রমেকে ১৬টি ডায়ালাইসিস যন্ত্র বিকল, ৫ জনের মৃত্যু
রিয়াজুল হক সাগর/রংপুর জেলা প্রতিরিধিঃ
রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগে কিডনি ডায়ালাইসিস করার ২৮টি যন্ত্রের মধ্যে ১৬টি বিকল হয়ে গেছে। সচল ১২টির মধ্যে পাঁচ-ছয়টি মাঝে মধ্যে ডায়ালাইসিস চলাকালীন বিকল হয়ে যায়। এ অবস্থায় কিডনি রোগীরা চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়ে মারা যাচ্ছেন। গত তিন দিনে চিকিৎসার অভাবে পাঁচ কিডনি রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
পাশাপাশি ডায়ালাইসিস করতে রোগীদের সুই থেকে শুরু করে স্যালাইনসহ সব জিনিস বাইরে থেকে কিনতে হয়। হাসপাতালের ডায়ালাইসিস বিভাগে অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এসব ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ রোগী ও স্বজনদের।
দুটি কিডনি বিকল হয়ে যাওয়ায় অসুস্থ বাবাকে নিয়ে পঞ্চগড় থেকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এসেছেন কলেজশিক্ষার্থী আফজাল হোসেন। তার বাবা শাহাবুল ইসলামকে বাঁচানোর জন্য বুকফাটা আর্তনাদ সবাইকে কাঁদিয়েছে। কয়েক ঘণ্টা পর শাহাবুলকে ডায়ালাইসিস করা হয়। বর্তমানে তিনি সুস্থ আছেন।
আফজাল হোসেন বলেন, ‘বাবাকে নিয়ে গত তিন দিন ধরে ডায়ালাইসিস ওয়ার্ডে অবস্থান করছি। সিরিয়াল পাচ্ছিলাম না। একবার সিরিয়াল পাওয়ার পর আধা ঘণ্টা ডায়ালাইসিস করা হয়। এর মধ্যে হঠাৎ যন্ত্র বিকল হয়ে গেছে। এরপর বাবার অবস্থার অবনতি ঘটে। পরে আবারও ডায়ালাইসিস করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় বেসরকারি হাসপাতালে বাবাকে নিতে পারছি না। সরকারি হাসপাতালের ডায়ালাইসিস মেশিন কেন বার বার বিকল হচ্ছে, বিকলগুলো কেন সচল করা হচ্ছে না। এর জবাব আমরা কার কাছে চাইবো।’
ডায়ালাইসিস করতে গাইবান্ধা থেকে এসেছেন আনোয়ারা বেগম। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সপ্তাহে দুই দিন তাকে ডায়ালাইসিস করাতে হয়। কিন্তু যন্ত্র সংকটের কারণে একবার করতে হচ্ছে। তাও কমপক্ষে চার ঘণ্টা ডায়ালাইসিস না করালে পরিপূর্ণ হয় না। সেখানে দেড় ঘণ্টা তাকে ডায়ালাইসিস করা হয়।
আনোয়ারার স্বামী সাহাবুল হক বলেন, ‘আমরা ২৫ হাজার টাকার প্যাকেজ কিনেছি। যা দিয়ে মাসে চার বার করে ছয় মাস ডায়ালাইসিস করার কথা। কিন্তু সুই থেকে শুরু করে স্যালাইনসহ সব উপকরণ বাইরে থেকে কিনতে হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কিছুই দেয় না।এতে একবার ডায়ালাইসিস করতে অতিরিক্ত ৬০০-৭০০ টাকা খরচ হয়। আমাদের মতো নিম্নবিত্ত পরিবারের পক্ষে এই ব্যয় বহন করা সম্ভব হচ্ছে না। তার ওপর এখন যেভাবে ডায়ালাইসিস করানো হচ্ছে তাতে রোগীরা এমনিতেই বিনা চিকিৎসায় মারা যাবেন। দেড় থেকে দুই ঘণ্টার বেশি ডায়ালাইসিস করানো হয় না।
পীরগঞ্জ থেকে ডায়ালাইসিস করতে এসেছেন জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার এসেছিলাম। যন্ত্র বিকল হওয়ায় চলে গেছি। মঙ্গলবার আবারও এলাম। আধা ঘণ্টা ডায়ালাইসিস দেওয়ার পর যন্ত্র বন্ধ হয়ে গেছে। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও আর দিতে পারিনি।
রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগের কিডনি ডায়ালাইসিস ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, একজন রোগী ডায়ালাইসিস করছেন। অপেক্ষায় রয়েছেন আরও তিন রোগী। একেক রোগীকে তিন থেকে চার ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। ডায়ালাইসিস বিভাগে চিকিৎসা নিতে এসে অসহায় হয়ে পড়েছেন রোগীরা। এরপরও বিকল যন্ত্রগুলো ঠিক করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগ সূত্র জানায়, ২৮টি ডায়ালাইসিস যন্ত্রের মধ্যে ১৬-১৭টি বিকল। ফলে দিনভর রোগীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। একেক রোগীকে চার ঘণ্টা ডায়ালাইসিস না করালে পরিপূর্ণ হয় না। অথচ এখন রোগীকে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা ডায়ালাইসিস করা হয়। এতে ঝুঁকিতে পড়ছেন রোগীরা। গত তিন দিনে গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার শরিফুল ইসলাম ও কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার সাদেক আলীসহ পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে। বাকি তিন জনের নাম জানাতে পারেননি নেফ্রোলজি ওয়ার্ডের ইনচার্জ। তবে পাঁচ জনের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করেছেন তিনি।
ডায়ালাইসিস বিভাগের কর্তব্যরত ওয়ার্ড মাস্টার শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী একজন রোগীকে ডায়ালাইসিস করতে কমপক্ষে চার ঘণ্টা সময় প্রয়োজন। কিন্তু যন্ত্র না থাকায় আমরা রোগীদের সেবা দিতে পারছি না। এতে রোগীরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এখানে রোগীদের প্রচুর চাপ। একজনের ডায়ালাইসিস চলে, ততক্ষণে চার-পাঁচ জন অপেক্ষায় থাকেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরও আমরা সেবা দিতে পারছি না।
নেফ্রোলজি ওয়ার্ডের ইনচার্জ ও স্টাফ নার্স আকলিমা বেগম বলেন, ‘হাসপাতালের ২৮টি ডায়ালাইসিস মেশিনের মধ্যে ১৬টি বিকল হয়ে পড়ে আছে। বাকি ১২টি ভালো থাকলেও কখন কোনটা বিকল হয়ে যায় তার ঠিক নেই। এর মধ্যে তিনটির মনিটর কাজ না করায় ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এজন্য রোগীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।’
ডায়ালাইসিস বিভাগের চিফ টেকনিশিয়ান মাসুদ রানা বলেন, ‘অনেক আগেই ডায়ালাইসিস যন্ত্র সবগুলোর মেয়াদ শেষ। প্রতিদিন ৬০ রোগীকে ডায়ালাইসিস করাতে হয়। কারণ সবাই তালিকাভুক্ত। এর বাইরে নেফ্রোলজি বিভাগে রোগী আছেন। ১৮ ঘণ্টা সার্ভিস দিয়েও শেষ করতে পারছি না। হাসপাতালের পরিচালক ও সংশ্লিষ্টদের অনেকবার বলেছি। তারা যদি ব্যবস্থা নেন তাহলে যন্ত্রগুলো সচল হবে। অন্যথায় এভাবেই আমাদের চলতে হবে।’
নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ‘প্রায় দিনই ১৮টি ডায়ালাইসিস যন্ত্রের ত্রুটি থাকে। একজন টেকনিশিয়ান ত্রুটি দূর করতে সার্বক্ষণিক কাজ করেন। যন্ত্রগুলো অনেক দিনের পুরনো হওয়ায় বিকল হয়ে যায়। প্রতিদিন প্রতিটি যন্ত্রে দুই থেকে তিন জন রোগীর ডায়ালাইসিস হয়। বিকল যন্ত্রগুলো ঠিক করতে হাসপাতালের পরিচালককে বলেছি আমরা।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. রেজাউল ইসলাম বলেন, বিকল হয়ে যাওয়া ডায়ালাইসিস যন্ত্রগুলো সচল করার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে একটা ব্যবস্থা নেবেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ।
নেফ্রোলজি বিভাগের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, হাসপাতালের ডায়ালাইসিস যন্ত্রগুলো জরুরি ভিত্তিতে মেরামত না করলে অনেক রোগীর জীবন হুমকির মুখে।