ষ্টাফ রিপোর্টারঃ ময়মনসিংহের ত্রিশালের চরপাড়া এলাকার চড়ুইতলা গ্রামের মজনু মিয়ার সন্তান আরাফাত (১৭)। সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকতো। এখানে জীর্ণশীর্ণ একটি ভাঙ্গা ছোট্ট ঘর থাকলেও একমাত্র ছেলে আর সহধর্মিণীকে নিয়ে শশুরবাড়ি ফুলবাড়িয়ার ভবানীপুর ইউনিয়নের আছিম গ্রামে থাকতেন মজনু মিয়া । সেখানেই ছেলেকে কোনোরকমে খাইয়ে না খাইয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করিয়েছেন। সংসারের হাল ধরতে ছেলে চাকরি নেয় গাজীপুরের কোনাবাড়ি এলাকার একটি বেকারিতে। বেতন পেতেন ৮ হাজার টাকা।আরাফাতের উপার্জিত টাকা দিয়ে সংসার ভালোই যাচ্ছিলো। তবে বেকারির মালিক বলেছিলেন করোনার পরে আরাফাতের বেতন আরো চার হাজার বৃদ্ধি করে ১২ হাজার করা হবে। কিছুদিন পর সারাদেশে করোনার ভয়াল থাবা থেকে রক্ষা পেতে লকডাউন শুরু হয়। ফলে বেকারি বন্ধ হয়ে যায়। যথারীতি আরাফাত নানার বাড়িতে চলে আসে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অমানবিকতার বুকফাটা কষ্টের গল্পটা তখন থেকেই শুরু হয়। হঠাৎ আরাফাতের শরীরে করোনারভাইরাসের উপসর্গ দেখা দেয়। এরপর ময়মনসিংহের এস.কে ( সূর্য কান্ত) হাসপাতালে গত (২০ এপ্রিল) ভর্তি করেন বাবা মজনু মিয়া। এর দুদিন পর (২২ এপ্রিল) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আরাফাত। এরই মধ্যে ফুলবাড়িয়ায় নানার বাড়ি আর ত্রিশালে বাবার বাড়িতে গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় করোনায় আরাফাতের মৃত্যু হয়েছে। আসলে তখন পর্যন্ত আরাফাতের করোনা পরীক্ষার ফলাফল আসেনি। ফলে গুজবকে ঘিরেই নানার বাড়ি আর বাবার বাড়ি থমথমে হয়ে যায়। স্থানীয়রা লাশ দাফন করতে বাধা দেয় আরাফাতের বাবাকে। খোড়া যুক্তি দিয়ে ছড়িয়ে দেয়া হয় লাশ দাফন করলে এলাকার সবাই করোনায় আক্রান্ত হবে।
বাবা-ছেলের ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার
অনুসন্ধানে অমানবিকতার অজানা আরো অনেক তথ্য বেড়িয়ে এসেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, একদিকে নিজ এলাকায় লাশ নিয়ে দাফন করতে এলাকাবাসীর বাধা, আর অন্যদিকে ছেলের লাশটি দাফন কাফন করার মতো টাকা ছিলোনা বাবার পকেটে। আর তাই ছেলের লাশ নিতে মজনু মিয়া কোতোয়ালি মডেল থানায় লিখিতভাবে অনীহা জানায়। ফলে ৪৩ দিন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হিমঘরে পড়ে ছিলো আরাফাতের লাশ!
উপজেলার ৫ নম্বর ওয়ার্ল্ডের আসাদুল ইসলাম ও মনিরুজ্জামান শুভ্র নামের দুইজন জানান, আসলে সবাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। কারণ অনেকে তখন করোনার আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। এলাকায় কানে কানে গুঞ্জন শুরু হয়েছিলো। সবাই ভেবেছে আরাফাতের লাশ দাফন করলে হয়তো সকলের মাঝে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে যেতে পারে। তবে এমন অমানবিকতার দৃশ্য যেন আর কাউকে দেখতে না হয়।
লাশ আনা নেয়াসহ দাফন-কাফনের খরচ দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন বৈশাখী টিভির সাংবাদিক আ ন ম ফারুক। তিনি জানান, অসহায় মজনু মিয়ার বাসা আমার বাসার পাশেই। হঠাৎ শুনতে পারি তার ছেলের লাশ ৪৩ দিন যাবত হিমঘরে পড়ে আছে। লাশ নিতে কোতোয়ালি মডেল থানায় লিখিতভাবে অস্বীকৃতি জানান তিনি। এদিকে করোনা সন্দেহে এলাকায় আতঙ্ক দেখা দেয়। তাৎক্ষণিক মজনু মিয়াকে বুঝিয়েছি, থানায় মজনু মিয়াকে নিয়ে গিয়ে লাশ এনে দাফনের ব্যবস্থা করেছি। এগুলো মানবিক কারনেই করেছি। একজনের বিপদে আরেকজন এগিয়ে আসবে এটাই স্বাভাবিক।
ত্রিশাল পৌরসভার ৫ নং ওয়ার্ল্ড কাউন্সিলর ( প্যানেল মেয়র ২) মেহেদী হাসান নাসিম বলেন, মৃত আরাফাতের লাশটি এলাকায় আনার সময় পুরো এলাকা থমথমে ছিলো। কেউ দূর থেকেও লাশ দেখতে আসেনি। লাশটি রাতে দাফন করা হয়েছিল। দিনে লাশ দাফন করা হলে অনেক হট্টগোল বেধে যেতো। ফলে আরাফাতের লাশ অনেকটা গোপনে দাফন করতে হয়েছে।
তিনি জানান, একটা বিষয় দেখে সবচেয়ে বেশী অবাক হয়েছি। যখন দেখেছিলাম ছয়জন জানাজায় অংশ নিলেও সন্তানের বাবা মজনু মিয়া জানাজার পাশে এক কোনে দাড়িয়ে ছিলো, তবুও জানাজায় অংশ নেয়নি তিনি। এটি শুধু বাংলাদেশে নয়, আমার মনে হয় পৃথিবীতে এমন আশ্চর্যজনক ঘটনা আর কখনো ঘটেনি!
তখন আরাফাতের বাবা বলেছিলেন তার অজু ছিলোনা!
আব্দুল মান্নান (কানু মিয়া) মৃত আরাফাতের দাদা। বয়সের ভারে মুখ দিয়ে ঠিকমতো কথা বলতে পারেননা। নাতী আরাফাতের কথা হঠাৎ মনে করিয়ে দেয়ায় কিছুক্ষণ স্তব্ধ ছিলেন তিনি।
কানু মিয়া বলেন, এলাকাবাসী ভয়ে লাশ দাফনে বাধা দিয়েছেন। নাতির কথা এখনো ভুলতে পারিনা। কারো সন্তান-স্বজনদের সাথে আর কখনো যেন অমানবিক আচরণ না করা হয়। করোনা একদিন চলে যাবে, তবে এমন ঘটনা সারাজীবন স্মৃতি হয়ে থাকবে।
মৃত আরাফাতের বাবা মজনু মিয়া বলেন, আমাকে ফুলবাড়িয়ার ভবানীপুর ইউনিয়ন পরিষদের জীবন চেয়ারম্যান বলেছিলেন ‘ছেলের লাশ এলাকায় আনবেননা। আমরা জানাজা এখানে পড়বোনা’। আমার আত্নীয় স্বজনসহ কেউ লাশ দাফনে এগিয়ে আসেনি। অনেকে বলেছে তর ছেলের লাশ এলাকায় কবর দিলে খবর আছে! ফুলবাড়িয়া থেকে একেকবার একেক ধরনের ভূয়া পরিচয়ে ফোন করে বলেছেন, আমি পুলিশের (ওসি) বলছি। ছেলের লাশ হাসপাতাল থেকে আনবেননা।
কান্নাজড়িত কন্ঠে মজনু বলেন, ছেলের লাশ দাফন কাফন করার মতো আমার কাছে কোনো টাকা ছিলোনা। আর তাই টাকার অভাবে নিজের ছেলের লাশকে ৪৩ দিন হিমঘরে ফেলে রাখতে বাধ্য হয়েছি। তখন চোখের পানি বারবার মুছেছি। বুকের কষ্টটা একটু হালকা করতে মাঝে মাঝে ছেলের লাশটাকে হিমঘরে দেখে এসেছি। তবে তখনও কেউ উপকার করতে এগিয়ে আসেনি। ওইসময় আমি পাগলের মতো ছিলাম। হিমঘরে ছেলের লাশটা কিভাবে এতদিন পড়ে ছিলো তা মনেই ছিলোনা। মনে কষ্ট নিয়ে ভেবেছিলাম, যেহেতু এতদিন ধরে হিমঘরে ছেলের লাশ পড়ে আছে এবং পকেটে টাকা নেই। তাহলে দুইমাসের মধ্যে টাকা সংগ্রহ করেই লাশ এনে সবাইকে বুঝিয়ে লাশ দাফন করবো। আর তাই একরকম বাধ্য হয়েই কোতোয়ালি মডেল থানায় লিখিতভাবে জানিয়েছিলাম আমি এখন ছেলের লাশ নেবোনা। আসলে এতকিছু অমানবিক ঘটনার মূল কারণ হচ্ছে আমি গরীব। তবে বৈশাখী টিভির সাংবাদিক আ ন ম ফারুক ভাইয়ের কথা আজও ভুলতে পারিনা। তিনি টাকা দিয়ে সহায়তা না করলে আর কতদিন লাশ হিমঘরে পড়ে থাকতো সেটা কেবল মহান আল্লাহ তাআলা জানেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, করোনার উপসর্গ নিয়ে আরাফাতের মৃত্যুর বিষয়টি শোনেছিলাম। পরে হাসপাতাল থেকে এ সম্পর্কে আর কোনো তথ্য আমরা পাইনি। ফলে ভেবেছিলাম জানাজা হয়েছে। মাঝখানে মৃত্যুর বিষয়টি পরিবার ও স্থানীয়ভাবে আর কেউ সামনে আনেনি। যার ফলে আরাফাতের মৃত্যুর বিষয়টি একরকম ভুলেই গিয়েছিলাম।
ইউএনও বলেন, আমি ছুটিতে থাকা অবস্থায় শুনতে পেরেছি এতদিন পর দাফন করা হয়েছে। আরাফাতের মৃত্যুর পরে আরো কিছু সমস্যা হয়েছে। করোনায় আক্রান্ত না হয়ে কেউ মারা গেলে করোনায় মৃত্যু হয়েছে বলে অনেকে না বুঝে গুজব ছড়িয়েছে। এজন্য লাশ দাফন করতে অনেক সময় বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। এসব বিষয়গুলো মোকাবেলা করা কঠিন ছিলো।
ত্রিশাল পৌরসভার মেয়র এ.বি.এম আনিসুল হক বলেন, ময়মনসিংহের স্থানীয় এস.কে ( সূর্য কান্ত) হাসপাতালে আরাফাত মারা যাওয়ার পর বাবা মজনু মিয়াকে হাসপাতাল থেকে ফোন করে বলা হয়েছিল ছেলের লাশ নিয়ে যেতে। কিন্তু আরাফাতের বাবা তখন বলেছিলেন এই ছেলে আমার কিছু লাগেনা এবং আরাফাত আমার সন্তান না। আর তাই লাশটি হিমঘরে রাখা হয়েছিল। হয়ত হিমঘর থেকে লাশ আনার টাকা না থাকার কারনে এমন কথা বলেছেন তিনি। আমি বিষয়টি জানতে পেরে এলাকার লোকজনকে বুঝিয়ে রাত সাড়ে ১২ টায় পৌর কবরস্থানে লাশ দাফন করার ব্যবস্থা করি।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার মুহাঃ আহমার উজ্জামান বলেন, ত্রিশালে আরাফাত নামে ছেলের লাশটি তার বাবা মজনু মিয়া নিতে চাননি এবং তার এলাকার লোকজনও লাশ না আনার জন্য হুমকি দিয়েছিলো। পরে লাশ নিতে ও দাফন করতে আমরা সহযোগিতা করেছি।
পুলিশ সুপার বলেন, করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকেই জেলা পুলিশ মানবিক হয়ে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের বিধিবদ্ধ দ্বায়িত্বের বাহিরেও কাজ করেছি। সাত হাজার পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দিয়েছি। রাস্তায় ঘুমায় এমন এক হাজার লোককে রান্না করা খাবার দেয়া হয়েছে। ফ্রী মেডিক্যাল ক্যাম্প করে দিয়েছি।করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত জেলা পুলিশের ১০৬ জন সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়েছেন। ময়মনসিংহ জেলা পুলিশ সবসময় মানুষের পাশে থেকে মানবিক হয়ে কাজ করে যাবে।