নিঃসন্তান মায়ের পাশে দাঁড়ালেন মাসুদুর রহমান
মামুনুর রশীদ/ফরিদপুর প্রতিনিধিঃ
নিঃসন্তান ও বিধবা গোলাপজান বেগম। বয়স নব্বইয়র কোঠায়। এক মুঠো ভাতের আশায় জীবনের শেষ মুহূর্তে চরম অসহায় জীবন যাপন করছিলেন তিনি। বিশেষ করে নিজের সম্বল বলতে ছিল স্বামীর পৌনে দুই শতাংশ জমি। কিন্ত বিধিবাম! তাও অন্যের দখলে।
সরকারি তদন্তের কাজ করতে গিয়ে গোলাপজানের সাথে দেখা হয় সরকারী কর্মকর্তা মাসুদুর রহমানের। নিজের মায়ের মত করে দেখে ছিলেন তাকে নিজের চোখে। স্থানীয়দের কাছ থেকে বৃদ্ধা গোলাপজান বেগমের সংসার জীবনের ইতিহাস শুনেন। অসহায় একজন মায়ের ক্ষুদার আর্তনাদের কথা শুনে মানবিক হৃদয় কেপে উঠেছিল তার। অবশেষে গৃহহীন ও অসহায় বৃদ্ধা মহিলার দায়িত্ব নিলেন ফরিদপুরের ভাঙ্গার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাসুদুর রহমান। ঘটনার পর গোঁটা উপজেলায় আলোচিত হয়ে উঠেছেন। এক মুঠো ভাতের নিশ্চয়তা করে দিলেন মানবিক চেতনার সরকারি কর্মকর্তা মাসুদুর রহমান।
উপজেলার কালামৃধা ইউনিয়নের ভরিলহাট গ্রামের মৃত মুনসুর বেপারী ওরফে গেদার স্ত্রী বৃদ্ধা গোলাপজান বেগম (৭৫)।
স্বামী অনেক আগেই গত হয়েছন। স্বামীর মৃত্যুর পর তার জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। স্বামীর চলে যাওয়া আবার নিঃসন্তান। কে দেখবে তাকে? ভিটে মাটির জমি বলতে এক টুকরা(১.৭৫ শতাংশ)। কিন্ত কাগজে কলমে থাকলেও চুন্নু খলিফা দখল করে রেখেছে গোলাপজানের জমি।
সরজমিনে গিয়ে জানা যায়, বিধবা গোলাপজান যে ঘরে বসবাস করছেন ঠিক যেন কবি জসিম উদ্দিনের আসমানী কবিতার ছাপড়া ঘর। মাটির সঙ্গে নুয়ে পড়েছে ঘরটি। সামাজিক জীবনে একজন মানুষের চাহিদা পূরণে যে টুকুন সুযোগ সুবিধা থাকার কথা তার কোন বালাই নেই। সম্পূর্ণ একটি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পার করছেন তার জীবন। এরপরেও ওই ঝুপড়ি ঘরেই মানবেতর ভাবে জীবন যাপন করছেন তিনি। প্রতিবেশীরা জানান, গোলাপজান যে ঘরে বসবাস করছেন তার ঘরের সীমানা অন্যের জায়গা ছুয়ে যাওয়াতে ছাপড়াটি দাঁড় করাতে দিচ্ছে না প্রতিবেশী আক্তার খলিফা।
আজ শনিবার (১২আগষ্ট) বিকেলে ওই এলাকায় খাস জমি পরিদর্শনে গিয়ে বিষয়টি চোখে পড়ে ভাঙ্গা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাসুদুর রহমানের। ওই অসহায় বৃদ্ধা মানুষকে দেখে তিনি আবেগ আপ্লুত হয়ে উঠেন। স্বামীহারা নিঃসন্তান একজন মায়ের (গোলাপজান বেগমের)মানবেতর জীবনযাপনের লোমহর্ষক বর্ণনা স্থানীয় জনগণের মুখে শুনার পর তার মানবিক চেতনার হৃদয় জেগে উঠে। সরকারী নিয়ম নীতি আর মানবিক দৃষ্টি কোন থেকে ওই বৃদ্ধার জন্য কি করতে পারবেন? গোলাপজান বেগমের সামাজিক দায়িত্ব নেওয়ার পাশাপাশি অন্যের দখলে থাকা দুই শতাংশ জমি দখলমুক্ত ও ছাপরা ঘরটি বসবাসযোগ্য করে দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসেন মাসুদুর রহমান। তাকে দেখভাল করতে কালামৃধা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রেজাউল মাতুব্বরের হাতে তুলে দেন বৃদ্ধ নিঃসন্তান মা গোলাপজান বেগমকে।
গোলাপজান বলেন, পাশের ঘরের চুন্নু বলেছিল ভিটামাটি তার নামে দলিল করে দিলে মৃত্যুর আগপর্যন্ত আমার ভরণ পোষণ করবে। দুনিয়ায় আমার কেউ নেই বলে স্বামীর ভিটায় মরতে পারবো বলে তার কথায় রাজি হয়ে ছিলাম। চুন্নু তার পরিবারের লোকজন ঢাকায় থাকেন বলে জানিয়ে বলেন,চার মাস পর্যন্ত তিন হাজার করে টাকা দিয়েছিল। এরপর থেকেই আমার শেষ সম্বল শেষ হয়ে গেছে। তারপর থেকে গ্রামের মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বেড়াই। কিন্ত কেউ খেতে দেয় কেউ আবার দূর দূর করে তারিয়ে দেয় বাবা। দুচোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলেন, এক মুঠো ভাই চাইতে গেলে কেউ কেউ বলেন,
খলিফার পোলারে জায়গা দিছও তার কাছে যাও। আজকাল শারীরিক অবস্থা তেমন ভাল যাচ্ছে না। বিভিন্ন রোগ বাসা বেঁধেছে। ঘর থেকে বাহিরে বেশী হাঁটতে পারি না। কোন রকম খেয়ে না খেয়েই চলছি। মাঝে মধ্যে গ্রামের কেউ কেউ খাবার দিয়ে যায়। শুনলাম সরকারি একজন বড় বাবু এসেছেন। খুব ভাল মানুষ। আমারে আমার খাবার দাবারে কোন কষ্ট যাতে না হয় তিনি সবকিছু দিবেন। দোয়া করি আল্লাহ তাকে ও তার পরিবারের সবারে ভাল রাখুন। কতদিন আর বাচুম বাজান। তার দয়ায় আল্লাহ যতদিন বাচিয়ে রাখবেন ততদিন পর্যন্ত আমার দয়ালের কাছে ওই ভাল মানুষটির জন্য মন ভরে দোয়া করে যাবো। এসময় পাশে দাঁড়িয়ে নীরব নিথর মনদিয়ে গোলাপজান বেগমের কথাগুলো শুনতে ছিলেন সহকারী কমিশনার (ভুমি) মাসুদুর রহমান। উপস্থিত অনেকের দুচোখ বেয়ে পানি ঝরছিল গোলাপজান বেগমের কথাগুলো শুনে। নিজের আবেগ থামতে পারেন নি বলে সহকারী কমিশনার (ভুমি) মাসুদুর রহমান মায়ের মত করে আগলে ধরেন গোলাপজান বেগমকে। সেই দৃশ্য দেখে আরও জল গড়িয়ে পড়েছিল গ্রামবাসীর চোখে।
সাংবাদিক শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ঘটনাটি আমার এলাকায়। গ্রাম্যভাবে অনেকবার তার হয়ে কথা বলেছি। কিন্ত চুন্ন পরিবার ঢাকায় থাকেন সবসময়ে পাওয়া যায় নি। ওই বৃদ্ধা মহিলার মত এতটা অসহায় ও দুঃখী মানুষ দুনিয়ায় নেই বলে উল্লেখ সহকারী কমিশনার (ভুমি) মাসুদুর রহমানকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছেন তার প্রমাণ গোলাপজান বেগমের জন্য ওই সরকারি কর্মকর্তাকে পাঠিয়েছেন।
কালামৃধা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রেজাউল মাতুব্বর বলেন, আমার ইউনিয়নে একজন অসহায় বৃদ্ধা মা মানবেতরভাবে জীবন যাপন করছেন আমার জানা ছিল না। ভাঙ্গা সহকারী (ভূমি) কমিশনার স্যারের সাথে না আসলে বিষয়টি কোন দিন জানতেই পারতাম না। আমি এখন থেকে ইউনিয়ন ও আমার ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে তার জন্য সকল ধরণের সুবিধা দেওয়ার কথা দিচ্ছি।
মাসুদুর রহমান বলেন, নিঃসন্তান বিধবা অসহায় একজন বৃদ্ধা নারীই শুধু নন গোলাপজান বেগম। তিনি হতে পারতেন হয়ত কারো মা। তিনি আজকে যেভাবে জীবন যাপন করছেন যদি আল্লাহপাক তাকে সন্তান দিতেন তাহলে হয়ত তার জীবনে এমন কিছু নেমে আসতো না। কিন্ত এক মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ভিটা টুকুও অন্যেরা দখলে। আমি মর্মাহত হয়েছি। মানুষ সামাজিক জীব। কিন্ত কাউকে গোলাপজান বেগম মায়ের জন্য এগিয়ে আসতে না দেখে আমার হৃদয় ব্যথিত হয়ে উঠেছিল। বিষয়টি আমি জেলা প্রশাসক ও ভাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী স্যারের সাথে কথা বলেছি। সেই সূত্রতায় বৃদ্ধার সকল দায়িত্ব গ্রহনের পাশাপাশি বেদখল জমি বের করে বুঝিয়ে দিতে চায় প্রশাসন। আজকের পর থেকে জীবনের প্রতিটি দিন গ্রামবাংলার একজন মা সুন্দর করে বাঁচতে পারেন এটাই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশের উন্নয়নের রুপক কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি।