জেলা প্রতিনিধি:
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা আর সরকারের কঠোর অবস্থানের মধ্যেও দেশে বাড়ছে মাদকের বিস্তার। পুলিশ, র্যাব, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অভিযানে প্রতিদিনই উদ্ধার হচ্ছে ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইনসহ নানা মাদকদ্রব্য। ধরাও পড়ছে মাদক কারবারিরা। তবে আড়ালে থেকে যাচ্ছে গডফাদাররা। ফলে কোনোভাবেই দমানো যাচ্ছে না মাদকের বিস্তার। দেশে প্রতিদিনই বাড়ছে মাদকসেবীর সংখ্যা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সূত্র বলছে বর্তমানে দেশে সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধের পেছনে রয়েছে মাদক। ছিনতাই, চুরি, পাড়া-মহল্লায় উঠতি বয়সী তরুণদের মধ্যে মারামারি, খুনাখুনির পেছনে রয়েছে মাদকের জের। মাদকের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে ঘটছে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। এমনকি বেড়ে যাওয়া ধর্ষণের পেছনে রয়েছে মাদক।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও মাদক নিয়ে কাজ করা বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার হিসাব মতে দেশে প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ লাখ মাদকাসক্ত রয়েছে। এর তিন ভাগের দুই ভাগই তরুণ। বর্তমানে শিশু ও নারীদের মধ্যেও মাদকাসক্তের সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে ইয়াবা মেয়েরাও অবলীলায় গ্রহণ করছে।
এক সময় ফেনসিডিল, হেরোইনের মতো মাদকের বেশি চাহিদা থাকলেও, এখন তার জায়গা দখল করেছে ইয়াবা। এটি সহজেই বহন করা যায়। তাদের মতে বর্তমানে ২৪ ধরনের মাদক চলে বাংলাদেশে। আর প্রতি বছর মাদকের পেছনে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা নষ্ট হচ্ছে। মাদকাসক্তির কারণে খুনাখুনিও হচ্ছে। মাদকের নেশায় বখে যাওয়া তরুণরা টাকার জন্য বাবা-মাকেও রক্তাক্ত করছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, দেশে এখন পর্যন্ত ২৪ ধরনের মাদক উদ্ধার হয়েছে। দুই প্রতিবেশী দেশের সীমান্ত এলাকা থেকে আসে এসব মাদক। মাদকের প্রবেশপথ হিসেবে বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন ৩২টি জেলাকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করে সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হাসনাবাদ, টাকি, বসিরহাট, স্বরূপনগর, বাদুড়িয়া, উত্তর চব্বিশ পরগনা, বনগাঁ, পেট্রাপোল, হেলেঞ্চা, ভবানীপুর, রাণাঘাট, অমৃতবাজার, বিরামপুর, করিমপুর, নদিয়া, মালদহ, বালুরঘাট, আওরঙ্গবাদ, নিমতিতাসহ সীমান্তসংলগ্ন প্রায় সব এলাকা দিয়ে ১৫টি পয়েন্টে সাতক্ষীরা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট ও দিনাজপুর এলাকায় মাদক ঢুকছে।
আর ভারতের আসাম ও মেঘালয়ের বাংলাদেশ ঘেঁষা এলাকাগুলোর চারটি পয়েন্ট দিয়ে মাদক ঢুকছে কুড়িগ্রাম, শেরপুর, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনায়। বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তে ভারতের আসাম, ত্রিপুরা ও মিজোরামের চারটি পয়েন্ট দিয়ে মাদক ঢুকছে সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও ফেনীতে। এ ছাড়াও ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর হয়ে নওগাঁয় ফেনসিডিল পাচারের নতুন রুটের সন্ধান পাওয়ার কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এসব রুট দিয়ে দেশে হেরোইন, ফেনসিডিল, গাঁজা ঠেকাতে বাংলাদেশের আহ্বানে ভারত ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্তের ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে ফেনসিডিল ও ফেনসিডিল তৈরির উপকরণ সরবরাহ এবং বহন বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে ভারত সরকার।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, অবৈধ মাদক আমদানিতে প্রতি বছর কত টাকা পাচার হচ্ছে এর সুনির্দিষ্ট কোনো হিসাব কারো পক্ষে করা সম্ভব নয়। তবে প্রতিবেদনে বলা হয়, পাঁচ শতাধিক মাদকাসক্তের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, প্রতিদিন গড়ে তাদের ১৫০ টাকার মাদক লাগে। এ হিসাবে একজন মাদকাসক্ত বছরে ৫৪ হাজার ৭৫০ টাকা মাদকের জন্য ব্যয় করে। ২৫ লাখ মাদকাসক্ত বছরে ১৩ হাজার কোটি টাকার মাদক সেবন করে। এসব মাদকের পুরোটাই অবৈধভাবে দেশে আসছে। পাচার হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারের সাথে মাত্র ২৭১ কিলোমিটারের সীমান্তের সবচেয়ে সক্রিয় মাদক রুটগুলো দেশের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ মিয়ানমার থেকে কক্সবাজার ও সংলগ্ন এলাকা দিয়ে ঢুকছে কোটি কোটি পিস ইয়াবা। বেশির ভাগ ইয়াবা তৈরি হয় মিয়ানমার-চীন সীমান্তের শান ও কাচিন প্রদেশে। মিয়ানমারের সাবাইগন, তমব্রু, মংডুর মতো ১৫টি পয়েন্ট দিয়ে টেকনাফের সেন্টমার্টিন, শাহপরীর দ্বীপ, ধুমধুমিয়া, কক্সবাজার হাইওয়ে, উখিয়া, কাটাপাহাড়, বালুখালি, বান্দরবানের ঘুমধুম, নাইক্ষ্যংছড়ি, দমদমিয়া, জেলেপাড়ার মতো অর্ধশত স্পট দিয়ে ইয়াবা ঢুকছে বাংলাদেশে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা বলেন, দেশে যেমনি মাদকের বিস্তার বেড়েছে, তেমনি ধরাও পড়ছে মাদক কারবারিরা। প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থান থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাদকদ্রব্য উদ্ধার করছে। তবে মাদকের বিস্তার কমাতে হলে জনগণকে সচেতন হতে হবে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেন, দেশে মাদকের চাহিদা কমলে জোগানও কমে যাবে। এ জন্য আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।এ দিকে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদকপাচার, বেচাকেনার ক্ষেত্রে নারীদের ব্যবহার করা হচ্ছে।
বাবা-মা খবর রাখছেন না তার ছেলেমেয়ে কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে আর কী করছে। অনেক সময় ব্যস্ততার কারণে বাবা-মা ছেলেমেয়েদের সময় দিচ্ছেন না। এতে করে তারা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে।