অসাধু সিন্ডিকেটের থাবায় দেশের নিত্যপণ্যের বাজার। তদারকির অভাবে সুযোগ পেলেই চক্রের সদস্যরা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে ভোক্তার পকেট কাটছে। হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কেটি টাকা। সরকারের পক্ষ থেকে চক্রের সদস্যদের চিহ্নিত করা হলেও তারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। গত দেড় মাস আগে পেঁয়াজে নৈরাজ্যের পর চক্রটি চাল, আলু ও ভোজ্যতেল নিয়ে কারসাজি শুরু করেছে। হু-হু করে বেড়েছে দাম। তবে এ তিন পণ্যের দাম কমাতে সরকার মূল্য নির্ধারণ করে দিলেও তা বাজারে কার্যকর হয়নি। ব্যবসায়ীরা বেশি দামেই বিক্রি করছেন পণ্যগুলো। ফলে দামের উত্তাপে নাকাল ভোক্তা।
এদিকে আলুর বাজার স্থিতিশীল করতে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে সরকার। কোনো মজুদদারের কাছে দ্বিগুণ আলু মজুদ থাকলেই আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এজন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হিমাগারে রাখা আলুর মজুদের তথ্য চেয়ে মঙ্গলবার জেলা প্রশাসকদের চিঠি দিয়েছে প্রতিযোগিতা কমিশন। চিঠি পাওয়ার দুইদিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট জেলায় কী পরিমাণ আলু মজুদ আছে, সেই তথ্য দিতে বলা হয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে মিল পর্যায়ে চালের দর নির্ধারণ করলেও ১ মাস ধরে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ২৫০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে কারসাজি রোধে দু’দফায় আলুর দাম নির্ধারণ করার পরও সংশ্লিষ্টরা কার্যকর করতে পারেননি। খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি আলুর দাম সরকার ৩৫ টাকা নির্ধারণ করলেও বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৫০ টাকা।
সপ্তাহজুড়ে প্রতি কেজি আলু কিনতে ভোক্তাকে ১৫ টাকা বেশি গুনতে হয়েছে। এছাড়া ২২ অক্টোবর বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ব্যবসায়ীদের বৈঠকের পর মিল পর্যায়ে সরকার ভোজ্যতেলের দাম বেঁধে দিলেও তা কার্যকর হয়নি। এতে পাইকারি বাজারে দাম কমার প্রভাব না পড়ায়, খুচরা বাজারে খোলা সয়াবিন প্রতি লিটার ১০০ টাকায় ঠেকেছে।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বুধবার যুগান্তরকে বলেন, সংকটের সময় কখনই সরকার নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রি হয় না। এর মূল কারণ হল, চাহিদা ও সরবরাহের সমস্যা। তিনি বলেন, সরবরাহ না বাড়িয়ে সরকার প্রশাসনিক উপায়ে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। এতে ফল হয় উল্টো। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের বিপরীতে টিসিবি অথবা অন্য কোনো উপায়ে পণ্যের সরবরাহ বাড়ালে দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে। তিনি আরও বলেন- পেঁয়াজ, আলু, আদাসহ বেশ কয়েকটি পণ্য আছে, তা পচনশীল। এগুলো বেশিদিন ধরে রাখা যায় না। ফলে বিকল্প উপায়ে সরবরাহ বাড়লে এমনিতে ব্যবসায়ীরা পণ্য ছেড়ে দেবে। পাশাপাশি ভোক্তা অধিকার রক্ষায় বিভিন্ন আইন আছে। এগুলোও বাস্তবায়ন করতে হবে।
দেশে করোনা পরিস্থিতি শুরুর প্রথম থেকেই মিলাররা কারসাজি করে সব ধরনের চালের দাম বাড়াতে থাকে। মাঝে কিছুটা কমলেও ২ মাস আগে আবারও বাড়তে থাকে দাম। তবে মিলারদের কারসাজি রোধে এবং দাম নিয়ন্ত্রণ করতে ২৯ সেপ্টেম্বর চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের বৈঠকে সবচেয়ে ভালো মানের ৫০ কেজির এক বস্তা মিনিকেট চালের দাম (মিলগেট) ২ হাজার ৫৭৫ টাকা এবং মাঝারি মানের মধ্যে বিআর-২৮ চালের দাম ২ হাজার ২৫০ টাকা নির্ধারণ করেন। কিন্তু মাস খানেক ধরে এ বেঁধে দেয়া দাম মিল পর্যায় থেকে মানা হচ্ছে না।
বুধবার খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিলগেটে প্রতি বস্তা মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার ৭৫০ টাকা, যা এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৫০০ টাকা। সেক্ষেত্রে দেখা যায়, মিলগেটে প্রতি বস্তা মিনিকেট চাল মাসের ব্যবধানে সর্বোচ্চ ২৫০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।
আর সরকারের বেঁধে দেয়া দামের চেয়ে বিক্রি হচ্ছে ১৭৫ টাকা বেশি দরে। এছাড়া মিল পর্যায়ে প্রতি বস্তা বিআর-২৮ জাতের চাল বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৩৫০ থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকা, যা ১ মাস আগে বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ১৫০ টাকা। মাসের ব্যবধানে মিল পর্যায়ে প্রতি বস্তা চাল ২৫০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর সরকারের বেঁধে দেয়া দামের চেয়ে ১৫০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।
অন্যদিকে পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও অসাধুদের কারসাজিতে হঠাৎ করেই অস্থির হয় আলুর বাজার। এ সময় খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আলু সর্বোচ্চ ৬০ টাকায় বিক্রি হয়। দাম নিয়ন্ত্রণে প্রথম দফায় ৭ সেপ্টেম্বর হিমাগার, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে আলুর দাম বেঁধে দেয় সরকার।
তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। পরে হিমাগার মালিক ও ব্যসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী কেজিতে ৫ টাকা বাড়িয়ে ২০ অক্টোবর মঙ্গলবার দাম পুনর্নির্ধারণ করে দেয় কৃষি বিপণন অধিদফতর। সেক্ষেত্রে খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি আলু ৩৫ টাকা, কোল্ডস্টোরেজ বা হিমাগার পর্যায়ে প্রতি কেজি আলু ২৭ টাকা এবং পাইকারিতে ৩০ টাকা কেজি বেঁধে দেয়া হয়।
কিন্তু বুধবার খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয়েছে ৪৫-৫০ টাকা। পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি ৩৫-৪০ টাকা। আর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হিমাগার পর্যায়ে আলু বিক্রি হয়েছে ৩৩-৩৬ টাকা।
প্রতিযোগিতা কমিশন বলছে, অন্য বছর হয়তো কোনো হিমাগার ১০০ টন আলু সংরক্ষণ করত। এবার ওই হিমাগার যদি ২০০ টন আলু মজুদ করে রাখে তবে সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় এনে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন মো. মফিজুল ইসলাম বলেন, আলু নিয়ে সিন্ডিকেট হলেই আমরা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। তিনি আরও বলেন, পণ্যের ক্ষেত্রে বাজারে কোনো ধরনের যোগসাজশ কিংবা মনোপলি আচরণ করলে প্রতিযোগিতা কমিশন বসে থাকবে না। গুরুত্বসহকারে তদারকি করব। আলুর ক্ষেত্রে বাজারে একধরনের অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতা চলছে, বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি।
মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে শিগগিরই ঢাকায় আসছেন এরদোয়ান
কৃষি বিপণন অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, আমরা যখন মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করি তখন অনেকে নির্ধারিত মূল্যে আলু বিক্রি করে। মোবাইল কোর্ট শেষে যেই লাউ সেই কদু। তারপরও আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণে আমরা নিরলসভাবে কাজ করছি।
জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক যুগান্তরকে বলেন, দেশে আলুর পর্যাপ্ত মজুদ আছে। কেজিতে খুচরা পর্যায়ে ৩৫ টাকার বেশি ওঠার কোনো কারণ নেই। বর্তমানে অনেকেই প্রতি কেজি ৫০ টাকায় বিক্রি করেছেন, যা গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি জানান, অনেকেই রাতারাতি বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। এ চিন্তা কেউ করবেন না। তা না হলে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আমরা বাধ্য হয়ে আলুর যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করেছি, এটিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করব।
অন্যদিকে সরকার মিল পর্যায়ে খোলা সয়াবিনের দাম ৯০ টাকা ও পাম অয়েলের দাম ৮০ টাকা নির্ধারণ করলেও তা কার্যকর হয়নি। মিল মালিকরা জানান, দাম কমবে লিটারে নাকি কেজিতে, তা নিয়ে একটি দোটানায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এ সমস্যা সমাধান হলে বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমতে শুরু করবে।
বুধবার মিলগেটে প্রতি লিটার সয়াবিন ৯২-৯৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৮৩ টাকা। এদিন রাজধানীর একাধিক খুচরা বাজারে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ১০০ টাকা, যা ১ মাস আগেও ছিল ৯০ টাকা। প্রতি লিটার পাম অয়েল বিক্রি হয়েছে ৯০ টাকা। ১ মাস আগে ছিল ৮০-৮৫ টাকা। ২ মাস আগে এ দু’ধরনের তেলের খুচরা মূল্য আরও ৫-৬ টাকা কম ছিল।