“আমাদের দায়িত্ব ছিল শুধু মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া। একটা মানুষের পক্ষে দিনের ১৪/১৫ ঘণ্টা অনবরত মিথ্যা কথা বলা, এটা সহ্য করাও কঠিন।”
এই মন্তব্য আলোচিত ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ইভ্যালির একজন সাবেক কর্মীর, যিনি কিছুদিন আগেও ওই কোম্পানির কলসেন্টারে কাজ করতেন, গ্রাহকদের সঙ্গে তার নিয়মিত কথা বলতে হত।
লোক ঠকানোর অভিযোগ আর বিপুল দেনায় ডুবতে বসা ই কমার্স প্ল্যাটফর্ম ইভ্যালি এখন পেছনের সারির কর্মীদের বেতন বকেয়া রেখেই ‘বিদায় করতে’ শুরু করেছে। অর্থসঙ্কটের কথা বলে তাদের ‘ভালো চাকরি খুঁজে নেওয়ার পরামর্শ’ দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সাবেক ও বর্তমান কর্মীদের কয়েকজন।
ভোক্তাদের অব্যাহতভাবে ‘মিথ্যা আশ্বাস দিতে বাধ্য করা’, নিয়োগপত্র না দেওয়া, ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য করাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ শোনা গেছে তাদের মুখ থেকে।
এসব বিষয়ে ইভ্যালির প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেলের বক্তব্য জানতে তাকে কয়েকবার ফোন করা হলেও ধরেননি। ইভ্যালির একজন কর্মকর্তার মাধ্যমে খবর পাঠানো হলেও কোনো সাড়া মেলেনি।
২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর এক/দুই মাসের আগাম সময় নিয়ে প্রায় অর্ধেক মূল্যে পণ্য সরবরাহের বিভিন্ন ‘অফার’ দেওয়া শুরু করেছিল ইভ্যালি। তাতে অল্প সময়ের মধ্যে সারাদেশে মোটরসাইকেল, ফ্রিজ, এসি, প্রাইভেটকারসহ নানা পণ্যের ক্রেতাদের সমারোহ ঘটেছিল ইভ্যালিতে।
স্বল্প মূল্যের এসব পণ্যের জন্য টাকা নেওয়া হতো অগ্রিম। কিন্তু কিছু ক্রেতাকে পণ্য দিয়ে বাকিদেরকে অপেক্ষায় রাখার কৌশল নিয়ে তারা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিল বলে পরে অভিযোগ উঠতে শুরু করে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েক মাস আগে ইভ্যালির বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দিলে কোম্পানির গাড্ডায় পড়ার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। এরপর মন্ত্রণালয় ইভ্যালির বিষয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে শুরু করে।
আলোচিত ওই ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের চেয়ারাম্যান ও এমডির বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে মামলা হয়েছে, তাদের দেশত্যাগে জারি হয়েছে নিষেধাজ্ঞা।
বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ইভ্যালির পক্ষ থেকে জমা দেওয়া দায়-দেনার হিসাবে দেখা যায়, দুই লাখ ১৪ হাজার গ্রাহক ইভ্যালির কাছে পণ্য কেনার জন্য বুকিং দিয়েছেন। গত ১৫ জুলাই পর্যন্ত বুকিং বাবদ গ্রাহকরা ইভ্যালির কাছে ৩১০ কোটি টাকা পাবেন।
ক্ষুব্ধ এসব গ্রাহকদের দিনের পর দিন প্রবোধ দিয়ে যাওয়া কতটা কঠিন, সে কথা বললেন সম্প্রতি ইভ্যালির কল সেন্টারের কাজ ছেড়ে আসা এক জন, যিনি আগে গ্রামীণ ফোন, পাঠাওসহ বিভিন্ন কোম্পানির কাস্টমার কেয়ারে চাকরি করেছেন দীর্ঘদিন।
তিনি বললেন, কাস্টমার কেয়ার হল ভোক্তদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করার জায়গা। কিন্তু ইভ্যালিতে দিনের পর দিন ক্রেতাদের অভিযোগ আর হাহুতাশ শুনতে শুনতে কর্মীদের মধ্যে এক ধরনের ‘ট্রমার’ সৃষ্টি হয়েছে।
“এখানে কেউ ২/৩ মাসের বেশি সময় কাজ করতে পারে না। কিন্তু যারা কাস্টমার কেয়ার এক্সিকিউটিভ, অর্থাৎ যাদেরকে সরাসরি ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলতে হয় না, তারা ভালো থাকেন। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে কর্মীদের দিয়ে জোর করে মিথ্যা আশ্বাস দেওয়ানো।”
নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রতিদিন ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টা কল ধরে গেছি। দিনে দেড়শ কল ধরলে ১৪০টা কলেই গ্রাহকের কান্নাকাটি শুনতে হয়েছে। আমরা তাদেরকে উত্তর দিয়ে গেছি- আপনার পণ্যটি নিয়ে কাজ হচ্ছে, অচিরেই পেয়ে যাবেন। কিন্তু আসলে কিছু হচ্ছে কিনা, তাও আমাদের জানা থাকত না।
“এখানে টাকা আটকা পড়ায় অনেকে বাড়িছাড়া হয়েছেন বলে আমাদের জানিয়েছেন, কেউ বলেছেন ঋণের দায় মেটাতে না পেরে আত্মগোপনে আছেন। কেউ জমি বন্ধক রেখে টাকা খাটানোর কথা বলছেন, কেউ বাড়ির গরু ছাগল বিক্রি করে পণ্যের অর্ডার করেছেন। আমরা এর কোনো উত্তরই দিতে পারি না। এভাবে মিথ্যা আশ্বাস দিতে দিতে আমরা ট্রমার মধ্যে চলে গেছি।”
তিনি জানান, ইভ্যালি তাকে নিয়োগপত্রও দেওয়া হয়নি। ‘অনৈতিক কথাবার্তা ও চর্চার’ কারণে চাকরি ছেড়ে দেওয়াই তার কাছে ভালো মনে হয়েছে।
ইভ্যালির কাস্টমার কেয়ারে দুই মাস কাজ করে চাকরি ছাড়া এক নারী বললেন, “তারা আমাদের বলে দিয়েছিল- ‘তোমাদের শুধু অ্যাপলজি করার জন্য বসানো হয়েছে। কাস্টমারের সমস্যার সমাধান দেওয়া তোমাদের কাজ নয়।’ কাস্টমার যে সমস্যা নিয়েই আসুক, আমাদের কোনো উত্তর জানা ছিল না। আমাদের কোনো ইনফরমেশন দেওয়া হত না। এত ব্যাড এক্সপেরিয়েন্স ছিল যে আমি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম।”
এই সাবেক কর্মী জানালেন, তিনি চাকরি ছেড়েছেন গত জুলাইয়ে। তার সঙ্গেই আরও ১৫ জন যোগ দিয়েছিলেন ইভ্যালির কল সেন্টারে। চাকরি না ছাড়লেও ঈদের আগে থেকে তাদের বেতন বন্ধ রয়েছে বলে জেনেছেন।
“এই অগাস্ট আর সেপ্টেম্বর মাসে বেতন দেওয়া সম্ভব হবে না বলে কর্তৃপক্ষ তাদের জানিয়ে দিয়েছে। দীর্ঘদিন বেতন না পাওয়ার কারণে কর্মীদের মধ্যে অমানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।”
ঈদের আগে গত জুন মাসের বেতন হাতে পেয়েই ইভ্যালির চাকরি ছেড়ে দেন মেহেদী হাসান। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমি বুঝতে পেরেছিলাম কোম্পানির অবস্থা ভালো নয়। তাই সঠিক সময়ে চাকরি ছাড়তে পেরেছিলাম। কিন্তু আমার সাথে অন্য যারা ছিল, তারা ঈদের আগে বেতন বোনাস কিছুই পায়নি। ঈদের পরেও তাদের বেতন নেই।”
মহামারীর কারণে জুলাইয়ের শুরুতে সরকার লকডাউন দিলে ইভ্যালির অফিস বন্ধ রাখা হয়েছিল। কর্মীদের অনেকে তখন ডেস্কটপ বা ল্যাপটপ বাসায় নিয়ে হোম অফিস করছিলেন।
অফিস চালু হওয়ার কথা বলে গত সপ্তাহে তাদের কাছ থেকে মালামাল বুঝে নিয়েছে ইভ্যালি। এখন তাদের অন্যত্র চাকরি খুঁজতে বলা হচ্ছে।
রাকিব নামের একজন (তিনি নামের একাংশই শুধু বলেছেন) বললেন, ১৮০ জনের মতো কর্মী ছিল ইভ্যালির কাস্টমার সার্ভিস বিভাগে। তাদের চাকরিতে আর না যেতে বলা হয়েছে।
“বলেছে, আপানারা রিজাইন দিয়ে দেন। জব সুইচ করার চেষ্টা করেন। আগামী দুই মাসের মধ্যে বেতন দিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু এটা বিশ্বাসযোগ্য না।
“আমরা কাস্টমারকে বলতাম যে আপনারা অপেক্ষায় থাকেন, পণ্য পেয়ে যাবেন। এখন আমাদের বলা হচ্ছে আপনারা অপেক্ষায় থাকেন, বেতন পেয়ে যাবেন। কিন্তু আমাদের কেউ এটা বিশ্বাস করছে না।“
রাকিব জানান, অন্য অনেকের মত তিনিও অফিস থেকে একটি ডেস্কটপ বাসায় নিয়ে লকডাউনের মধ্যে কাজ করছেন। ২১ অগাস্ট তাদের অফিসে ফিরতে বলা হয়।
“পরদিন রোববার ছিল আমার সপ্তাহিক ছুটি। সোমবারে যাওয়ার পরে আমাকে চাকরিতে না করে দেওয়া হয়। আসলে তারা ডেস্কটপটা ফেরত নেওয়ার জন্য এই কৌশল করেছে। অথচ বেতনটা দেয়নি।
“সবাইকে বলা হচ্ছে ভালো কোনো জব পান চলে যান। আসলে আমরা ঝুলে আছি। জুলাই মাসে কাজ করেছি, বেতন হয়নি।”