খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানকে যাবতীয় কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার নির্দেশ
স্টাফ রিপোর্টারঃ
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরা, জেলা পরিষদের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রতিপদ দেওয়ান, জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মাহফুজ, জেলা পরিষদের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা আশীষ চাকমার বিরুদ্ধে প্রকল্পের অর্থ ছাড়ের বিপরীতে বরাদ্দের ১০ শতাংশ পার্সোনাল কমিশন (পিসি) দাবি করার অভিযোগ উঠেছে। খাগড়াছড়ির মাস্টারদা সূর্য সেন গণপাঠাগার যাহার রজিঃ নং- খাগড়া-২৭/২০২৩), এর সাধারণ সদস্য (সাবেক সহ-সভাপতি) মোঃ আরাফাত হোসেন রিজভী দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো এক আবেদনে এ অভিযোগ করেন।
দুদক চেয়ারম্যানের বরাবরে করা আবেদনে তিনি উল্লেখ করেছেন, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় মাস্টারদা সূর্য সেন গণপাঠাগার কেন্দ্রের উদ্যোগে গ্রুপ ভিত্তিক বই পড়া কর্মসূচি পালন, ১৫৫ নং প্রকল্পে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরাসহ ৩ কর্মকর্তা অর্থ ছাড়ের প্রস্তাব প্রেরণে অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছে।
অভিযোগপত্রে তিনি আরও উল্লেখ করেন, গত ১৭/১২/২০২৪ খ্রিস্টাব্দে গণপাঠাগারর সভাপতি মোঃ সামছুল ইসলাম তপনর লিখিত আবেদনের সূত্র ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয় আবেদনের সূত্র ধরে জানুয়ারী/ ২০২৫ খ্রিঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন সহায়তা (কাড নং-২২১০০০৯০০) এর আওতায় খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় মাস্টারদা সূর্য সেন গণপাঠাগার কেন্দ্রের উদ্যোগে গ্রুপ ভিত্তিক বই পড়া কর্মসূচি পালন, ১৫৫ নং প্রকল্পে সর্বমোট ৫০ লাখ টাকা অর্থ বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছিল। এর মধ্যে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের বরাদ্দ ছিল ৩০ লাখ টাকা এবং ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের বরাদ্দ ২০ লাখ টাকা।
উপরোক্ত প্রকল্পের বিষয়ে উন্নয়ন স্কিম প্রণয়নের জন্য গত ১০ ফেব্রুয়ারি/২০২৫ইং প্রকল্পের কাগজ নিয়ে জেলা পরিষদের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রতিপদ দেওয়ানের নিকট গণপাঠাগার পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোঃ সামছুল ইসলাম তপন, সাধারণ সম্পাদক উষা মারমা, লাইব্ররিয়ান চরন বিকাশ ত্রিপুরা এবং কার্যনির্বাহী সদস্য সাজাই চাকমাসহ গেলে তিনি বলেন, টাকা ছাড়া কোনো কাজ হবে না। এরপর থেকেই শুরু হয় হয়রানি।
পার্বত্য জলা পরিষদ, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জলার স্মারক নং- ২৯.২৩৬.০১৪.৪৪.০০.১২০.২০২৪- ২৫/২৬৮, তারিখ: ০৮/০৫/ ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ এবং অফিস আদেশ মূলে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি গঠিত হওয়ায় উক্ত প্রকল্প বাস্তবায়নর জন্য প্রকল্পের প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০২৪-২৫ অর্থ বছর বাজট ৩০ (ত্রিশ লক্ষ) টাকার মধ্যে অগ্রিম ১৪,৯৬,০০০/-(চৌদ্দ লক্ষ ছিয়ানবই হাজার) টাকা অর্থ ছাড়ের জন্য গত ১৩/০৫/২০২৫ খ্রিস্টাব্দ তারিখ মিসেস শেফালিকা ত্রিপুরা, আহবায়ক, প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি ও সদস্য, পার্বত্য জেলা পরিষদ, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা কর্তক আবেদনের পর উপরোক্ত আশীষ চাকমা তাহার পিসির জন্য ফাইল আটক রাখেন এবং ২৫/০৫/২০২৫ তারিখ নির্বাহী প্রকৌশলী প্রতিপদ দেওয়ান ৫% পিসি দাবী করেন।
একই দিন নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মাহফুজ ৫% পিসি দাবী করেন, নতুবা ১৪,৯৬,০০০/-(চৌদ্দ লক্ষ ছিয়ানবই হাজার) টাকার আবেদন নামঞ্জুর হবে।
প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রয়াজনীয় বই ক্রয়ের অর্থ ছাড়ের চেক স্বাক্ষর করাতে ২৯মে/২০২৫ খ্রিস্টাব্দ সকাল ১০ টার দিকে নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মাহফুজের কাছে উপস্থাপন করা হলে, তিনিও ৫% পিসি না পাওয়ার কারনে স্বাক্ষর প্রদানে অস্বীকৃতি জানান।
প্রকল্পের অর্থ ছাড়ে বরাদ্দের বিপরীতে চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরা ১০ শতাংশ, নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মাহফুজ ৫ শতাংশ, নির্বাহী প্রকৌশলী প্রতিপদ দেওয়ান ৫ শতাংশ, মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে নিয়োজিত ব্যক্তিগত কর্মকর্তা আশীষ চাকমা ২ শতাংশ পিসি দাবি করেন।
অপর দিকে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বরাদ্দকৃত দ্রব্যাদি অর্ধেক করার জন্য নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে বিকালে সহকারী প্রকৌশলী এবং হিসাব ও নিরীক্ষা কর্মকর্তা প্রকল্পের অনুমাদিত প্রাক্কলন অনুযায়ী বই ক্রয়ের কপি দেখানার পর অনেক গড়িমসি করে নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ ও চেয়ারম্যান মিজ জিরুনা ত্রিপুরা ১৪,৯৬,০০০/-(চৌদ্দ লক্ষ ছিয়ানবই হাজার) টাকার চেক স্বাক্ষর করলেও তা হিসাব শাখায় প্রেরণ করেন নাই এবং মিসেস শেফালিকা ত্রিপুরাকে প্রদান করেন নাই।
প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্পের প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে বাজেট ৩০ লাখ টাকার মধ্যে অগ্রিম ১৪ লাখ ৯৬ হাজার টাকা অর্থ ছাড়ের জন্য খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ সদস্য ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক গত ১৩ মে শেফালিকা ত্রিপুরা আবেদন করেন। উক্ত প্রকল্পে পিসি না পাওয়ার কারণে চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরা রাগান্বিত হয়ে গত ২ জুন সহকারী প্রকৌশলী অপু বড়ুয়ার শার্টের কলার ধরে তাকে বের করে দেন।
তারপর মিসেস শেফালিকা ত্রিপুরাকে ১৪ লাখ ৯৬ হাজার টাকার চেক প্রদান করেন। এরপরও নানা রকম হয়রানি অব্যাহত রয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে দুদক চেয়ারম্যান বরাবর করা আবেদনপত্রে।
অভিযোগ পত্রে আরও উল্লেখ করা হয়
১৪,৯৬,০০০/-(চৌদ্দ লক্ষ ছিয়ানবই হাজার) টাকার বিপরীতে “উনত জীবন” বই ৮,০০০ (আট হাজার) কপি ও “ইতিবাচক মানসিক পরিবর্তন” বই ৮,০০০ (আট হাজার) কপি জরুরি ভিত্তিত ক্রয় করার জন্য পাবলিক প্রকিউরমট বিধিমালার বিধি- ৭৬(১) (ক) মোতাবেক গত ২/৬/২০২৫ খ্রিস্টাব্দ তারিখে সরাসরি বই ক্রয়ের দরপত্র বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেন এবং তৎপ্রেক্ষিতে ৩ (তিন) টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান/সরবরাহকারী প্রয়োজনীয় কাগজাদিসহ দরপত্র দাখিল করেন। দরপত্র মূল্যায়ন করে সর্বনিন্ম দরদাতার নিকট থেকে সরাসরি বই ক্রয় করে নগদ অর্থ পরিশোধ করা হয়। পরবর্তীত উক্ত বিল সম্মনয়ের জন্য গত ১৮/০৬/২০২৫ খ্রিস্টাব্দ তারিখে আবেদন দাখিল করা হলও উপরোক্ত পিসিখোর কর্মকর্তাগণ নানান ছলছাতুরি শুরু করে।
খাগড়াছড়ির মাস্টারদা সূর্য সেন গণপাঠাগারের সাধারণ সদস্য মোঃ আরাফাত হোসেন রিজভী দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো তার আবেদন প্রসঙ্গে বলেন, আমার অভিযোগ বিস্তারিতভাবে লিখে তথ্য-প্রমাণসহ ৬ জুলাই রোববার ডাকযোগে অভিযোগপত্র দুদক চেয়ারম্যান বরাবর পাঠিয়েছি।
অন্যদিকে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ সদস্য ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক শেফালিকা ত্রিপুরা বলেন, নির্বাহী কর্মকর্তা বা অন্যান্য কর্মকর্তার বিষয়টি আমি জানি না, চেয়ারম্যান ম্যাডামের বিষয়টি জানি, তিনি ১৪ লাখ ৯৬ হাজার টাকার চেক দিতে ১ লাখ টাকা নিয়েছেন।
নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মাহফুজ বলেন, তারা আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এনেছে তার পক্ষে যদি কোনো প্রমাণ দিতে পারে তাহলে আমাকে যে শাস্তি দেয়া হবে, আমি মাথা পেতে নেব।
খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রতিপদ দেওয়ানের মোবাইলে একাধিকবার ফোন করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরা মোবাইলে বলেন, এসব ভুয়া অভিযোগ, মাস্টারদা সূর্য সেন গণপাঠাগারের প্রকল্পটাই ভুয়া, এটা নিয়ে আমাদের তদন্ত করে দেখতে হবে।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরার বিরুদ্ধে অসদাচারণ ও দুর্নীতির অভিযোগ দাখিলের পরিপ্রেক্ষিতে পরিষদের সকল প্রকার কার্যক্রম হতে বিরত থাকার নির্দেশনা প্রদান করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সিনিয়র সহকারী সচিব তাসলীমা বেগম স্বাক্ষরিত নোটিশে আজ ৭ জুলাই ২০২৫ খ্রিঃ বিকেলে এই পরিপত্র জারি করা হয়। যাহার নাম্বার পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় নোটিশের নম্বরঃ ২৯,০০০০.০০.২১৪.১৮.০০২২.২৪ (খন্ড)-৪৪ স্মারক মুলে এ আদেশ জারী করে।
নোটিশে বলা হয়, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরার বিরুদ্ধে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের ১৪ জন সদস্য কর্তৃক সদস্যদের অবমূল্যায়ন, খারাপ আচরণ, হস্তান্তরিত বিভাগের প্রধান ও কর্মচারীদের সাথে অসদাচারণ, স্বেচ্ছাচারিতা, স্বজনপ্রীতিসহ শিক্ষকবদলি বাণিজ্য, ঠিকাদার বিলের ফাইল আটকিয়ে রেখে ঘুষ বাণিজ্য এবং চরম দুর্নীতির অভিযোগ দাখিল করা হয়। অভিযোগটি বর্তমানে তদন্তাধীন রয়েছে।
অভিযোগের বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের সকল প্রকার কার্যক্রম হতে বিরত থাকার জন্য তাকে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়।
উল্লেখ্য, জিরুনা ত্রিপুরা ২০২৪ সালের ৭ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের ১০ম অন্তর্বর্তীকালীন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৮৯ সালের পর খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠনের পর থেকে প্রথমবারের মতো কোনো নারী চেয়ারম্যান হিসেবে এই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।