মো. এ কে নোমান, নওগাঁ প্রতিনিধি: নওগাঁ জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম নেওয়া শাবানা ইয়াসমিন আজ দেশের সফল নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে একটি অনন্য উদাহরণ। কঠোর পরিশ্রম এবং অদম্য ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে তিনি জীবনকে নতুন রূপ দিয়েছেন। এক সময়ের অচেনা শাবানা আজ নারীদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছেন। তার প্রতিষ্ঠান “আমার স্বপ্ন আমার সংগ্রাম” শুধু তার নিজের জীবনই বদলে দেয়নি, বরং আরও শতাধিক নারীকে দিয়েছে আত্মনির্ভরশীলতার দিশা।
নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুর ইউনিয়নের হর্ষি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন শাবানা। তিনি তার পরিবারে চার বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। তার বাবা, মৃত কবির উদ্দিন, ছিলেন পরিবারের প্রধান অভিভাবক। ছোটবেলা থেকেই শাবানা ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাবান এবং সৃজনশীল। নাচ, গান, কবিতা আবৃত্তি এবং নানা সৃজনশীল কাজে তার দক্ষতা দেখে সবাই মুগ্ধ হতেন। কিন্তু সেই প্রতিভার বিকাশ ঘটার আগেই মাত্র ১৬ বছর বয়সে পারিবারিক ভাবে তাকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হয়।
২০০৯ সালের ১১ ডিসেম্বর শুরু হয় তার দাম্পত্য জীবন। কিন্তু এই জীবনে তিনি সুখের দেখা পাননি। দাম্পত্য জীবনের টানাপোড়েন এবং মানসিক চাপে তিনি আট বছর কাটান। শেষমেশ ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর তার বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। বিচ্ছেদের পর, সমাজের নানা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং আর্থিক সংকটে পড়লেও শাবানা থেমে থাকেননি।
বিবাহ বিচ্ছেদের পর শাবানা নিজের জীবনকে নতুনভাবে সাজানোর সিদ্ধান্ত নেন। জীবিকা নির্বাহ এবং আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্য তিনি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ শুরু করেন। প্রথমে ২০১৮ সালে তিনি নওগাঁ মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে বিউটিফিকেশন প্রশিক্ষণ নেন। এরপর টিটিসি থেকে কম্পিউটার অপারেশনের প্রশিক্ষণ এবং যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরে পোশাক তৈরির প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
শাবানা জানান, “বিবাহবিচ্ছেদের পর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল কঠিন পরীক্ষা। সমাজের কথা এবং বাস্তবতার চাপ আমাকে ভেঙে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। সন্তানকে ঘিরে স্বপ্ন দেখেছি এবং নিজেকে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি।
২০১৮ সালে আমি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিই—বিউটিফিকেশন, ফুড প্রসেসিং, পোশাক তৈরি এবং কম্পিউটার অপারেটরসহ নানা বিষয়ে। এগুলো আমাকে দক্ষতা আর আত্মবিশ্বাস দিয়েছে।
বর্তমানে ‘আমার স্বপ্ন আমার সংগ্রাম’ প্রতিষ্ঠানে এখন ত্রিশ জনেরও বেশি নারী কাজ করছেন। কেউ কারখানায়, কেউ বাড়িতে বসে কাজ করছেন। আমরা পাটের তৈরি মানিব্যাগ, লেডিস ব্যাগ, শাড়ি, নকশীকাঁথা ইত্যাদি তৈরি করি। আমি চাই প্রতিটি নারী স্বাবলম্বী হোক, নিজের পরিচয় গড়ে তুলুক।
আমার স্বপ্ন আরও বড়। আমি চাই, আমার প্রতিষ্ঠানের পণ্য দেশের বাইরেও পৌঁছাক। আমি চাই, আমার মতো আরও নারী উদ্যোক্তা তৈরি হোক। কঠিন পরিস্থিতি কাটিয়ে কীভাবে সফল হতে হয়, আমি তা দেখাতে চেয়েছি।”
শাবানার একমাত্র সন্তান মো. রবিউল স্থানীয় একটি হাফিজিয়া মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছে। তার স্বপ্ন তার ছেলে একজন ভালো মানুষ হয়ে উঠবে। অন্যদিকে, নিজের প্রতিষ্ঠানকে আরও বড় পরিসরে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি নিরলস পরিশ্রম করছেন। তার লক্ষ্য, দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারেও তার পণ্য ছড়িয়ে দেওয়া।
শুধু এখানেই থেমে থাকেননি তিনি। নওগাঁ বিসিক এবং রাজশাহী বিসিকে শিল্প উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের ওপর একাধিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এভাবে নিজের দক্ষতা বাড়িয়ে তিনি আত্মবিশ্বাস অর্জন করেন এবং একটি উদ্যোগ চালুর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন।
২০২২ সালে নওগাঁ শহরের কাজী মোড়ের উকিলপাড়া এলাকায় শাবানা প্রতিষ্ঠা করেন “আমার স্বপ্ন আমার সংগ্রাম”। তার এই প্রতিষ্ঠানটি মূলত পাটজাত হস্তশিল্প সামগ্রী এবং বিভিন্ন ধরনের সৃজনশীল পণ্য তৈরির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এখানে বর্তমানে ত্রিশ জনের বেশি নারী কাজ করছেন। কেউ সরাসরি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন, আবার কেউ বাড়ি থেকে কাজ করছেন।
প্রতিষ্ঠানে তৈরি পণ্য গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পাটের মানিব্যাগ, লেডিস ব্যাগ, স্কুল ব্যাগ, ল্যাপটপ ব্যাগ, শপিং ব্যাগ, জানালার পর্দা, টেবিল মেট, গ্লাস মেট, এবং নকশীকাঁথা। প্রতিটি পণ্য অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তৈরি হয় এবং এসব পণ্যের মান ক্রেতাদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।
শাবানার প্রতিষ্ঠানে তৈরি পণ্যগুলোর দাম যেমন সাশ্রয়ী, তেমনি মানেও চমৎকার। পাটজাত মানিব্যাগের দাম মাত্র ৬০ টাকা, লেডিস পার্স ১৪০ টাকা, ল্যাপটপ ব্যাগ ২৫০ টাকা, জানালার পর্দা ৬০০ টাকা, এবং শাড়ি বা নকশীকাঁথার মতো পণ্য ১০০০-১৫০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়। এ ধরনের পণ্য স্থানীয় বাজার ছাড়াও আশপাশের জেলাগুলোতে ক্রেতাদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
শাবানার উদ্যোগ শুধু তার নিজের জীবনের পরিবর্তন আনেনি, বরং আরও বহু নারীর জন্য জীবিকার ব্যবস্থা করেছে। এখানে কাজ করা নারীরা কেউ নতুনভাবে কাজ শিখছেন, আবার কেউ তাদের আগের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে আয় করছেন।
মোছা. কাজলি বানু, যিনি তিন বছর ধরে এখানে কাজ করছেন, বলেন, “আমার আগে থেকেই সেলাইয়ের অভিজ্ঞতা ছিল। এখানে কাজ করে নতুন অনেক কিছু শিখেছি। উপার্জিত অর্থ দিয়ে আমার সংসারের খরচ চালাই।”
খাদিজা বানু সমাপ্তি, ডিগ্রি প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থী, জানান, “ছোটবেলা থেকেই রং করা এবং নকশা আঁকার প্রতি আমার আগ্রহ ছিল। এখানকার কাজের সাথে সেই আগ্রহের মিল খুঁজে পেয়েছি। পড়াশোনার পাশাপাশি আমি নিজের হাতখরচ চালানোর জন্য এখানে কাজ করি।”
রিয়া রানী নামে এক নতুন কর্মী বলেন, “আমি শাবানার গল্প শুনে এখানে এসেছি। তার কাজ আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। এখন আমি কাজ শিখছি এবং পাশাপাশি কিছু অর্থ উপার্জন করছি। ভবিষ্যতে আমি নিজেও একজন সফল উদ্যোক্তা হতে চাই।”
শাবানা ইয়াসমিন দেখিয়েছেন, ইচ্ছাশক্তি, কঠোর পরিশ্রম এবং সঠিক দিকনির্দেশনা থাকলে একজন নারী নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। তার সংগ্রামী জীবনের গল্প শুধু নারীদের জন্য নয়, সমাজের প্রতিটি মানুষের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। শাবানার এই যাত্রা আজ নওগাঁর সীমানা পেরিয়ে সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
এমকে/আস্থা