদ্ধা হিসাবে তিনি সহজ স্বীকৃতি পেয়ে যান। তার গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়তে থাকে। এ কারণে টিভি চ্যানেলগুলো তাকে টকশোতে আনতে ব্যস্ত। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, ওই সিনিয়র সাংবাদিক আওয়ামী লীগের পক্ষে নিজের জোরালো অবস্থানকে আরও জোরেশোরে জানান দিচ্ছেন।

আওয়ামী ঘরানার আরও একজন সিনিয়র সাংবাদিক অনেকটা স্ট্রেট ফরোয়ার্ড কথা বলেন। যে কারণে আওয়ামী লীগ আমলে তেমন একটা সুবিধায় ছিলেন না। ইরাক যুদ্ধের সময় তিনি বেশ সাহসী সাংবাদিকের খ্যাতি অর্জন করেন। ইদানীং তিনিও আওয়ামী লীগের পক্ষে নিজের জোরালো বয়ান নিয়ে বেশ সক্রিয়।

এদিকে গত কিছুদিন থেকে সাবেক একজন সচিবও আওয়ামী লীগের পক্ষে বেশ জোরালোভাবে যুক্তিতর্কে শামিল হচ্ছেন। যদিও তিনি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একজন কট্টর সমালোচক ছিলেন। ওই সিনিয়র সাংবাদিকের মতো তিনিও অনেক আগে থেকে আওয়ামী ঘরানার আমলা হিসাবে পরিচিত। কিন্তু আওয়ামী লীগের শেষদিকে অনেকটা সাহস ও ঝুঁকি নিয়ে দিনের পর দিন তাদের নানা অন্যায়-অপকর্মের যৌক্তিক সমালোচনা করেছেন।

যে কারণে তিনিও আওয়ামী দুঃশাসনের সময় বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এর ফলে তার আওয়ামী ঘরানার বদনাম অনেখানি ঘুচে যায়। কিন্তু এখন এই আমলার হঠাৎ ইউটার্ন দেখে অনেকে বলতে শুরু করেছেন, ঘরের ছেলে কি শেষ পর্যন্ত ঘরেই ফিরে যাচ্ছে?

এভাবে আরও বেশ কয়েকজন জনপ্রিয় আলোচক এখন নানা কৌশলে আওয়ামী লীগের পক্ষে বয়ান তৈরি ও ওকালতি করছেন। এর মধ্যে একজন ডাক্তারও রয়েছেন। তবে তাদের এমন ইউটার্ন সমাজের অনেককে রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে। কেউ কেউ মনে করছেন, সুপরিকল্পিভাবে কারা যেন পর্দার আড়াল থেকে তাদের এসব বলার জন্য প্রস্তুত করছে। কোনো একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে তাদের মাঠে নামানো হয়েছে।

কেউ বলছেন, তারা কিছু বক্তব্য যুক্তি ও বাস্তবতার নিরিখে বলছেন, যা দেশের ভবিষ্যৎ বহুদলীয় গণতন্ত্র বিকাশের স্বার্থে এবং নির্বাচনকে সত্যিকারার্থে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হিসাবে চিত্রায়িত করতে হলে প্রয়োজনও বটে। ফলে এ সুশীলদের এমন অবস্থান নেওয়ার মধ্যে যদি ষড়যন্ত্রের বিষবৃক্ষ না থাকে, তাহলে আওয়ামী লীগের মধ্যে এখনো যারা ভালো রাজনীতিক রয়েছেন, তাদের জন্য কিছুটা স্পেস থাকা দরকারও আছে।

এ বছরের গোড়ার দিকে বিদেশে অবস্থানরত কয়েকজন সাংবাদিকও হঠাৎ ইউটিউব চ্যানেল খুলে আওয়ামী বয়ানের পয়গাম নিয়ে হাজির হন। তারা রীতিমতো আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়ে প্রতিদিন যা ইচ্ছে বলে যাচ্ছেন। প্রথমদিকে কিছুটা মুখোশ পরে থাকলেও তিন মাস ধরে তারা অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। অতিথি আলোচক হিসাবে নানা শ্রেণির আওয়ামী পান্ডাদেরও যুক্ত করছেন।

তাদের অনেকে সাংবাদিক নামধারী আওয়ামী ক্রীতদাস হিসাবে পরিচিত। জীবনে কখনো মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় কাজ না করেও ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ জমানায় একজন নারী সাংবাদিক গণমাধ্যমসংশ্লিষ্ট একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে বড় পদ বাগিয়ে নেন। প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে যিনি দালাল সাংবাদিকদের মধ্যে অন্যতম তালিকার একজন। আওয়ামী মুখপাত্র হিসাবে তাকে প্রায় বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের টকশোতে আনা একরকম বাধ্যতামূলক ছিল।

আরও যে দুজন সাংবাদিক প্রতিদিন বিদেশে বসে আওয়ামী লীগের পক্ষে বয়ান তৈরি করছেন, কাকতালীয়ভাবে তারাও নারী সাংবাদিক। তাদের মধ্যে একজন দেশে থাকাবস্থায় টেলিভিশন চ্যানেলের জনপ্রিয় উপস্থাপক ছিলেন। সাংবাদিক হিসাবে তার পেশাদারির বেশ সুনামও ছিল। কিন্তু তিনি এখন বিদেশে বসে ইউটিউব চ্যানেলে যেভাবে কথা বলছেন তাতে তার সেই পেশাদারির খোলসটা খসে পড়েছে।

অপরজন যখন বাংলাদেশে ছিলেন, তখন তিনি একজন মধ্যমমানের টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক ছিলেন। বিএনপি ঘরানার টিভি চ্যানেলে কাজ করে পরিচিতি পান এবং আপাদমস্তক বিএনপির পক্ষে সাফাই গাইতেন। সেই নারী সাংবাদিক এখন নাকি আওয়ামী রত্ন(!) নিজেকে একজন নিবেদিত আওয়ামী দাস সাংবাদিক হিসাবে জাহির করতে মরিয়া।

অপর একজন সিনিয়র সাংবাদিক নারী না হলেও তিনি দীর্ঘদিন থেকে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। দেশে থাকা অবস্থায় তিনি সাংবাদিকতার নামে গুজব-গল্প লেখার মাস্টার ছিলেন। টেবিলে বসেই নানান গসিব লেখায় যার জুড়ি ছিল না। শুরু থেকেই এই সাংবাদিকও একজন স্বীকৃত আওয়ামী ল্যাসপেন্সার। তিনি তার ইউটিউব চ্যানেলে প্রতিদিন আওয়ামী লীগের পক্ষে বয়ান তৈরি করতে ব্যস্ত।

এদিকে বিশ্লেষকদের অনেকে বলেন, এ বিষয়গুলো খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। গণ-অভ্যুত্থানের অর্জন ধরে রাখতে হলে এসব নিয়ে চিন্তা করার যথেষ্ট কারণ আছে। কেননা এসব কন্টেন্ট একদিকে ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠীকে যেমন উজ্জীবিত করছে, তেমনই গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষে থাকা সাধারণ মানুষের মধ্যে নানারকম সন্দেহ, হতাশা ও উদ্বেগ উৎকণ্ঠা তৈরি করতে ভূমিকা রাখছে।