➤ এক সাংস্কৃতিক সম্পাদকীয় দৃষ্টিতে বাউল সম্রাটের উত্তরাধিকার ও বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা
মানবতার আলোর পথে: লালন দর্শনের নতুন পাঠ
- আপডেট সময় : ১২:৪৪:০০ অপরাহ্ন, সোমবার, ২০ অক্টোবর ২০২৫
- / ৬৯৯৬০ বার পড়া হয়েছে
Photo Collected
বাউল সম্রাট লালন মানবতার অমৃতধারা আজও জেগে আছে ছেউড়িয়ায়। মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি — এই বাণী আজও পথ দেখায় বিশ্বমানবতাকে
কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায় আবারও জেগে উঠেছে বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের স্মৃতিধারা। তাঁর ১৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী সধুসঙ্গ ও বাউল মেলা বসেছে আখড়াবাড়িতে। তীর্থযাত্রার মতো হাজারো লালনভক্ত, গবেষক ও দেশি-বিদেশি পর্যটকের পদচারণায় মুখরিত পুরো এলাকা।
জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, এবারের আয়োজনে অংশ নিয়েছে প্রায় এক লক্ষাধিক মানুষ।
—
লালনের জীবন, ভাব ও দর্শন
লালন শাহ— নামটির মধ্যেই যেন এক মুক্তির ধ্বনি বাজে। তিনি ছিলেন জাত, ধর্ম, বর্ণ ও বিভাজনের বিপরিতে এক মানুষ। বাউল গানকে তিনি রূপ দিয়েছিলেন আত্মসাধনা ও প্রতিবাদের এক সুরে।
তাঁর জন্মস্থান নিয়ে মতভেদ থাকলেও ইতিহাস বলে, কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ছেউড়িয়ায়ই তিনি তাঁর চিন্তার বীজ বপন করেন। এক তীর্থযাত্রায় অসুস্থ হয়ে পড়লে এক মুসলিম পরিবার তাঁকে আশ্রয় দেয়— সেই মানবিক পরশই বদলে দেয় তাঁর জীবনধারা। মানুষই মানুষের বড় পরিচয়— এই উপলব্ধিই তাঁকে করে তোলে এক চিরমুক্ত বাউল।
তিনি বলেছিলেন, “সব লোকে কয় লালনের জাত সমশারে, লালন কয় জতের কী রূপ দেখলাম না এ নজরে।” এই এক পঙ্ক্তিতেই লুকিয়ে আছে তাঁর জীবনের সারসংক্ষেপ— মানুষই তাঁর ধর্ম, মানবতাই তাঁর সাধনা।
লালনের মতে, “দেহের ভিতরেই দেহাত্ত্ব”— অর্থাৎ মানবদেহই সত্যের মন্দির। তাঁর গান শুধু সুর নয়, এটি ছিল সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে নরম প্রতিবাদের ভাষা।
—
আজকের পৃথিবীতে লালনের প্রাসঙ্গিকতা
২০২৫ সালের এ সময়ে যখন মানুষ ধর্মীয় বিভাজনে বিভ্রান্ত, যখন সমাজে হিংসা ও বৈষম্যের আগুন জ্বলছে, তখন লালনের বাণী আমাদের শেখায় সহানুভূতি ও সহমর্মিতা। তিনি বলেছিলেন, “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।”
এই সরল বাণীর মধ্যেই আছে শান্তি, প্রেম আর মানবতার চাবিকাঠি।
তাঁর গান আজও শোনায়, মানুষকে মানুষ হিসেবে ভালোবাসার আহ্বান। লালনের দর্শন যদি আমরা কর্মে ও চেতনায় ধারণ করতে পারি, তবে এই অস্থির সমাজে ফিরে আসবে মানবতার সুবাস।
—
২০২৫ সালের আয়োজনে নতুন মাত্রা
লালনের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী মেলায় অনুষ্ঠিত হয়েছে আলোচনা সভা, বাউল সঙ্গীত পরিবেশনা ও আলোকসজ্জার অনুষ্ঠান। মেলার শেষ রাতে আখড়াবাড়ি প্রাঙ্গণে একযোগে গাওয়া হয় লালনের বিখ্যাত গান “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়”।
ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়েছে “লালন সন্ধ্যা” শিরোনামের এক বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যেখানে বাংলাদেশের খ্যাতনামা শিল্পীরা পরিবেশন করেন লালনের গান।
ছেউড়িয়ার বাতাসে আজও ভেসে বেড়ায় সেই অমলিন বাণী—
“আমি কে তুমি কে, এই জানার মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানুষের চূড়ান্ত মুক্তি।”
—
সমাপ্তি
লালন শাহ কোনো সময়ের গণ্ডিতে বাঁধা নন। তিনি ছিলেন এবং থাকবেন— যতদিন মানুষ মানবতাকে বাঁচিয়ে রাখবে, ততদিন জেগে থাকবেন এই বাউল সম্রাট, চিরমুক্ত আত্মার আলোকবর্তিকা।
এমএইচ মানিক
সাংস্কৃতিক সম্পাদক, ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস ক্রাইম রিপোর্টার ফাউন্ডেশন।