সারা দেশে অবৈধভাবে কার্যক্রম চালাচ্ছে ৭ হাজার ৪১০টি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এরা নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেনি। বেঁধে দেয়া সময়ও শেষ হয়ে গেছে।
ফলে এদের হাতে এখন বৈধ কোনো লাইসেন্স নেই। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেককে সুযোগ দেয়ার পরও নিবন্ধনের জন্য আবেদনই করেনি।
এ হিসাবের বাইরে আরও দেড় হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান আছে যাদের কোনো কাগজপত্র নেই। স্বাস্থ্য অধিদফতরও এদের হদিস জানে না। এরা সবাই বছরের পর বছর ধরে নিজেদের খেয়ালখুশিমতো প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে আসছে।
এসব হাসপাতালে নেই প্রয়োজনীয়সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম।
এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নিতে গিয়ে অনেকেই ক্ষতির মুখে পড়েছেন, অঙ্গহানির ঘটনাও ঘটেছে। সর্বশেষ বেঁধে দেয়া সময় পার হয়ে গেছে দু’মাস আগে। এরপরও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
জানা গেছে, ১৯৮২ সাল থেকে এ পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে নিবন্ধন নিয়ে সারা দেশে ১৫ হাজারের কিছু বেশি প্রতিষ্ঠান হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক, ব্লাডব্যাংক পরিচালনা করে আসছে।
আগামী ৩ দিনে রাতের তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস পেতে পারে
বর্তমানে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে তালিকা আছে ১৩৪২৬টির। বাকি দেড় হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠানের কোনো হদিস নেই। অথচ প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
অধিদফতর এখন এই সাড়ে ১৩ হাজার প্রতিষ্ঠান ধরেই হিসাব কষছে। চলতি বছর সেই তালিকা থেকে নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে ৬ হাজার ১৬টি। ত্রুটিপূর্ণ আবেদনসহ নানা কারণে বাকি সাত হাজার ৪১০টির লাইসেন্স নবায়ন হয়নি।
ফলে এসব প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন ছাড়া অবৈধভাবে চলছে। অথচ যাদের লাইসেন্স আছে তাদের প্রতি বছর নবায়ন করার কথা।
এ ব্যাপারে বাধ্যবাধকতাও আছে। কিন্তু বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান তা মানছে না। নিবন্ধন হালনাগাদ করতে (লাইসেন্স নবায়ন) চাপ দিলেও কাজ হচ্ছে না।
স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করে নবায়ন ছাড়াই রমরমা বাণিজ্য চালাচ্ছে কয়েক হাজার হাসপাতাল ও ক্লিনিক।
এ পরিস্থিতিতে দেশের বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোকে শৃঙ্খলায় আনতে চলতি মাসের ৮ তারিখ দেশের সব সিভিল সার্জনদের প্রতি নির্দেশ দেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক।
ওইদিন তিনি ভিডিও কনফারেন্সে সব বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) এবং সিভিল সার্জনদের পরের তিন কার্যদিবসের মধ্যে নিজ নিজ জেলায় অনিবন্ধিত, অবৈধ ও নিয়মবহির্ভূতভাবে পরিচালিত সেবার মান খারাপ এমন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার নির্দেশ দেন তিনি।
এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিয়ে প্রয়োজনে সিলগালা করে মহাপরিচালকে অবগত করতে নির্দেশ দেয়া হয়। ৯ নভেম্বর এ সংক্রান্ত আদেশ জারি হয়।
তবে তিন কর্মদিবস ইতোমধ্যে শেষ হলেও কোনো জেলা বা বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত তথ্য এখনও আসেনি। তাই কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
এদিকে অধিদফতরের এক প্রভাবশালী কর্মকর্তা জানান, মহাপরিচালক এসব নির্দেশ দেয়ার পর অনেক সিভিল সার্জন হাসপাতাল শাখায় চাপ সৃষ্টি করছেন।
যাতে তার জেলার সব বেসরকারি হাসপাতালের নিবন্ধন হালনাগাদ করা হয়। তবে বেসরকারি হাসপাতালের নিবন্ধন প্রক্রিয়া অটোমেশনে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় ইচ্ছামতো লাইসেন্স নবায়ন করা সম্ভব নয়।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম যুগান্তরকে বলেন, লাইসেন্স নবায়নের বিষয়টি একটি চলমান প্রক্রিয়া। আমি সব সিএসদের বলেছি জেলা থেকে তালিকা পাঠাতে।
তারা রোববার পর্যন্ত সময় নিয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের জনবল স্বল্পতা রয়েছে। তালিকা ধরে নিয়মবহির্ভূত হাসপাতাল-ক্লিনিকে অভিযান চালিয়ে সেগুলো বন্ধ করা হবে।
তবে একসঙ্গে সব জায়গায় হয়তো অভিযান চালানো যাবে না। আমি সিভিল সার্জনদের বলেছি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অনিবন্ধিত হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে।
বর্তমানে অধিদফতরের তালিকায় মোট ১৩ হাজার ৪২৬টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৩ হাজার ৮৬৮টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ২ হাজার ৬৮৫টি, রাজশাহী বিভাগে এক হাজার ৮৩৪টি, রংপুর বিভাগে এক হাজার ৬২টি, খুলনা বিভাগে এক হাজার ৭১৭টি, বরিশাল বিভাগে ৮২০টি, সিলেটে ৫৭৯টি এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৮৬১টি।
এ তালিকাভুক্ত ছয় হাজার ১৯টি প্রতিষ্ঠান তাদের নিবন্ধন হালনাগাদ করছে এ বছর। এর মধ্যে ৩ হাজার ৮২৩টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার। ২ হাজার ১১৩টি হাসপাতাল এবং ৮০টি ব্লাডব্যাংক। এ ছাড়া ৩ হাজার ৪১৯টি প্রতিষ্ঠান তাদের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে।
তারা নিবন্ধন পাবে। তবে হাতে পেতে আরও কতদিন লাগবে তা নিশ্চিত নয়। বাকি ৪ হাজার ৩০২টি প্রতিষ্ঠান এখনও তাদের নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্নই করেনি।
এসবের বাইরে আরও দেড় হাজারের বেশি আছে যাদের কোনো কাগজপত্র নেই। স্বাস্থ্য অধিদফতরও এদের ব্যাপারে কিছুই বলতে পারছে না।
গত ২৬ জুলাই কোভিড-১৯ বিষয়ক শক্তিশালী টাস্কফোর্স গঠন করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এরপর ৮ আগস্ট টাস্কফোর্সের দ্বিতীয় সভায় বেসরকারি হাসপাতালের লাইসেন্স নবায়ন সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
পাশাপাশি সেই সভা শেষে টাস্কফোর্সের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ২৩ আগস্টের মধ্যে বেসরকারি হাসপাতালের লাইসেন্স নবায়ন করতে হবে।
এই সময়ের মধ্যে যারা নবায়নে ব্যর্থ হবে তাদের হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হবে। এ ধরনের সিদ্ধান্তের পর দু’মাসের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। কিন্তু কারও কার্যক্রম বন্ধ করা হয়নি।
সবাই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এদের অনেকেই অনিয়ম করছে। এতে কেউ চোখ হারাচ্ছে, কেউ মারা যাচ্ছেন। এরপর দু-একদিন সংশ্লিষ্টদের তৎপরতা বেড়ে যায়। এরপর সেই আগের অবস্থা।
অধিদফতরের হাসপাতাল শাখার কর্মকর্তারা জানান, প্রতি বছর ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর লাইসেন্স নবায়নের জন্য পরিবেশগত ছাড়পত্র, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিস্তারিত বিবরণ, সিটি কর্পোরেশনের ছাড়পত্র, কর সার্টিফিকেট এবং অন্যান্য নথি প্রয়োজন।
এই আলোকে এসব হাসপাতালকে নিয়মিত নোটিশ দেয়ার পাশাপাশি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। কিন্তু এসব কাগজপত্র দিতে পারে না বলে লাইসেন্স নবায়ন করতে আসে না বেসরকারি এসব প্রতিষ্ঠান।
অধিদফতরের আরেকটি সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক পরিপত্রে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের নিবন্ধন ফি এবং নিবন্ধন নবায়ন ফি পাঁচ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে সর্বনিু ৫০ হাজার ও সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
এরপর পাঁচ হাজার হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার লাইসেন্স নবায়ন করলেও বাকিরা লাইসেন্স নবায়ন করতে আসেনি। এছাড়া আবাসিক এলাকায় বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক না রাখার নির্দেশনা থাকার বিষয়টি নবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত জুলাই মাসে রিজেন্ট হাসপাতালের নানা অপকর্ম বেরিয়ে আসার পর দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলোর লাইসেন্সের বিষয়টি সবার নজরে আসে। তারপর দেশের সব বেসরকারি হাসপাতালের লাইসেন্স নবায়ন করতে সংশ্লিষ্টের নির্দেশ দেয়া হয়।