সত্য সংবাদের নান্দনিক প্রতিনিধি দৈনিক আস্থা’র নিয়মিত আয়োজনে আমাদের সাথে জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী সাইফ শুভ। চলুন হয়ে কিছু যাক কিছু গল্প কথা।
জানঃ কেমন আছেন শুভ ভাই, সব মিলিয়ে কেমন চলছে সবকিছু, নতুন কী কী গান আসছে সামনে?
শুভঃ আলহামদুলিল্লাহ আমি ভালো আছি। বৈশ্বিক মহামারী করোনার ধকল অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে বাংলাদেশ, কাজের ব্যস্ততা বাড়ছে, সব মিলিয়ে ভালোই কাটছে সময়। হ্যাঁ, নতুন ২ টি গানের কাজ চলছে, সবকিছু ঠিক থাকলে আসছে ঈদুল আজহায় গান দুটি রিলিজ হবে।
জানঃ আপনার ফেইসবুক পোস্টের মাধ্যমে জানতে পেরেছি, গান গেয়ে আপনার প্রথম উপার্জন ২ টাকা! ২ টাকা উপার্জনের এই ব্যাপারটি কিভাবে ঘটেছিল?
শুভঃ হ্যাঁ গান গেয়ে আমার প্রথম উপার্জন ২ টাকা। ২০০৫ এর ঘটনা, রিকশায় করে অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলাম গান গাইতে। রিকশাচালক চাচা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আমি অনুষ্ঠান দেখতে যাচ্ছি কিনা, আমি বললাম না চাচা আমি গান গাইতে যাচ্ছি। অনুষ্ঠানে আমার পারফরম্যান্স শেষ হলে হঠাৎ দেখি মঞ্চের ডান দিক থেকে সেই রিকশাচালক চাচা টি হাত বাড়িয়ে আমাকে কাছে ডাকছেন। আমি এগিয়ে যেতেই তার হাতে মুষ্টি করা দুই টাকার একটি নোট আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন!! আর চিৎকার করে বললেন ‘আমার কাছে এর থাইকা বেশি টেহা নাই থাকলে তোমারে দিতাম তুমি অনেক ভালো গান গাইছো দোয়া করি তুমি অনেক বড় হও বাবা’ বলে চলে গেলেন, আর আমি শুধু অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
আসলে এই স্মৃতিটা কোনদিনও ভুলে যাবার নয়, শিল্পীরা মানুষের ভালোবাসা আর দোয়ায় বেঁচে থাকেন আমার ক্ষেত্রেও বিপরীত নয়। এসব স্মৃতি আমাকে বারবার উজ্জীবিত করে। গলা চিরে গান গাইবার অনুপ্রেরণা জোগায়। মানুষের ভালোবাসা আর দোয়ার এমন অনেক স্মৃতি বুকে নিয়েই তো বেঁচে আছি।
জানঃ একজন শিল্পীর প্রকৃতপক্ষে শিল্পী হবার জন্য সংগীতের উপর ডিগ্রি, মানে অনার্স-মাস্টার্স অর্জন করার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু বলে আপনি মনে করেন?
শুভঃ আমার মনে হয়, একজন শিল্পী শিল্পচর্চার জ্ঞান মাতৃগর্ভে থেকে পৃথিবীতে আগমন লগ্নে তার সাথেই নিয়ে আসেন, আসলে সৃষ্টিশীল মানুষেরা ঈশ্বর প্রদত্ত রহমত ইংরেজিতে যাকে ‘super talent’ (আশ্চর্য শক্তি) বলা হয়, নিয়ে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন।
কোন স্বর্ণের খনি অথবা কোন হীরের খনি থেকে যখন স্বর্ণ অথবা হিরে খুঁজে পাওয়া যায় তখন সেটা অপরিচ্ছন্ন থাকে, দেখতে খুব একটা সুন্দর দেখায় না। সেই হীরা এবং স্বর্ণকে যখন রিফাইন্ড মানে পরিষ্কার করা হয় এবং তা দিয়ে অলংকার বানানো হয় তখন সেটার মূল্য বহু গুনে বেড়ে যায় আর দেখতেও ভীষণ সুন্দর দেখায়।
ঠিক তেমনি, একজন শিল্পী যখন শিল্পচর্চার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করে সঙ্গীতের ভূবনে বিচরণ করেন, তখন তাকে অন্য আর দশজনের থেকে আলাদা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার শিল্প, তার কাজের ধরন, মান অন্য আর দশজন এর থেকে আলাদা হয়।
সুতরাং সঙ্গীতে নয় শিল্প সংস্কৃতি চর্চার প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম বলে আমি মনে করি।
জানঃ নতুন শিল্পীদের বেরিয়ে আসার জন্য, কাজ করার জন্য আমাদের ইন্ডাস্ট্রির পরিবেশ কতটুকু অনুকূল বলে আপনি মনে করেন?
শুভঃ দেখুন নতুন সবসময় নতুনই, নতুন কার না ভালো লাগে। নতুনের কদর সবসময় ছিল আছে এবং থাকবে। বর্তমানে ইন্ডাস্ট্রিতে অসংখ্য নতুন মুখ কাজ করছে, ভালো কাজ জানলে, ভালো গাইতে জানলে বাজাতে জানলে ইন্ডাস্ট্রিতে প্রচুর কাজ করার জায়গা রয়েছে। আমি দেখেছি কিছু কিছু নতুন শিল্পী পুরানো অনেকের থেকে ভালো করছে। আমার মনে হয় যদি তারা সঠিক পথে থাকে, সততা এবং নিষ্ঠার সাথে শতভাগ পেশাদারিত্ব বোধ বুকে ধারণ করে কাজ করে যায়, সংগীতের আকাশে অচিরেই তারা অপ্রতিরোধ্য বলে বিবেচিত হবে।
জানঃ ইন্ডাস্ট্রিতে আজ যারা নতুন তাদের কে সিনিয়ররা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করছে কিনা এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কি?
শুভঃ নতুনদের মূল্যায়ন করা সামনের দিকে এগিয়ে যাবার পথ এবং সুযোগটা তৈরি করে দেওয়ার দায়িত্ব টা কিন্তু সিনিয়রদেরই। দেশের হাতে গোনা দুই এক জন সিনিয়র ছাড়া বাকি সবাইকে আমার ভিষন হেল্পফুল বলে মনে হয়। কাজের সুবাদে অনেকের সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ হয়েছে। আসলে প্রকৃত বড় মানুষদের বুকটা অনেক বড় হয়, মনটাও। সিনিয়রদের যেমন জুনিয়রদের পথ প্রশস্ত করে দেওয়ার দায়িত্ব থাকে তেমনি জুনিয়রদেরও সিনিয়রদের দেখানো পথে সঠিক এবং সততা বুকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়াটাও দায়িত্ব বলে মনে করি। বিনয়, ভদ্রতা আর বুকে সঙ্গীত থাকলে আমাদের সিনিয়ররা কখনোই জুনিয়রদের কে নিরাশ করেনি আশা করি আগামীতেও করবেন না।
জানঃ শুধুমাত্র সংগীতকেই পেশায় হিসেবে নেওয়ার ব্যাপারে আপনার মতামত কি?
শুভঃ সংগীতকে পেশা হিসেবে নেওয়াটা এখনকার সময়ে খুব চ্যালেঞ্জিং বলে মনে হয়। বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের জীবন জীবিকার জন্য যতটুকু আর্থিক সামর্থের প্রয়োজন, শুধুমাত্র সঙ্গীতকে পেশা হিসেবে নিয়ে, হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া অন্যদের পক্ষে তা এফোর্ট করা সম্ভব নয়। এমন বাস্তবতায় শুধুমাত্র সঙ্গীতকেই পেশা হিসেবে না নিয়ে, সংগীতের পাশাপাশি শক্ত একটি আয় উপার্জনের ব্যবস্থা রেখে তার পরে সঙ্গীতে সময় দেওয়াটাই নিজের এবং পরিবারের জন্য শ্রেয় হবে বলে মনে করি।
জানঃ আপনার পারিবারিক জীবন সম্বন্ধে বলুন?
শুভঃ আলহাদুলিল্লাহ, বাবা পেশায় সংবাদ কর্মী, মা গৃহিণী। ছোট দুই ভাই আলিফ এবং মীম, আগামীতে এস এস সি পরীক্ষার্থী। আমি ও আমার স্ত্রী দুই সন্তান মানহা এবং সামান্থা কে নিয়ে ভালো আছি।
জানঃ জীবনে মোট কতবার প্রেমে পড়েছেন?
শুভঃ আমার বেহিসেবি মন প্রেমে পরে যখন তখন।
জানঃ সঙ্গীত নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী,
আগামী দশ বছর পর নিজেকে কোথায় দেখতে চান?
শুভঃ ভবিষ্যতের কথা আমরা কেউ বলতে পারি না, নিঃশ্বাসের বিশ্বাস নেই সেখানে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আমার কাছে মূল্যহীন মনে হয়। তবুও মানুষ আশায় বাঁচে, আমিও তার ব্যাতিক্রম নই। আমি চাই বাংলাদেশের গান বাংলা গান সারা বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। দেশের অভ্যন্তরে বাংলা গানের চর্চার ক্ষেত্র আরও প্রসারিত হোক। অনেকদিন আগে বলেছিলাম একটি ফ্রি সংগীত শিক্ষালয় গড়তে চাই। আমাদের সুবিধাবঞ্চিত শিশু থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ সংগীতের প্রাথমিক শিক্ষা বিনামূল্যে অর্জন করবে। বলতে পারেন অনেকটা ওয়ান ম্যান আর্মির মতো একাই সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি, তাই সময় লাগছে প্রচুর।
আমি দশ বছর পরে জাগতিক সকল ঝুট ঝামেলাকে পেছনে ফেলে, নিজেকে কোন এক নির্জন সমুদ্র সৈকতে আগামী দিনের সূর্য উদয়ের প্রত্যাশায়, আমার সহধর্মিনীর হাত ধরে শেষ বিকেলের সূর্যাস্ত দেখছি। এমন কোথাও দেখতে চাই।
জানঃ আমরা প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি, দৈনিক আস্থার এই আয়োজন আপনার কাছে কেমন লাগলো? আপনার দর্শকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন?
দৈনিক আস্থা সবসময় ব্যতিক্রমধর্মী প্রশ্নের সমাহার নিয়ে আসে। ব্যাপারটা আমার কাছে খুব ভালো লাগে। দৈনিক আস্থা সাথে সম্পর্কটা অনেক পুরানো। ক্যারিয়ারের প্রথম থেকেই দৈনিক আস্থা ভালোবাসা দিয়ে আমার পাশে রয়েছে, এই জন্য আস্থা পরিবারের সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
দর্শক শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বলব আপনারা বাংলা গান শুনুন বাংলা গানের পাশে থাকুন। নিজের দেশ, দেশীয় সংস্কৃতি কে ভালোবাসুন। আমার এবং আবার পরিবারের জন্য সবার কাছে দোয়া চাইছি। ভালোবাসা সবসময়।