সামনেই ভারতের পার্লামেন্ট তথা লোকসভার নির্বাচন। তার আগে নরেন্দ্র মোদি সরকারের কূটনীতির সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হয়তো এবারেই। কারণ, কাতারে বন্দি রয়েছেন ভারতীয় নৌবাহিনীর আট সাবেক কর্মকর্তা। এই আবহে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতে গেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তার সাথে কাতারের আমির প্রধানমন্ত্রী মোহম্মদ বিন আব্দুল রহমান বিন জসিম আল-থানির সাক্ষাতের সম্ভাবনা রয়েছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী কাতারে বন্দিদের নিয়ে আলোচনা করবেন বলে মনে করা হচ্ছে।
ইসরাইলের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করার অভিযোগে ভারতীয় নৌবাহিনীর আট সাবেক কর্মকর্তাকে প্রাণদণ্ড দিয়েছে কাতারের একটি আদালত। তাদের বিরুদ্ধে ঠিক কী কী মামলা দেয়া হয়েছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
বর্তমানে কাতারে ভারতীয় নৌবাহিনীর যে আটজন সাবেক কর্মকর্তা জেলবন্দি, তারা হলেন ক্যাপ্টেন নবতেজ সিংহ গিল, ক্যাপ্টেন বীরেন্দ্রকুমার বর্মা, ক্যাপ্টেন সৌরভ বশিষ্ঠ, ক্যাপ্টেন অমিত নাগপাল, কম্যান্ডার পূর্ণেন্দু তিওয়ারি, কম্যান্ডার সুগুণাকর পাকালা, কম্যান্ডার সঞ্জীব গুপ্ত এবং নাবিক রাগেশ।
প্রায় এক বছর ধরে নৌবাহিনীর ওই কর্মকর্তাদের বন্দি করে রেখেছে কাতার। কিন্তু, তাদের মৃত্যুদণ্ডের খবর প্রকাশ্যে আসার পরেই এ নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিস্ময় প্রকাশ করে মন্ত্রণালয়টি জানায়, সম্ভাব্য সব ধরনের আইনি পদক্ষেপ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা হচ্ছে। আর ওই প্রেক্ষাপটে মোদির সাথে কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল-থানির সাক্ষাতে বন্দিদের নিয়ে আলোচনা জোরদার হয়েছে।
বিজেপি দাবি করে আসছে, ২০১৪ সাল থেকে মোদি সরকারের জমানায় বৈদেশিক কূটনৈতিক সম্পর্ক মজবুত হয়েছে। মোদি সরকারের ওই দাবিকে সামনে রেখে কাতারে ভারতীয় বন্দিদের দেশে ফেরানোর দাবি তুলেছেন বিরোধীরা। যেমন মিম প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়েইসি কটাক্ষ করে বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তো বুক ফুলিয়ে দাবি করেন যে মুসলমান প্রধান দেশগুলো নাকি তাকে ভালোবাসে। আমাদের সাবেক নৌ কর্তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা উচিত তার।’
একই দাবি তুলেছে বিরোধী দল কংগ্রেস। কিছু দিন আগে কংগ্রেস এমপি মনিশ তিওয়ারি যেমন অভিযোগ করেছেন যে প্রথম থেকেই সাবেক নৌ কর্মকর্তাদের বন্দির বিষয়টি ছোট করে দেখেছিল ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তিনি তোপ দাগেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকেও। কংগ্রেস দাবি করেছে, প্রধানমন্ত্রীর উচিত কাতার সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে অবিলম্বে আট ভারতীয় নাবিককে দেশে ফিরিয়ে আনা।
অন্য দিকে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর জানিয়েছেন কাতারে বন্দি আট ভারতীয় নাগরিকের পরিবারের সাথে তিনি ইতিমধ্যে দেখা করেছেন। কেন্দ্রীয় সরকার অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গেই বিষয়টি দেখছে। সমাজমাধ্যমে জয়শঙ্কর লেখেন, ‘সাবেক নৌ কর্মকর্তাদের পরিবারগুলোর দুঃখ এবং যন্ত্রণার দিকটি ভাগ করে নিয়েছি আমরাও। আমরা প্রতিনিয়ত ওই পরিবারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি।’
কাতার প্রশাসনের একটি সূত্র জানিয়েছে, ওই দেশের সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজে নিযুক্ত একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ওই আট কর্মকর্তা। ওই আটজনের মধ্যে কেউ কেউ ‘অতি গোপন’ এবং ‘স্পর্শকাতর’ বিষয় নিয়ে কাজ করতেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। পরে ওই আটজনের বিরুদ্ধে ইসরাইলের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করা এবং গোপন তথ্য পাচার করার অভিযোগ ওঠে। ২০২২ সালের অগস্ট মাসে তাদের গ্রেফতার করা হয়। তার পর থেকেই তারা জেলবন্দি।
বৃহস্পতিবার রাতে দুবাই পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। শুক্রবার কাতারের প্রধানমন্ত্রীও পৌঁছে গিয়েছেন সেখানে। একাধিক সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, সাবেক নৌ কর্মকর্তাদের মৃত্যুদণ্ড রদ নিয়ে দুই নেতার আলোচনা হতে পারে।
অন্য দিকে, কাতারের একটি আদালত ভারতের মৃত্যুদণ্ড রদের আবেদন গ্রহণ করেছে। খুব তাড়াতাড়ি ওই আবেদন পরীক্ষানিরীক্ষার পর এ নিয়ে শুনানির সম্ভাবনা রয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী জানান, এই বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘মামলাটি বর্তমানে আইনি প্রক্রিয়াধীন। আমরা আগেই বলেছি, কাতারের আদালতে একটি আবেদন দায়ের করা হয়েছে। আমরা এই বিষয়ে কাতার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগ রেখে চলেছি। এবং আমরা অবশ্যই সব ধরনের আইনি সহায়তা অব্যাহত রাখব।’
বস্তুত, রাজনৈতিক স্তরে অভিযুক্তেরা যাতে ভারত সরকারের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারে, তার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে কাতার। তাদের মুক্তির জন্য সম্প্রতি একাধিকবার উদ্যোগী হয় ভারত। কিন্তু নয়াদিল্লির সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে শুরু হয় বিচারপ্রক্রিয়া।
কাতারের সাথে ভারতের বাণিজ্যিক এবং সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের সম্পর্ক কয়েক শতক পুরনো। তবে ২০০৮ সাল থেকে ওই সম্পর্কের উত্থান হয় যখন দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ সে দেশে সফর করেন। তার পর ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও কাতার সফর করেছেন। তবে মোদির এ বারের সফরের কূটনৈতিক তাৎপর্য অনেক বেশি।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও কাতারের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। এই দেশটিকে গত কয়েক বছর ধরে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দেখা হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তার সুসম্পর্কও গড়ে উঠেছে ওই কারণেই।
বলে রাখা প্রয়োজন, মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে কাতারের উচ্চ আদালতে আবেদন জানানোর নিয়ম রয়েছে। ওই নিয়মেই আবেদন করেছে ভারত সরকার। কোনো আবেদন জানানো না হলে নিম্ন আদালতের রায়ই কার্যকর হতো। কাতারের রাজার দরবারে সাজাপ্রাপ্তদের পরিবারের পক্ষ থেকেও আলাদা করে আবেদন জানানো হয়েছে। প্রক্রিয়া কঠিন। তবে নৌবাহিনীর সাবেক আট কর্মকর্তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াই হবে মোদি সরকারের বড় কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা