জেলা প্রতিনিধি:চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন সড়কে নসিমন-করিমনসহ লাইসেন্সবিহীন অবৈধ যানবাহনে সয়লাব হয়ে গেছে। এতে প্রতিনিয়তই সড়কে যানজট সৃষ্টির পাশাপাশি উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনা, প্রাণ যাচ্ছে মানুষের। তারপরও অবৈধ এসব যানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে এ অঞ্চলের মানুষ। এসব যানবাহনের বেপরোয়া চলাচলের কারণে অহরহ ঘটছে দুর্ঘটনা। অকালে প্রাণ হারাচ্ছেন অনেকে। কাউকে বরণ করতে হচ্ছে পঙ্গুত্ব। এছাড়া নছিমন, করিমন ও ভটভটির বিকট শব্দে হচ্ছে শব্দ দূষণ। অভিযোগ আছে, অবৈধ যানের অবাধ চলাচল দেখেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না প্রশাসন। এ অবস্থার মধ্যে চুয়াডাঙ্গার পৃথক তিন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় ঝরল দুটি তরতাজা প্রাণ। এ দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছেন আরও ১৮ জন। এর মধ্যে আশঙ্কাজনক অবস্থায় দুজনকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক।
জানা গেছে, দর্শনা-চুয়াডাঙ্গা মহাসড়কের মা ও শিশু হাসপাতালের সামনে যাত্রীবাহী সিএনজি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আখভর্তি ট্রলির পেছনে দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই নজির আহমেদ (৬৫) নামের একজন প্রাণ হারান। এ ঘটনায় শিশুসহ আহত হয়েছেন আরও পাঁচজন। নিহত নজির আহমেদ দর্শনা পরানপুর গ্রামের মৃত মোবারক মণ্ডলের ছেলে এবং দর্শনা সাংবাদিক সমিতির সভাপতি আওয়াল হোসেনের বড় ভাই। তিনি দর্শনা কেরু অ্যান্ড কোম্পানির পরিবহন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত ট্রাক চালক। এ দুর্ঘটনায় আহতরা হলেন- নিহত নজির আহমেদের স্ত্রী (৫৩), সিএনজি চালক সুজন (২২), যাত্রী দর্শনা রামনগর করিমপুরপাড়ার চাঁদ মিয়ার স্ত্রী শাহানারা বেগম (৩২), তাঁর মেয়ে ১৮ মাসের শিশুকন্যা নাহিদা খাতুন ও নাস্তিপুরের এরশাদ আলীর স্ত্রী নাজিনা (৩৫)।
প্রত্যাক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, গতকাল শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে কেরুজ পরিবহন বিভাগের চালক জামাল উদ্দিন দামুড়হুদার আখ ক্রয় কেন্দ্র থেকে দুই ট্রলিসহ আখভর্তি করে দর্শনা চিনিকলে আসছিলেন। পথের মধ্যে চুয়াডাঙ্গা-দর্শনা মহাসড়কের মা ও শিশু হাসপাতালের সামনে পৌঁছালে ট্রাক্টরের পিছনের ট্রলির চাকা পাংচার হয়। একপর্যায়ে চালক ট্রলি রাস্তার পাশে রেখে ট্রাক্টর নিয়ে বিকল্প টায়ার আনতে যান মিলের পরিবহন বিভাগে। এসময় চুয়াডাঙ্গা থেকে যাত্রীভর্তি সিএনজি নিয়ে দর্শনায় ফিরছিলেন দর্শনা মোহাম্মদপুরের মিজানুর রহমানের ছেলে সুজন। মা ও শিশু হাসপাতালের সামনে পৌঁছালে সিএনজি চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ওই ট্রলির পিছনে সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে দুমড়ে-মুচড়ে যায় সিএনজি। ঘটনাস্থলেই নিহত হন নজির উদ্দিন। খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছান দর্শনা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। স্থানীয়দের সহযোগিতায় আহতদের উদ্ধার করে দ্রুত নেওয়া হয় হাসপাতালে। ঘটনাস্থল থেকে লাশ উদ্ধার করে বাসস্ট্যান্ডে রাখা হয়।
দর্শনা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মাহবুবুর রহমান কাজল ও ইন্সপেক্টর শেখ মাহবুবুর রহমান ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে পুলিশ লাশ নিহতের বাড়িতে নেয়। এ সময় স্বজনদের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে পরিবেশ, ভারি হয়ে ওঠে বাতাশ। গোটা গ্রামে নেমে আসে শোকের ছায়া।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, নিহত নজির আহম্মেদ ও তাঁর স্ত্রী গতকাল বেলা দুইটার দিকে নাতি ছেলেকে দেখতে যান চুয়াডাঙ্গা। খাওয়া-দাওয়া শেষে দর্শনায় আসার জন্য বাস না পেয়ে চুয়াডাঙ্গা বড় বাজার থেকে থ্রি-হুইলার সিএনজিতে ওঠেন। পথের মধ্যে দর্শনা বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছানোর আগে দর্শনা মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালের সামনে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
নিহতের ভাই দর্শনা সাংবাদিক সমিতির সভাপতি আওয়াল হোসেন জানান, আজ রোববার বেলা ১১টার দিকে পরাণপুর স্কুলমাঠে জানাজা শেষে স্থানীয় গোরস্থানে তাঁর দাফনকার্য সম্পন্ন করা হতে পারে। জানাজা ও দাফন কাজে সবাইকে শরিক হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন সাংবাদিক আওয়াল হোসেন।
এদিকে, নজির আহমেদের মর্মান্তিক মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ ও শোকসপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন চুয়াডাঙ্গা জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাষক মাহফুজুর রহমান মনজু, পারকৃষ্ণপুর-মদনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাকারিয়া আলম, দর্শনা পৌর মেয়র মতিয়ার রহমান, বিএনপি মনোনীত দর্শনা পৌর মেয়র প্রার্থী হাবিবুর রহমান বুলেট, মুকুল শাহ, কেরুজ মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) শেখ শাহাবুদ্দিন, দৈনিক সময়ের সমীকরণ-এর প্রধান সম্পাদক নাজমুল হক স্বপন, সম্পাদক ও প্রকাশক শরীফুজ্জামান শরীফ, বার্তা সম্পাদক হুসাইন মালিক, ওয়েভ ফাউন্ডেশন, দর্শনা প্রেসক্লাব, গণউন্নয়ন গ্রন্থাগারসহ বিভিন্ন সংগঠন।
অপর দিকে, চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকায় ট্রাকের ধাক্কায় অবৈধ যান আলমসাধুতে থাকা ৯ জন ইটভাটার শ্রমিক (যাত্রী) গুরুতর জখম হয়েছেন। তাঁদেরকে উদ্ধার করে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এদের মধ্যে দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁদের রাজশাহীতে রেফার্ড করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। গতকাল শনিবার বেলা তিনটার দিকে শহরের ঝিনাইদহ বাস্ট্যান্ডের নিকট এ দুর্ঘটনা ঘটে। আহতরা হলেন- কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর থানার লক্ষীপুর গ্রামের মোবারক হোসেনের ছেলে জয়নাল আবেদিন (৩৫), চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার শঙ্করচন্দ্র ইউনিয়নের জালশুকা গ্রামের ববোল আলীর ছেলে তৈয়ব আলী (৪০), একই গ্রামের বাচাল আলীর ছেলে জোহর আলী (৪২), মৃত আততাব আলীর ছেলে জাব্বারুল (৩৮), নাসিরের মেয়ে সাবিনা ইয়াসমিন (১০), মজিদের ছেলে বাবলু (৩২), মৃত আইজউদ্দীনের ছেলে আবুল কালাম আজাদ (৪৬), মৃত সুরত আলীর ছেলে সুবহান আলী (৫০), তোফান আলীর ছেলে আজম (৩৫) ও সদর উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের বোয়ালিয়া গ্রামের লোকমানের স্ত্রী রহিমা বানু (৪৬)।
প্রত্যাক্ষদর্শীরা জানান, শনিবার বিকেলে ঝিনাইদহ ঝিনাইদহ বাস্ট্যান্ডের নিকট ইঞ্জিনচালিত অবৈধ যান আলমসাধুকে পিছন দিক থেকে একটি দ্রুতগামী ট্রাক ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যায়। এতে আলমসাধুতে থাকা ১০ জন ইটভাটা শ্রমিক গুরুতর আহত হন। পরে স্থানীয় ব্যক্তিরা আহতদের উদ্ধার করে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নেয়।
আহতরা বলেন, শনিবার বিকেলে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার আকুলদিয়া ইউনিয়নের ভালাইপুর গ্রামের সিটি ইটভাটা থেকে কাজ শেষে ১০ জন শ্রমিক আলমসাধুযোগে বাড়ি ফিরছিলেন। পথের মধ্যে পৌর এলাকার ঝিনাইদহ বাস্ট্যান্ডের নিকট পৌঁছালে পিছন থেকে আসা একটি দ্রুতগামী ট্রাক তাঁদের ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যায়।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. ওয়াহিদ মাহমুদ রবিন বলেন, আহত বাবলু ও সোবহানের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাঁদের মাথায় ও বুকে প্রচণ্ড আগাত লেগেছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য একজনকে রাজশাহী, অপরজনকে যশোরে রেফার্ড করা হয়েছে। বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে সদর হাসপাতালে ভর্তি রাখা হয়েছে।
এদিকের আহত জোহর আলীকে রাজশাহী নেওয়ার পথে মৃত্যু হয়েছে। সন্ধ্যা ৬টার দিকে চুয়াডাঙ্গা থেকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পূর্বেই তাঁর মৃত্যু হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করে নিহত জোহর আলীর পরিবারের সদস্যরা বলেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতল থেকে অ্যাম্বুলেন্সযোগে আহত জোহর আলীকে রাজশাহী নেওয়ার পথে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে নেওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে নিহত জোহর আলীর মৃতদেহ গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। নিহত জোহর আলী চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার শঙ্করচন্দ্র ইউনিয়নের জালশুকা গ্রামের বাচাল আলীর ছেলে।
চুয়াডাঙ্গা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু জিহাদ খান বলেন, পৌর এলাকার ঝিনাইদহ বাস্ট্যান্ডের নিকট একটি দ্রুতগামী ট্রাক ধাক্কায় ইঞ্জিনচালিত অবৈধ যান আলমসাধুর ১০ জন যাত্রী আহত হয়েছেন। দুজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বাইরে রেফার্ড করেছেন চিকিৎসক। ট্রাকটি ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে গেলেও ট্রাকচালক ও মালিককে শনাক্ত করেছি। অভিযোগ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।
অন্যদিকে, জীবননগর উথলী বাসস্ট্যান্ডের সামনে বাসের ধাক্কায় শিশুসহ ইজিবাইকের চার যাত্রী গুরুতর আহত হয়েছেন। তাঁদেরকে উদ্ধার করে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গতকাল শনিবার বেলা দেড়টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে। আহতরা হলেন- চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার দোস্ত গ্রামের মৃত সুরুজ বাঙ্গালীর স্ত্রী (৫০), দামুড়হুদা উপজেলার কেষ্টপুর মাঝেরপাড়ার মৃত সজিদ কাদির ছেলে মুক্তার কাদি (৪৫), তাঁর মেয়ে মাহিলা খাতুন (১০) ও দোস্ত গ্রামের মৃত সোনা মিয়ার ছেলে শাকিক মিয়া (৪৬)।
প্রত্যাক্ষদর্শীরা বলেন, গতকাল শনিবার দুপুরে উথলী বাসস্ট্যান্ডের সামনে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকটি পৌঁছালে পিছন থেকে আসা একটি দ্রুতগামী যাত্রীবাহী বাস ধাক্কা দেয়। এতে ইজিবাইকে থাকা চারজন যাত্রী ছিটকে রাস্তায় পড়ে যান। পরে স্থানীয়রা তাঁদেরকে উদ্ধার করে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করে। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক বলেন, আহত তিনজনের অবস্থা আশঙ্কা মুক্ত। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাঁদের ভর্তি রাখা হয়েছে।