মনোমুগ্ধকর ‘জল কেলি’ নৃত্য উৎসব
মোফাজ্জল হোসেন ইলিয়াছঃ
“নব দিনের নব আলোয়-নব জীবন গড়ি” “জরাজীর্ণ সাম্প্রদায়িকতা ভুলে-সম্প্রীতির হাত ধরি” এ শ্লোগানকে বুকে ধারণ করে, ‘‘মাহা সাংগ্রাইং সাইংমা সাক্রঃ ১৩৮৫ উদযাপন’’ ও বৈসাবি উপলক্ষে ঐতিহ্যবাহী বর্ণিল রি-আকাজা (জল কেলি) উৎসবে মতোয়ারা মারমা জনগোষ্ঠী। মনোমুগ্ধকর এই জল কেলি উৎসব বা এ পানি খেলা।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আবহমান কাল ধরে লালিত ঐতিহ্যবাহী কৃষ্টি ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ ‘বৈসাবি’। এ উপলক্ষে খাগড়াছড়ি মারমা উন্নয়ন সংসদ’র আয়োজনে ও মারমা যুব কল্যাণ সংসদের সার্বিক সহযোগিতায় ঐতিহাসিক পানখাইয়াপাড়া বটতলায় ঐতিহ্যবাহী ‘রি-আকাজা’ (জলকেলি) উৎসব পানি খেলা, মঙ্গল শোভাযাত্রা, ঐতিহ্যবাহী মারমা নৃত্য ও ওপেন কনসার্ট, দিনব্যাপী ‘আলারী’ খেলা এবং পুরুষদের ‘দঃ’ খেলার আয়োজ করা হয়েছে।
আজ শুক্রবার ১৪ এপ্রিল সকালে বর্ণাঢ্য র্যালির উদ্বোধন করেন, ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্স চেয়ারম্যান কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি।
র্যালিতে মারমা তরুণ-তরুণী ও যুবক-যুবতীরা রঙবেরঙের পোশাকে সুসজ্জিত অংশগ্রহণ এবং নাচ গান আর আনন্দ উল্লাসে উৎসবমূখর হয়ে উঠে পুরো খাগড়াছড়ি শহর। পরে শুরু হয় সাংগ্রাই’র প্রধানতম আকর্ষণ পানি উৎসব। প্রধান এ অনুষ্ঠারেন উদ্বোধন করেন, সেনাবাহিনীর খাগড়াছড়ি রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গোলাম মহিউদ্দিন আহমেদ মাহি।
এসময় জেলা প্রশাসক মোঃ সহিদুজ্জামান, পুলিশ সুপার মোঃ নাইমুল হক, সদর জোন কমান্ডার লে. কর্ণেল মোঃ আবুল হাসনাত, খাগড়াছড়ি রিজিয়নের স্টাফ অফিসার (জিটুআই) মেজর মোঃ জাহিদ হাসান, পৌর মেয়র নির্মলেন্দু চৌধুরীসহ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন শ্রেণীপেশার হাজারো মানুষ এতে অশং নেন।
‘সাংগ্রাই’ মারমা সম্প্রদায়ের সকল অসুষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী ‘রি-আকাজা’ (জলকেলি) উৎসব পানি খেলা। পুরোনো বছরের গ্লানি ও কালিমা ধুয়েমুছে দূর করতে মারমা তরুণ-তরুণীরা দলবেঁধে একে অপরের প্রতি পানি ছিটিয়ে আনন্দ করে। বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ উপলক্ষে আয়োজিত এ পানিখেলা খুবই আকর্ষণীয় ও উপভোগ্য। পানি খেলার মাধ্যমে একে অপরের পছন্দের মানুষটিকেও খুঁজে নেন। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে মারমা সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে নতুন উন্মাদনা ও অনাবিল আনন্দের সুষ্টি হয়। মূলত উৎসবের দিন নির্দিষ্ট একটি জায়গায় নৌকা বা বিশাল কোনো পাত্র পানি আর ফুল দিয়ে পূর্ণ করা হয়। তার দুই পাশে মারমা তরুণী ও যুবতীরা সুন্দর পোশাকে সুসজ্জিত হয়ে অপেক্ষা করেন। তরুণ ও যুবকরা সেই স্থানে পানিপূর্ণ পাত্র হাতে আসেন এবং অপেক্ষমাণ তরুণী ও যুবতীদের গায়ে পানি ছিটান। এতে পানিখেলার স্থানটি হাসি-আনন্দে ভরে ওঠে। ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সুসজ্জিত হয়ে দলবেঁেধ বেড়ায় আর রঙিন পারি ছিটিয়ে একে অপরকে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। ভিন্ন স্বাধের নানা রকমের ভালো খাবার তৈরি করে অতিথি আপ্যায়ন করেন। নববর্ষেরদিন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে নিজেদের ঐতিহ্যবাহী মারমা পোশাক পরিধার করে ভোর বেলায় সারিবদ্ধ হয়ে ‘সাংগ্রাইং প্রভাত ফেরি ও বৌদ্ধ বিহার/ক্যং এ ফুল পূজা দেয়। রাতে ভগবান বুদ্ধের কাছে প্রার্থনা করেন এবং নতুন বছরের জন্য শান্তি ও কল্যাণ কামনা করেন।
সবমিলিয়ে পাহাড়ের ঐতিহ্যবাহী বর্ণিল রঙিন এ বৈসাবি উৎসবের আনন্দ, উল্লাসে মাতোয়ারা হয়ে সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে এখানে বসবাসরত সকল জাতিগোষ্ঠীর বহুমুখী কৃষ্টি-সংস্কৃতির বর্ণিল শোভায় শোভিত হয় সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িয়া জনপদ। মুছে যাক গ্নিলা ঘুচে যাক জরা, অগ্নিগ্রানে শুচি হোক ধরা। বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা, শুভ নববর্ষ ১৪৩০ বঙ্গাব্দ।