অনিয়ম ও দুর্নীতির শেষ নেই গাইবান্ধা জেলা কারাগারে
আস্থা অনুসন্ধান টিম: স্বজনদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে মাত্র পাঁচ মিনিট কথা বলার জন্য কমপক্ষে ১০০ টাকা গুণতে হয় কারাবন্দিদের! কারাগারের ভেতরে ও বাইরে দুটি ক্যান্টিন থেকে যে কোনও পণ্য সামগ্রী কিনতে হয় দুই থেকে তিনগুণ বেশি দামে। শুধু তাই নয়, কারাগারের ভেতরে কারাবন্দিরাই গড়ে তুলেছে পাঁচটি মেস। যেসব মেস চালায় বিভিন্ন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত দাগি আসামিরা। কারারক্ষী রেজাউল ইসলামের জামিন সিন্ডিকেট নিয়ে সময় সংবাদে খবর প্রচারের পর বেরিয়ে আসছে গাইবান্ধা জেলা কারাগারের ভেতরের আরও অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য।
কারাগারের বাইরে কারারক্ষী রেজাউল পরিচালিত ক্যান্টিনে প্রতিটি পণ্যের দাম দ্বিগুণ। কারাগারের বাইরের এই ক্যান্টিনে বন্দি স্বজনদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন হিরো হক্কানী হিমেল নামে এক ব্যক্তি। তিনি অভিযোগ করে বলেন, কারাগারে বন্দিদের জন্য খাবার পাঠালে তা পৌঁছাতে পৌঁছাতে মিলিয়ে যায়। বাইরের কোনো দোকান থেকে কিছু কিনে দেওয়া যাবে না, ওদের নিজস্ব (কারা ক্যান্টিন) ক্যান্টিন থেকেই সব কিনতে হবে, কিন্তু সেখানে সব কিছুর দাম অনেক বেশি রাখা হয়।
যে বল সাবানের (কাপড় কাচা) গায়ে মূল্য লেখা আছে ১৭ টাকা, ওদের কাছে সেই সাবান কিনতে হয় ৫০ টাকায়, ব্রাশের গায়ে দাম আছে ২০ টাকা তাদের কাছে কিনতে হয় ৬০ টাকায়, ২০ টাকার স্যান্ডেলের দাম ৬০ টাকা, আবার কেউ যদি বাইরে থেকে এসব কিনে দেন তারপরও তাদের দাম দিতে হবে। আবার প্রয়োজনীয় এসব জিনিস প্যাকেটিং করে কারাগারে পাঠানোর জন্য ব্যাগ প্রতি দিতে হয় ১০০ টাকা। তারা এমন আচরণ করে ‘দিলে দিন, না দিলে না দিন’। সম্প্রতি কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন বন্দির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কারাগারের ভেতরের ক্যান্টিনের সব ভয়াবহ তথ্য। এ ক্যান্টিনটি জেলার আমজাদ হোসেন নিজেই চালান।
সকাল-সন্ধ্যা বাইরের বাজার থেকে তিনি কেনাকাটা করার পর মাছ, মাংস, তরিতরকারি ক্যান্টিনে দেন। ক্যান্টিনের পাশাপাশি কারাগারের ভেতরে গড়ে ওঠা পাঁচটি মেসে বেশি দামে এসব সরবরাহ করেন তিনি। কারাগারের রান্না করা তরকারি যারা খেতে চান না, তারা টাকা দিয়ে এসব মেস থেকে কিনে খান। কয়েকজন করে বন্দি মিলে গড়ে তুলেছে এসব মেস। মেস পাঁচটির দায়িত্বে আছেন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিরা। তারা ভেতরের ক্যান্টিন থেকে দ্বিগুণ দামে সবজিসহ মাছ মাংস কিনে এসব মেসে রান্না করে অতিরিক্ত দামে বন্দিদের কাছে বিক্রি করে।
ওই মেসে প্রতি প্লেট গরুর মাংস ২০০ টাকা, ডিম আলুর ডাল ৫০ টাকা, ব্রয়লার মুরগির মাংস দেড়শ থেকে ২০০ টাকা, দুই টুকরো খাসির মাংস ২০০ টাকা, প্রতি প্লেট সবজি ১০/২০ টাকা, প্রতি পিস পরোটা ১০ টাকা, প্রতি বাটি পাতলা ডাল ৫ টাকায় বিক্রি হয়। কারাগারের ভেতরে এভাবে মেস করে রান্না ও বিক্রির নিয়ম না থাকলেও সম্প্রতি কারামুক্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কারাগারের ভেতরের মেসগুলো চালায় মোক্তার, লাল সাধু, মাইদুল, আলিমুদ্দি ও রোকন। তারা প্রত্যেকেই বিভিন্ন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাবন্দি। তারা জানান, কারাগারের ভেতরের ক্যান্টিনে এক শলাকা ডার্বি সিগারেট বিক্রি হয় ৭ টাকায়, একটা পান ১০ টাকা। এমনিভাবে যে কোনও খাদ্য সামগ্রী প্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য দ্বিগুণ-তিনগুন বেশী টাকা গুনতে হয় কারাবন্দিদের।
অন্যদিকে, করোনাকালে স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ বন্ধ হবার পর কারাবন্দিরা কারাগার থেকে মোবাইলে স্বজনদের সাথে কথা বলার সুযোগ পায়। কিন্তু সেখানেও অনিয়মের শেষ নেই। ৫ মিনিট কথা বলার জন্য ৫ টাকার জায়গায় কারাবন্দিদের দিতে হয় কমপক্ষে ১০০ টাকা। মঙ্গলবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে এসব বিষয়ে জেলা কারাগারে কথা হয় জেল সুপার নজরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি এসব অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ছোটো-খাটো দু/একটা ত্রুটি থাকতে পারে। তবে সব সঠিক নয়। সম্প্রতি জামিনের নামে কারাবন্দি সুকুমারের পরিবারের কাছ থেকে লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ ওঠে গাইবান্ধা জেলা কারাগারের রক্ষী রেজাউল ইসলামের বিরুদ্ধে।
এ ঘটনায় গত ৯ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার দুপুরে কারাগারের জেল সুপার ও জেলারের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলে অভিযুক্ত কারারক্ষী রেজাউল ইসলামের বক্তব্য জানতে কারাগারে গেলে বাইরের ক্যান্টিনে বসে থাকতে দেখা যায় রেজাউলকে। প্রথমে রেজাউল প্রতিবেদকের কাছে নিজের নাম অস্বীকার করে। এরপর তিনি রেজাউল নিশ্চিত হলে ক্যান্টিন থেকে সটকে পড়ে। এরপর অন্য কারারক্ষীরা সময় সংবাদের প্রতিবেদক ও চিত্র সাংবাদিককে সেখান থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। পরে কারাগারের জেলার আমজাদ হোসেন প্রতিবেদকের সঙ্গে কারাগারের বাইরে রেজাউলকে কথা বলতে বলেন। পরে রেজাউল কারাগারের বাইরে চায়ের দোকানে গিয়ে তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ অস্বীকার করেন।
এসময় পাশে থাকা সুকুমারের ভাই আনন্দ কর্মকার বলেন, রেজাউলই তার কাছে ১ লাখ টাকা নিয়েছে তার ভাইয়ের জামিনের কথা বলে। টাকা না দিলে জামিন বাতিল করার হুমকি দেয় বলেও অভিযোগ করে আনন্দ কর্মকার। ওই দিন সময় সংবাদের প্রতিবেদক ও চিত্র সাংবাদিক সেখান থেকে শহরে ফেরার সময় তাদের ডাকেন জেল সুপারের কারারক্ষী। তিনি তাদের ক্যামেরা ও মোবাইল জমা নিয়ে ভুক্তভোগী ও সাংবাদিকদের কারাগারের ভেতরে জেল সুপারের কক্ষে নিয়ে যান। সেখানে জেলার আমজাদ হোসেন ও জেল সুপার নজরুল ইসলাম সময় সংবাদের সাংবাদিক এবং ভুক্তভোগীর কাছে ঘটনা জানতে চান।
এসময় কারারক্ষী রেজাউলকে ডেকে নিয়ে তার কাছে জানতে চাইলে রেজাউল টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, আসামির (সুকুমারের) জামিন করিয়ে তিনি টাকা নিয়েছেন। এরপর জেলার ও সুপার সংবাদ প্রচার না করার জন্য সাংবাদিকদের অনুরোধ করেন। পরে দফায় দফায় কথা বলার ছলে রেজাউলের সঙ্গে সাংবাদিকদের সুপারের পাশের কক্ষে পাঠানো হয়। সেখানে রেজাউল সময় সংবাদের প্রতিবেদককে ম্যানেজের জন্য টাকা দেয়ার চেষ্টা করে।
তাতে রাজী না হলে কারাগারে আটকে রাখা হয় সাংবাদিকদের। শেষ পর্যন্ত জোর করে সময় সংবাদের প্রতিবেদকের পকেটে ৫ হাজার টাকা ঢুকিয়ে দিয়ে এক ঘণ্টারও বেশী সময় পর কারাগার থেকে বের করে দেয়া হয়। ওই দিনই সময় টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ, সাংবাদিক সহকর্মী ও আইনজীবীদের পরামর্শে থানায় জিডি করে ৫ হাজার টাকা জমা দেন সময় সংবাদের ঐ প্রতিবেদক