হাসপাতাল হচ্ছে চিকিৎসা সেবা প্রদানের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। তাই মানুষের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হলে চিকিৎসাকেন্দ্র বা হাসপাতালের আদর্শ ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই। যেকোন প্রতিষ্ঠানের সেবার মান নির্ভর করে সে প্রতিষ্ঠানের সার্বিক ব্যবস্থাপনার উপর। যেহেতু হাসপাতাল একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি ও জীবন রক্ষায় নিয়োজিত সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান তাই হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার বিশেষত্ব ও গুরুত্ব অন্য যেকোন প্রতিষ্ঠানের চেয়ে অনেক অনেক বেশি হওয়া দরকার। কিন্তু হাসপাতালের অনিয়মই যদি হয় নিয়ম; তবে চিকিৎসা সেবার মান হবে কেমন?
কিশোরগঞ্জে ২০১২-১৩ অর্থবছরে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রকল্পের অনুমোদন দেয় সরকার। উন্নত মানের চিকিৎসা ও আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতি সম্বলিত এ মেডিকেল কলেজ প্রকল্পের বাস্তবায়ন হলেও সঠিক চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা।
উন্নত ও আধুনিক চিকিৎসাসেবা সম্বলিত এ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে রয়েছে ৮৮টি এসি কেবিন, সুবিশাল ওয়ার্ড পরিসর, ১৮টি অপারেশন থিয়েটার, প্রতিটি বিভাগের জন্য আলাদা ওয়ার্ড-ডাক্তার-নার্সের ব্যবস্থা। এত কিছু থাকলেও নেই শুধু সঠিক চিকিৎসাসেবা। শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের ব্যতিক্রম বিষয় হচ্ছে হাসপাতাল ও কলেজ বিভাগ সম্পূর্ণ ২টি আলাদা ইউনিট হিসেবে সেবা দিবে।
অর্থাৎ, মেডিকেল কলেজের ডাক্তার-শিক্ষকরা শুধুমাত্র শিক্ষাদান করবেন, তারা কোনো রোগী দেখবেন না এবং হাসপাতালে যেসব ডাক্তাররা রোগীর সেবা দিবেন তারা কলেজে যাবেন না। যার ফলে রোগীদের ভালো মানের সেবা নিশ্চিত হওয়ার কথা থাকলেও এর বিন্দু পরিমাণও সেবা মিলছে না বলে অভিযোগ রয়েছে সেবা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের। মেডিকেল কলেজটি চালু হওয়ার পর থেকেই চিকিৎসাসেবা নিয়ে হতাশ রোগী ও স্বজনরা। উন্নত চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা। যার ফলে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এলাকাবাসীর ক্ষোভ ও হতাশা বাড়ছে।
২০২০ সালের ১৭ মার্চ পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম শুরু করে কিশোরগঞ্জের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। চালু হওয়ার মাত্র ৪ বছরেই বেহাল অবস্থা হাসপাতালটির।
হাসপাতালটিতে যন্ত্রপাতি, অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা সবই আছে। নেই শুধু চিকিৎসাসেবা। কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনায় দালালদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে এ হাসপাতালটি। প্রতিদিন বহির্বিভাগে দেড় হাজার রোগী আসেন চিকিৎসা নিতে। তবে রোগীদের অভিযোগ, ডাক্তারদের ঠিকমত পাওয়া যায় না। দুপুর ১২টা বাজলেই বন্ধ করে দেন সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ফলে বাইরের ক্লিনিকগুলোতে গিয়ে করাতে সব টেস্ট। এতে দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে গুণতে হয় অনেক টাকা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালটির টয়লেটগুলো পরিণত হয়েছে ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে। হাসপাতালটির ওয়ার্ডগুলোতে রোগীদের থাকার মতো মান নেই। বাথরুমগুলো ব্যবহার করার মতো অবস্থা নেই। অথচ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য হাসপাতালে রয়েছেন শতাধিক কর্মী।
হাসপাতালের ভেতরে বিভিন্ন স্থানে সন্ধ্যার পর থাকে না আলোর ব্যবস্থা। সন্ধ্যার পর হাসপাতালের বিভিন্ন ফ্লোরের লাইটগুলো বন্ধ থাকায় এক রকম ভূতুড়ে অবস্থা বিরাজ করে হাসপাতালটিতে। সন্ধ্যার পর হাসপাতালে প্রবেশ করে বিভিন্ন ফ্লোরে গেলে মনে হবে বিদ্যুৎবিহীন অন্ধাকার কোনো বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করেছি।
অথচ প্রত্যেকটি ফ্লোরে দামি লাইট লাগানো থাকার কথা। তাছাড়া দেখা গেছে, কেউ না থাকলেও অযথাই ফ্যান চলছে। বন্ধ করার মতো দ্বায়িত্ব কারো নেই।
এছাড়াও মূল হাসপাতালের ভেতরে অবাধে মোটরসাইকেল নিয়ে প্রবেশ করতে দেখা গেছে অনেককে। অনুমতি না থাকলেও হাসপাতালের ভেতরে সারিবদ্ধভাবে অনেক মোটরসাইকেল পার্কিং করা দেখা গেছে। একজনকে মোটরসাইকেল নিয়ে কেন হাসপাতালের ভেতরে ঢুকেছেন জিজ্ঞেস করলে বলেন, সরি আমার ভুল হয়েছে, আমি নান্দাইল হাইস্কুলের শিক্ষক।
এদিকে মোটরসাইকেল নিয়ে হাসপাতালের ভেতরে প্রবেশ করতে বাধা দেওয়া হলে দ্বায়িত্বরত আনসার সদস্যদের সঙ্গে মোটরসাইকেল আরোহীরা খারাপ ব্যবহার করেন বলে জানিয়েছেন দ্বায়িত্বে নিয়োজিত আনসার সদস্যরা। অনেক সময় স্থানীয় প্রভাবশালীরা আনসার সদস্যদের মারতেও উদ্যত হন বলে জানান তারা। তাদের কোনো বাধা স্থানীয় প্রভাবশালীরা মানেন না। যার ফলে মূল হাসপাতালে অবাধে মোটরসাইকেল নিয়ে প্রবেশ করছেন হাসপাতালের স্টাফসহ অন্যরা। এতে রোগীসহ সবার চলাচলে ব্যাঘাত ঘটছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, হাসপাতালের ভেতরে মোটরসাইকেল নিয়ে প্রবেশ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, এটা বেআইনি। তারপরেও যারা প্রবেশ করেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।