ঢাকা ওয়াসার সরবরাহকৃত এক হাজার লিটার পানির দাম আবাসিক পর্যায়ে ১৪.৪৬ টাকা এবং বাণিজ্যিক পর্যায়ে তা ৪০ টাকা। অর্থাৎ বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত প্রতি এক হাজার লিটার পানির দাম আবাসিকের চেয়ে ২৫.৫৪ টাকা বেশি। একইভাবে বাণিজ্যিকে বিদ্যুতের দামও আবাসিকের প্রায় দ্বিগুণ।
এই সুযোগে ওয়াসা ও বিদ্যুত বিভাগের এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী ঢাকা মহানগরীতে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের পানি ও বিদ্যুতের বিল আবাসিক রেটে করিয়ে দিয়ে বছরে প্রায় ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। একই কৌশলে চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরেও বিদু্যৎ ও পানির বিলে বছরের পর বছর ধরে ব্যাপক লুটপাট চলছে। এতে সরকারের বছরে কয়েকশ কোটি টাকা রাজস্ব গচ্চা যাচ্ছে। বিষয়টি ওপেন-সিক্রেট হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিনেও এ অবৈধ কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
২০১৮ সালের ৫ জুলাই হাইকোর্ট রাজধানীর গুলশান, বনানী, বারিধারা ও ধানমন্ডি থেকে সব ধরনের অবৈধ স্থাপনা ও বাণিজ্যিক ভবন সরিয়ে নেওয়ার জন্য ১০ মাস সময় বেঁধে দেয়। একই সঙ্গে বিদ্যুত, পানি ও গ্যাসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কথা বলা হয়। পরে গণপূর্ত বিভাগ ও বিদু্যৎ বিভাগ সমন্বয় সভা করে এসব এলাকার বিদু্যৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ কেটে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে নির্ধারিত সময়ের পর আরও ১৬ মাস পেরিয়ে গেলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, উত্তরা, গুলশান ও বনানীসহ ৫টি অভিজাত এলাকার আবাসিক ভবনে সাড়ে ৬ হাজার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে। এছাড়া নগরীর পলস্নবী, মিরপুর, লালমাটিয়া, খিলগাঁও ও মালিবাগসহ অন্যান্য আবাসিক এলাকায় প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার ভবনের নিচতলা, এমনকি অনেক বাড়ি দোতলা-তিনতলাতে ছোট-বড় শোরুম ও বুটিক শপসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ভাড়া দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে আবাসিক ভবনে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ছোটবড় দোকানপাটসহ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৫ হাজারের বেশি।
এর মধ্যে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের সংযোগ বাণিজ্যিক হলেও প্রায় ১৫ হাজার প্রতিষ্ঠান আবাসিক রেটে পানি ও বিদু্যতের বিল দিচ্ছে। প্রত্যেক বিলে নূ্যনতম ৩ হাজার টাকা করে কম দিলে এ হিসাবে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ৬ হাজার টাকা কম পরিশোধ করছে। ১৫ হাজার প্রতিষ্ঠান থেকে এ হিসাবে সরকার মাসে ৯ কোটি টাকা এবং বছরে ১০৮ কোটি টাকা কম রাজস্ব পাচ্ছে।
পাকিস্তানে চাইনিজ ভিডিও অ্যাপ্লিকেশন টিকটক নিষিদ্ধ
স্থানীয় এলাকাবাসী ও বাড়িমালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাণিজ্যিকে আবাসিক বিল দেখিয়ে ওইসব প্রতিষ্ঠানের ফাঁকি দেওয়া অর্থের অর্ধেক ডেসকো-ডিপিডিসি ও ওয়াসার মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রতি মাসে নগদ নিয়ে যাচ্ছেন। তবে বিষয়টি উভয়পক্ষের মধ্যে গোপন থাকছে। আইন অমান্য করে বাড়িমালিকরা আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ভাড়া দেওয়ার কারণে বিষয়টি নিয়ে চুপচাপ থাকছেন। লাইনম্যান ও বিল রিডার থেকে শুরু করে জোনাল অফিসের শীর্ষ কর্মকর্তা পর্যন্ত সবাই উপরি এ অর্থের ভাগ পাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কেউ কেউ এ অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করেন এরকম কিছুই হয় না। তারা বলেন, আবাসিকের নিচতলায় ভাড়া দেওয়া ছোটখাটো কিছু দোকানপাটে হয়তো বাণিজ্যিক বিল নেওয়া হচ্ছে না। তবে আবাসিক ভবনে যেসব বড় শো-রুম, হোটেল-রেস্টুরেন্ট ও কারখানা রয়েছে সেখানে বাণিজ্যিক রেটেই তারা বিল আদায় করছেন। আবাসিক লাইন নিয়ে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার অভিযোগ পাওয়া গেলে ওই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হচ্ছে। তবে তারা স্বীকার করেন, গোপনে দুর্নীতিবাজ কিছু লাইনম্যান ও মিটার রিডার এ ধরনের অপতৎপরতা চালাতে পারে।
উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরের ৬ ও ১৩ নম্বর রোডে আবাসিক অ্যাপার্টমেন্টের কার পার্কিংয়ে দুইটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর রয়েছে। যার পানি ও বিদু্যৎ সংযোগ আবাসিক। এ প্রতিষ্ঠান দু’টিতে গড়ে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা পানি ও বিদু্যতের বিল আসছে। অথচ আবাসিক রেটে বিল নেওয়া হলে তা অনায়াসে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায় দাঁড়াতো। প্রতিষ্ঠান দুটির মালিক আবুল হোসেন নিজেও তা স্বীকার করেছেন। অর্থাৎ বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত বিদু্যৎ ও পানির আবাসিক রেটে বিল দেওয়ায় ওই দুইটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরেই সরকারের প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৮ হাজার টাকা গচ্চা যাচ্ছে, যা বছর হিসেবে দাঁড়ায় প্রায় এক লাখ টাকা।
মালিবাগের শহীদ বাকী সড়কের ৪১২ হোল্ডিংস্থ ছয়তলা অ্যাপার্টমেন্টের গত এক বছরের ওয়াসার বিল ঘেঁটে দেখা গেছে, গোটা ভবনের পানির বিল আবাসিক রেটেই করা হয়েছে। অথচ ভবনটির নিচ তলায় বছর দেড়েক ধরে রেন্ট-এ কারের অফিস এবং একটি কার ওয়াশিং সেন্টার রয়েছে। ওই ভবনের ওয়াসার পানির লাইনে পাইপ লাগিয়ে প্রতিদিন ১৫-২০টি গাড়ি ধোয়া হচ্ছে। অথচ গোটা বাড়ির পানির মিটার একটিই। ভবনটিতে গড়ে ১৫ হাজার টাকা বিল এলে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত পানির জন্য আরও অতিরিক্ত ৫-৬ হাজার টাকা যোগ হওয়ার কথা।
শহীদ বাকী সড়কের পাশের লেনের ৩৯৪ নম্বর হোল্ডিংয়ের নিচতলায় তিনটি মাঝারি আকারের টেইলার্স রয়েছে। সেখানে দিনরাত প্রায় ডজনখানে ইলেকট্রিক সুইং মেশিন চলছে। এছাড়া সেখানে তৈরি পোশাক ইস্ত্রিও করা হচ্ছে। এসব টেইলার্স মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের গড়ে তিন থেকে সাড়ে তিনশ ইউনিট বিদু্যৎ খরচ হচ্ছে। আবাসিক রেটে তারা ১৮শ থেকে দুই হাজার টাকা বিল দিচ্ছে। অথচ বাণিজ্যিক রেটে হলে তাদের প্রত্যেককে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা বিল দিতে হতো।
শুধু এই কয়েকটি প্রতিষ্ঠানই নয়, রাজধানীর আবাসিক এলাকার প্রশস্ত রাস্তা এবং অলিগলিতে হাজার হাজার হোটেল-রেস্টুরেন্ট ও শোরুম রয়েছে। যার একটি বড় অংশ আবাসিক রেটে পানি ও বিদু্যতের বিল পরিশোধ করছে।
প্রসঙ্গত, আবাসিকে লাইফ লাইন (০-৫০) ইউনিট ৩.৭৫ টাকা, প্রথম ধাপ (১-৭৫ ইউনিট) ৪.১৯ টাকা, দ্বিতীয় ধাপ (৭৬-২০০ ইউনিট) ৫.৭২ টাকা, তৃতীয় ধাপ (২০১-৩০০ ইউনিট) ৬ টাকা, চতুর্থ ধাপ (৩০১-৪০০ ইউনিট) ৬.৩৪ টাকা, পঞ্চম ধাপ (৪০১-৬০০ ইউনিট) ৯.৯৪ টাকা, ষষ্ঠ ধাপ (৬০০ ইউনিটের অধিক) ১১.৪৬ টাকা। ডিমান্ড রেট/চার্জ ৩০ টাকা। অন্যদিকে বাণিজ্যিক এবং অফিসে ব্যবহৃত বিদু্যতের ফ্ল্যাট রেট ১০.৩০ টাকা, অফ পিক আওয়ারে ৯.২৭ টাকা এবং পিক আওয়ারে ১২.৩৬ টাকা। ডিমান্ড রেট/চার্জ ৬০ টাকা।
এ বিষয়ে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ান যায়যায়দিনকে বলেন, আবাসিক এলাকা থেকে অবৈধ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সরানো সম্ভব না হওয়ায় সরকারের উপরমহলের নির্দেশে তাদের কাছ থেকে বাণিজ্যিক রেটে বিদু্যৎ বিল নেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার এ ধরনের প্রতিটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে কমার্শিয়াল বিদু্যৎ বিলের আওতায় আনা হয়েছে। আবাসিক বৈদু্যতিক সংযোগ নিয়ে তা বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারের অভিযোগ পাওয়া গেলে তিনি নিজে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন বলে জানান।
এদিকে ডিপিডিসির খিলগাঁও জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী মোশারফ হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, আবাসিকে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার বৈধতা না থাকলেও এ ধরনের বিপুলসংখ্যক প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন পরিচালিত হচ্ছে। তাই নিরুপায় হয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের বিদু্যৎ বিল কমার্শিয়াল করে দিয়েছেন।
এ জোনে এখনো বিপুলসংখ্যক আবাসিক ভবনে একই মিটার দিয়ে বাসা ও দোকানপাটে বিদু্যৎ ব্যবহার করা হচ্ছে- এমন অভিযোগের কথা জানানো হলে মোশারফ হোসেন বলেন, এ ধরনের অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেলে ওই ভবনের বিগত সময়ের বিলও কমার্শিয়াল রেটে আদায় করা হবে। -যায়যায়দিন