নিজস্ব প্রতিবেদক: তথাকথিত আইপিটিভি (ইউটিউব), অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং প্রেস লেখা স্টিকার, আইডি কার্ড ঝুলিয়ে অবাধে চলাচল করছে চিহ্নিত অপরাধীরা।
এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো অনুমোদন নেই। রাজধানী সাংবাদিকতার নাম ভাঙিয়ে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে ভুয়া সাংবাদিকদের দৌরাত্ম্য।
এর মধ্যে অন্যতম হলো অনুমোদনহীন সিএনএন বাংলা টিভি, বিজয় ৭১ টিভি, চ্যানেল ২৬ নামের ভুয়া টেলিভিশন। লাইসেন্সবিহীন ভুয়া টিভি ডিশের সঙ্গে সেট টপ বক্স বসিয়ে মূল স্যাটেলাইট টেলিভিশনের মতো টকশো, নিউজ, স্ক্রল, বিজ্ঞাপন প্রচার করছে, যা আইনপরিপন্থি।
সিএনএন বাংলা টিভির বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। টাকার বিনিময়ে সারা দেশে প্রতিনিধি নিয়োগ, যানবাহনের চালকদের স্টিকার প্রদান এবং অফিসে প্রতিদিন জুয়া, মাদকের আসর বসিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এসব কথিত টিভির মালিকরা। সিএনএন বাংলা টিভির মালিক শাহিন আল মামুনের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। তার প্রধান সহযোগী হিসাবে রয়েছে চিহ্নিত অপরাধী ও মাদক ব্যবসায়ী আবু শাকের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী বলেন, লোক মারফত জানতে পারি, এ টিভি চ্যানেলে কিছু প্রেজেন্টার নেওয়া হবে। আগ্রহী হয়ে অফিসে যোগাযোগ করি।
ইন্টারভিউয়ের জন্য আবু শাকেরের রুমে আমাকে ডাকা হয়। রুমে ঢুকে দেখি তিনি একা বসে আছেন এবং তার টেবিলে অস্ত্র রাখা। তিনি নানান কথা বলে আমাকে কুপ্রস্তাব দেন এবং এমডি শাহিনের সঙ্গে বসে মদ খেতে হবে বলেন। তখন আমি প্রতিবাদ করি এবং বুঝতে পারি আসলে আমি ভুয়া টিভি চ্যানেলে এসেছি এবং সংঘবদ্ধ এক অপরাধীচক্রের খপ্পরে পড়েছি। আমি বের হয়ে যাওয়ার সময় আবু শাকের আমাকে অস্ত্র দেখিয়ে হুমকি দেন-আমি যেন এ কথা কারও কাছে না বলি। একজন প্রভাবশালী সংসদ-সদস্যের নাম ভাঙানোর অভিযোগও রয়েছে শাহিন ও শাকেরের বিরুদ্ধে। পরবর্তী সময়ে ওই সংসদ-সদস্য সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানান, সিএনএন বাংলা টিভির সঙ্গে তার কোনোরকম সম্পর্ক নেই।
উল্লেখ্য, নাম-লোগো ব্যবহারের অপরাধে গত বছরের ১৬ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল কেবল নিউজ নেটওয়ার্ক (সিএনএন) বাংলাদেশে সিএনএন বাংলা টিভি নিউজের স্বত্বাধিকারী শাহিন আল মামুনের বিরুদ্ধে মামলা করে। ওই মামলায় সিএনএন বাংলা টিভি নিউজের কার্যক্রমের ওপর চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চাওয়া হয়। মামলার প্রাথমিক শুনানি শেষে ২৯ নভেম্বর বিচারক এএইচএম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়ার আদালত ‘সিএনএন বাংলা টিভি’র কার্যক্রম পরিচালনার ওপর অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা দেন। এরপরও এ ভুয়া প্রতারকচক্র তাদের কার্যক্রম বন্ধ করেনি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চিহ্নিত সন্ত্রাসী, মাদক কারবারি, ওষুধ বিক্রেতা, সুদের ব্যবসায়ী, চালকরা রাতারাতি সাংবাদিক হয়ে দাবিয়ে বেড়াচ্ছে রাজধানীর অলিগলি। কোনো সংবাদ লিখতে না পারলেও গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে কথিত সাংবাদিকরা। ১ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে ডোমেইন হোস্টিং কিনে ওয়েবসাইট খুলে ইউটিউব ও ফেসবুক পেজ তৈরি করে সেটিকে টিভি চ্যানেল অথবা নিউজ পোর্টাল হিসাবে ভুয়া প্রেস কার্ড বেচাকেনা শুরু করে। এ ধরনের কার্ড নিয়ে চাঁদাবাজি, ব্ল্যাকমেইলিংয়ের সঙ্গে জড়িতরাও সর্বত্র সাংবাদিক পরিচয় দিচ্ছে। এ ভুয়া কার্ডের বদৌলতে তারা রাতারাতি সাংবাদিক বনে যাচ্ছে। তিন বছর ধরে যেখানে-সেখানে এ রকম কয়েকশ ভুয়া সাংবাদিক অবাধে বিচরণ করছে। তারা নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে। এমন নীতিহীন কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। গুজব ও অপপ্রচার বাড়ছে।
সাংবাদিকতা পেশাকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে এবং ক্ষমতাসীন নেতার নাম ভাঙিয়ে চিহ্নিত অপরাধীরা বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। গত কয়েক মাসে রাজধানীতে সাংবাদিক পরিচয়দানকারী কয়েকজনকে মাদকসহ পুলিশ আটক করেছে। আবার চাঁদাবাজি করতে গিয়েও কয়েকজন জনতার হাতে আটক হয়েছে। জেল খেটে বের হয়ে এসব ভুয়া সাংবাদিক আবার পুরোনো অপকর্ম শুরু করে। মহানগরীর বিভিন্ন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) রুম, সরকারি অফিস এবং বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভুয়া সাংবাদিকদের ভিজিটিং কার্ডে সয়লাব, নামধারী মানবাধিকার সংগঠন, ভুঁইফোঁড় অনলাইনের নাম লিখে ভিজিটিং কার্ড তৈরি করে তারা সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করছেন।
সিনিয়র সাংবাদিক ও গ্লোবাল টেলিভিশনের সিইও সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, আইপি বা অনলাইন টেলিভিশনের কোনো অনুমোদন নেই। ভুয়া সাংবাদিকদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। এমনকি বেতনও নেই। তাদের বাধাও দিচ্ছে না কেউ। তারা বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ করছে, গুজব ছড়াচ্ছে ও মানহানি করছে। এতে পেশাদার সাংবাদিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংবাদমাধ্যম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গণমাধ্যমের বিকাশ, ভালো সাংবাদিকতা, প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আমি মনে করি, ২০১৮ সালে মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত গণমাধ্যমকর্মী আইন দ্রুত পাশ করা উচিত।
প্রাতিষ্ঠানিক জায়গায় সাংবাদিকতাকে নেওয়া না হলে যে অপসাংবাদিকতা হচ্ছে, সেটি বন্ধ করা যাবে না।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক এবং আরটিভির বার্তা সম্পাদক আক্তার হোসেন বলেন, এসব ভুঁইফোঁড় লাইসেন্সবিহীন অনলাইন টিভির নামধারী সাংবাদিকের দৌরাত্ম্যে মূলধারার সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের কর্মকাণ্ডে মূলধারার সাংবাদিকদের বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। মাঝে মধ্যে ঝুঁকির মুখেও পড়তে হয়। এমন বাস্তবতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নজরদারি দরকার। এসব ভুয়া সাংবাদিকের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা সরকারের দায়িত্ব। ভবিষ্যতে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা এড়াতে ভুয়া সাংবাদিকদের এখনই নিয়ন্ত্রণ করার দাবি তার। সাংবাদিক নেতা মতিউর রহমান তালুকদার জানান, ভুয়া সিএনএন বাংলা টিভির মতো ভুয়া গণমাধমের ভুয়া সাংবাদিকরা নিউজ করা তো দূরের কথা, নিজের জীবনবৃত্তান্তও তারা ভালো করে লিখতে পারে না।
দেশের বহুল প্রচারিত কয়েকটি মিডিয়ার সিনিয়র সাংবাদিকরা জানান, রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিকতার নামে চাঁদাবাজি এবং নানা ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন ভুয়া কার্ডধারীরা। এ ধরনের ভুঁইফোঁড় কথিত সাংবাদিক বিভিন্ন এলাকায় বাসাবাড়ি, মিলকারখানা, বেকারিসহ নানা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রচার কিংবা ভ্রাম্যমাণ আদালতের ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজি করছে। এছাড়া রাজনৈতিক সভা-সমাবেশসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বুম হাতে অথবা আইডি কার্ড ঝুলিয়ে তারা উপস্থিত হয়। নিজেকে সাংবাদিক হিসাবে জাহির করতে তারা নানা অঙ্গভঙ্গি করে। অনুষ্ঠান শেষে রাজনৈতিক নেতা অথবা আয়োজকদের পেছনে ছোটে মৌমাছির ঝাঁকের মতো। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে প্রেস ক্লাবসহ নামে-বেনামে তারা নানা সংগঠন করেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, মূলধারার কিছু সাংবাদিক, থানা পুলিশ এবং স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তির সঙ্গে সখ্য রয়েছে তাদের। অপকর্মে জড়িতদের দমনে কঠোর পদক্ষেপ নেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী-এমন প্রত্যাশা মূলধারার সাংবাদিকদের।
অপসাংবাদিকতা রোধে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, সাংবাদিকতার নাম ভাঙিয়ে যারা অপকর্মে লিপ্ত তারা পর্যবেক্ষণে রয়েছে। অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভুয়া সাংবাদিকরা কখনই প্রশ্রয় পাবে না।
জে/এমকে/আস্থা