বিচারিক আদালতের রায় ও আদেশের নথি, মামলার এজাহার, অভিযোগপত্রের তথ্য জালিয়াতির মাধ্যমে উচ্চ আদালতে জামিন আবেদনের ঘটনা যেন থামছেই না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গতকাল রবিবার পর্যন্ত হাইকোর্টের বিভিন্ন বেঞ্চে অন্তত ৮টি জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়েছে। এমনকি ধর্ষণ মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামির আপিল হাইকোর্টে বিচারাধীন থাকাবস্থায় বিচারিক আদালতের রায়ের বিকল্প নথি বানিয়ে জামিনের চেষ্টাও হচ্ছে। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, জামিন জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকটি চক্র। তাদের সহযোগিতা করে আদালত অঙ্গনের কয়েকজন অসাধু আইনজীবী, তাদের সহকারী ও পুলিশ। আসামিপক্ষ খুব সুচতুরভাবে জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়ায় অনেক সময় আদালত ও রাষ্ট্রপক্ষকে বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়।
সম্প্রতি ঝিনাইদহের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের মামলার রায়ের সার্টিফায়েড কপি (রায়ের অনুলিপি) জাল করে ধর্ষণ মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকে সাত বছর, এক আসামির জায়গায় চারজন ও এক আসামিকে ৬৫ বছরের বৃদ্ধ দেখিয়ে হাইকোর্টে জামিন নেওয়ার চেষ্টা করেছে আসামিপক্ষ। জালিয়াতির এ বিষয়টি ধরা পড়ায় গতকাল এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের বেঞ্চ।
আরও পড়ুন : অধিকার বা দলীয় দাবি আদায়, কোনটিতেই সক্রিয় নয় বিএনপি
মামলার নথি অনুযায়ী, ২০১৩ সালের ধর্ষণের ওই মামলায় ২০১৫ সালের ৮ জুলাই একমাত্র আসামি কবির বিশ্বাসকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯ (১) ধারা অনুযায়ী যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ডের রায় দেয় ঝিনাইদহের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। রায়ে জরিমানার অর্থ ধর্ষণের ফলে জন্ম নেওয়া শিশুটিকে দেওয়ার পাশাপাশি ২১ বছর পর্যন্ত তার ভরণপোষণের খরচও আসামির কাছ থেকে আদায় করতে বলা হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে আইনজীবীর মাধ্যমে একই বছর হাইকোর্টে আপিল করেন কবির বিশ্বাস। আপিল বিচারাধীন থাকাবস্থায় ২০১৮ সালের ২৫ জানুয়ারি ও ৩০ মে দুই দফায় হাইকোর্টে জামিনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন তিনি। একপর্যায়ে জামিন পেতে বেপরোয়া আসামিপক্ষ জালিয়াতির আশ্রয় নেয়। বিচারিক আদালতের রায়ের তারিখ ২০১৯ সালের ২৫ নভেম্বর উল্লেখ করে রায়ের বিকল্প নথি সৃজন করে ফের হাইকোর্টে আপিল করা হয়। মূল রায়ে আসামির বয়স ৩২ বছর থাকলেও ওই নথিতে বয়স ৬৫ বছর দেখানোর পাশাপাশি চার আসামির কথা উল্লেখ করা হয়। সৃজনকৃত ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, আসামির বয়স ৬৫ বছর হওয়ায় তার সাজা কম হওয়া উচিত। জাল ওই রায়ে আসামি কবির বিশ্বাসকে সাত বছর এবং অন্য তিন আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দেখানো হয়। গত ১৬ সেপ্টেম্বর আপিল গ্রহণ করে সাজা কেন বাড়ানো হবে না জানতে চেয়ে রুল জারি করে হাইকোর্টের একই বেঞ্চ।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারওয়ার হোসেন বাপ্পী বলেন, ‘আসামিপক্ষের এমন জালিয়াতিতে হাইকোর্ট বিভ্রান্ত ও বিস্মিত হয়েছেন। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ৯ (১) ধারা অনুযায়ী, ধর্ষণের একমাত্র শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। কিন্তু আসামিপক্ষ সেখানে দেখিয়েছে মাত্র সাত বছর কারাদণ্ড। গোড়া থেকেই মামলার নথি নিয়ে সন্দেহ ছিল। মূল মামলায় আসামি একজন থাকলেও সৃজনকৃত নথিতে চারজন উল্লেখ করা হয়েছে। ঝিনাইদহে একটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল থাকলেও ওই রায়ের নথিতে ট্রাইব্যুনাল-২ এর কথা বলা হয়েছে। হাইকোর্ট এতটাই বিভ্রান্ত হয়েছে যে, ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারককেও তলব করেছিল। মামলায় আপিল গ্রহণের আদেশ ও আসামির সাজা বাড়ানোর প্রশ্নে যে রুল এবং তলবের সেই আদেশ আজ (গতকাল) রিকল (প্রত্যাহার) করে ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আদালত আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। পাশাপাশি আরও কেউ জড়িত থাকলে তাদেরও আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এর আগে বিভিন্ন সময় নথি জালিয়াতি করে জামিনসহ অন্যান্য আবেদনের ঘটনা দেখেছি। কিন্তু মূল রায়ের নথি সৃজন করে কারাদণ্ড কমিয়ে, বয়স বেশি দেখিয়ে জামিন চাওয়ার ঘটনায় আমরা হতবাক। বিষয়টি সম্প্রতি অনুসন্ধান করে জানতে পারি ঝিনাইদহ কারাগারের দুই কারারক্ষী (কনস্টেবল) বিশ্বজিৎ ওরফে বাবু ও খাইরুল আসামিপক্ষের আইনজীবীর সহকারী সোহেল রানাকে সৃজনকৃত রায়ের নথি সরবরাহ করেন। আর এ মামলায় হলফকারী ও তদবিরকারী চানদালি বিশ্বাস ও কাদের নামের দুজন।’
এ মামলায় হাইকোর্টে আসামি কবির বিশ্বাসের আইনজীবী শেখ আতিয়ার রহমান বলেন, আদালতে লিখিত আবেদন দিয়ে তিনি এ মামলা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমার ক্লার্ক (সহকারী) এই মামলার নথি আমাকে সরবরাহ করেছেন। আর রায়টি এমনভাবে সৃজন করা হয়েছে যে, কোনো আইনজীবীর পক্ষেই এটি বোঝা সম্ভব না। আমি যখন বিষয়টি বুঝতে পারলাম নিজের তাগিদে ঝিনাইদহে খোঁজখবর নিয়েছি। এরপর আমি নিজেই হাইকোর্টকে অবহিত করে এই মামলা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছি। এ নিয়ে যে আদেশগুলো দিয়েছিল সেগুলো রিকল করেছে হাইকোর্ট।’
এ বিষয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘এর আগে আদালতের বিভিন্ন আদেশ ও নথি জালিয়াতির ঘটনা ঘটলেও বিচারিক আদালতের রায়ের পুরো নথি জালিয়াতির ঘটনা শুনিনি। এটি একটি ভয়ংকর এবং গর্হিত অপরাধ। যারা এ ধরনের জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা উচিত। কেননা রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের একটি বিচার বিভাগ। এ ধরনের ঘটনা বিচার বিভাগের জন্য সুখকর নয়। এসব পরিস্থিতি খুব শক্তভাবে মোকাবিলা করা উচিত।’
গত বছর সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে খুলনার দীঘলিয়া উপজেলার গাজীরহাট বাজারের পাশে কাঁঠালতলা ভ্যানস্ট্যান্ডে টিপু শেখ নামে একজনকে হত্যার ঘটনায় গত ১৮ মে হাইকোর্ট থেকে জামিন পান পাঁচ আসামি। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ভুয়া এজাহার দাখিল ও তথ্য গোপন করে জালিয়াতির মাধ্যমে জামিন নেওয়ার অভিযোগে গত ১০ জুন জামিন বাতিলের আদেশ এবং ইতিমধ্যে জামিন পেয়ে থাকলে তাদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয় বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিমের ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ। একই সঙ্গে আসামিদের আইনজীবীকে (আবু হেনা মোস্তফা কামাল) কারণ দর্শানোর (শোকজ) পাশাপাশি ভার্চুয়াল আদালতে মামলা পরিচালনা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়।
২০১৫ সালের ৪ মার্চ ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীতে রেজাউল ইসলাম (১৮) নামে একজনকে হত্যা মামলায় একই বছরের এপ্রিলে তিনজন হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। বিচারিক আদালতে আসামিদের জামিনের আবেদন একাধিকবার নামঞ্জুর হলে আদালতের আদেশ জাল করে গত বছরের ৮ জুলাই হাইকোর্ট থেকে অন্তর্বর্তীকালীন (ছয় মাস) জামিন নিয়ে লাপাত্তা হন আসামি জামিল। বিষয়টি নজরে আসার পর গত ৩ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের পক্ষে রাজধানীর শাহবাগ থানায় মামলা করা হয়। পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুসারে, জামিনের জন্য জালিয়াত চক্রকে ৮৫ হাজার টাকা দেয় জামিল। এ ঘটনায় গত ৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানী থেকে আইনজীবীর সহকারী খলিল উদ্দিন এবং পরে বেলালকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি গোপালগঞ্জের বেদগ্রাম সিলনা রোড এলাকায় গৃহবধূ জাকিয়া বেগম হত্যা মামলায় স্বামী মোর্শেদায়ান নিশানের বিরুদ্ধে জাল নথি তৈরি করে হাইকোর্টে জামিনের আবেদনের চাঞ্চল্যকর ঘটনা ধরা পড়ে গত বছর ৩ নভেম্বর। বিচারপতি শেখ আব্দুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে আবেদনটি করা হয়। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কে এম মাসুদ রুমি দেশ রূপান্তরকে বলেন, গোপালগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে থাকা এ মামলায় উচ্চ আদালতে দেখানো হয় জেলা দায়রা আদালতে বিচারকাজ চলছে। জামিন পেতে আসামি মামলার এজাহার, চার্জশিট ও সাক্ষীর জবানবন্দির নথি এমনভাবে জাল করে যে, প্রধান আসামি হলেও নথিতে তাকে দ্বিতীয় আসামি হিসেবে উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট কোনো অভিযোগই নেই বলে জানানো হয়। বিষয়টি নজরে আনা হলে তদন্তের নির্দেশ দিয়ে দোষীদের চিহ্নিত করতে বলে হাইকোর্ট।
ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তার যুবলীগ নামধারী ঠিকাদার এস এম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীমকে গত ৪ ফেব্রুয়ারি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় এক বছর এবং অস্ত্র আইনের মামলায় ৬ ফেব্রুয়ারি ছয় মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেয় হাইকোর্টের আলাদা বেঞ্চ। গত ৭ মার্চ বিষয়টি জানাজানি হলে তোলপাড় শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা জানান, কার্যতালিকায় আসামির নাম লেখা রয়েছে এস এম গোলাম। এ কারণে তারা বিভ্রান্ত হয়েছেন। তথ্য গোপন করে জামিন নেওয়ার বিষয়টি ধরা পড়ার পরদিনই হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ জামিনের আদেশ প্রত্যাহার করে নেয়।
হত্যাচেষ্টার অভিযোগে কক্সবাজারের চকরিয়া থানায় এক মামলার আসামি জামাল উদ্দিন ও কামাল উদ্দিনকে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ দুই সপ্তাহের আগাম জামিন দিয়ে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়। একই দিন ওই মামলার অন্য আসামিরা অন্য একটি বেঞ্চে আগাম জামিনের আবেদন করলে তাদের বিষয়েও একই আদেশ আসে। এদিকে জামাল ও কামাল হাইকোর্টের আদেশ পালন না করেই তথ্য গোপন করে ফের আগাম জামিন চেয়ে অন্য বেঞ্চে আবেদন করেন। গত ১১ মার্চ দ্বিতীয় দফায় করা আগাম জামিন আবেদনের শুনানিতে জালিয়াতির বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আসে। আদালত দুই আসামিসহ তদবিরকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে শাহবাগ থানাকে নির্দেশ দিয়ে দুই আসামিকে তাৎক্ষকিভাবে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। এ ঘটনায় আসামিপক্ষের আইনজীবী জুলফিকার আলী জুনুর কাছে ব্যাখ্যা চায় হাইকোর্ট। তথ্য গোপন করে বিচারিক আদালতের জামিন নামঞ্জুরের আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের দুটি বেঞ্চে প্রায় একই সময়ে জামিনের আবেদন করায় দুর্নীতির মামলার এক আসামিকে (তসলিম উদ্দিন) গত ২৭ জানুয়ারি ২ লাখ টাকা জরিমানা করে তার জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের হাইকোর্ট বেঞ্চ।
অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মমতাজ উদ্দিন ফকির বলেন, ‘আদালতে নথি জাল-জালিয়াতির বিষয়ে আমরা রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা সতর্ক রয়েছি। যখনই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে, তখনই সংশ্লিষ্ট আদালতের আদেশ রিকল (প্রত্যাহার) করা হচ্ছে। জালিয়াতির মাধ্যমে কোনো আসামি যেন কোনো অনৈতিক সুবিধা নিতে না পারে সেজন্য আদালত ও আমরা তৎপর।’ -দেশ রূপান্তর