বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) কিশোরগঞ্জ জেলা সার্কেল অফিসে দালাল আর অতিরিক্ত অর্থ ছাড়া কোনো সেবা মিলছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।
ড্রাইভিং লাইসেন্স,গাড়ির রেজিস্ট্রেশন, গাড়ির মালিকানা পরিবর্তন, নম্বর প্লেটের কাজ, ফিটনেস নবায়ন করতে জেলার ১৩টি উপজেলা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলা থেকে প্রতিদিন ভিড় করতে দেখা যায় গ্রাহকদের। কিন্তু সেবা নিতে আসা গ্রাহকদের অভিযোগ অফিসের কর্মকর্তারা নিজেদের বিশ্বস্ত একটি দালালচক্র তৈরি করে অফিসকে পরিবেষ্টিত করে রেখেছে। সরকারি নির্ধারিত ফি’র বাইরে অতিরিক্ত টাকা না দিলে মিলছে না কাঙ্খিত সেবা। আবেদনে ও সাপোর্টিং ডকুমেন্টগুলোতে নানা রকম ভুল ধরে করা হচ্ছে হয়রানি। ফলে হয়রানি এড়াতে অফিসারদের বিশ্বস্ত দালালের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে গ্রাহকদের; গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা।
আবার অনেক গ্রাহক হয়রানি ও ঝামেলাকে পাশ কাটিয়ে দালাল ধরে কাজ করায় বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে বলেও জানা গেছে।
বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিনে অফিস প্রাঙ্গণে কয়েকজন সেবাপ্রার্থীকে প্রকাশ্যে টাকা নিয়ে দরকষাকষি করতে দেখা গেছে। কৌতূহল বশত বিষয়টি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করলে জানা যায়, কিশোরগঞ্জ বিআরটিএ অফিসে ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন থেকে সব কিছুই দালালদের নির্দিষ্ট করা। সরকারি নির্ধারিত ফি বাদে সেবার জন্য অতিরিক্ত ৮ হাজার থেকে ১২ হাজার ছাড়া এখানে কোনো ভাবেই সেবা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
জেলার মিঠামইন উপজেলা থেকে আসা মো. আব্দুল হাশেম মিয়ার সাথে কথা বললে তিনি বলেন- ‘ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংকে টাকা জমা দিয়েছেন। মেডিকেল টেস্ট, থিওরি, প্র্যাকটিক্যালসহ সব শেষ করে আট মাস যাবৎ অফিসে ঘুরেও লাইসেন্স হাতে পাইনি। অফিসে গেলে বলে— ‘স্যার বাইরে আছে’, ‘ফাইল পাওয়া যাচ্ছে না’, ‘কাল আসেন। এদিকে আমার সাথে আরও যে দুইজন আবেদন করেছিল তারা দালাল ধরে অতিরিক্ত ১২ হাজার টাকা দিয়ে লাইসেন্স নিয়ে দেশের বাহিরে চলে গেছে।’
অপর দিকে লাইসেন্স হাতে পাওয়া শহরের বাসিন্দা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এর সাথে লাইসেন্স পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভাই ঝামেলায় জড়াতে চাই না। ড্রাইভিং লাইসেন্স হাতে পেতে কত ভোগান্তি পোহাতে হয়- অফিসের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে জুতা ক্ষয় হয়ে যায় এছাড়া বিরক্তিকর পরীক্ষা। আমি দালাল ধরে অতিরিক্ত ১০ হাজার টাকা দিছি অলপ্ দিনে লাইসেন্স হাতে পেয়ে গেছি। দেখেন না কত মানুষ ঘুরতাছে।’
কিশোরগঞ্জ বিএরটিএর সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) কামরুজ্জামান এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘অনেকে মনে করে বিআরটিএ বোধ হয় আগের মতোই আছে। এ ধরনে অভিযোগের সত্যতা পেলে আমাদের জানাতে হবে। এখন অনেকেই নিজে নিজে কাজ করছেন। কিন্তু মানুষ এ ক্ষেত্রে সময় দিতে চান না। এ কারণে বাইরের লোক ধরে অযথা টাকা খরচ করেন। নিজের কাজ নিজে করতে পারলে দালালেরা কোনো সুবিধা করতে পারবে না। আমাকে এবং আমার অফিসকে হেয় প্রতিপন্ন করতে এমনটা করা হচ্ছে।’
মানবাধিকার সংগঠনের সদস্য আলী হাসান বলেন- ‘যে অফিসে মানুষ লাইসেন্স নিতে যায় নিরাপদ সড়কের জন্য সেখানেই যদি ঘুষ দিয়ে লাইসেন্স নিতে হয়। তবে সড়কে দুর্ঘটনা বাড়ারই কথা। এভাবে অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে লাইসেন্স দিলে সড়কের নিরাপত্তা কিভাবে নিশ্চিত হবে? দুর্নীতির বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। কিশোরগঞ্জ বিআরটিএ অফিসে যে দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে তা কেবল একটি অফিসের নয়, বরং গোটা ব্যবস্থার ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। দুর্নীতি দমন কমিশন এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উচিত এই অভিযোগগুলো গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে দোষীদের চিহ্নিত করা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। এছাড়া সাধারণ জনগণের আস্থা চিরতরে হারিয়ে যাবে সরকারি সেবা ব্যবস্থার প্রতি।’
কিশোরগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেট জুয়েল মাহমুদ বলেন, সরকারি অফিসে এভাবে অতিরিক্ত ছাড়া কাজ না হলে তা পুরো প্রশাসন ব্যবস্থার প্রতি আস্থা নষ্ট হবে। দুর্নীতিবিরোধী কমিশনের উচিত দ্রুত তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।