থমকে আছে বিএনপির পুনর্গঠন কর্মসূচি। হাইকমান্ড স্বাস্থ্যবিধি মেনে দল পুনর্গঠন কার্যক্রমের ঘোষণা দিলেও তা বাস্তবায়ন করতে পারছেন না দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। করোনা ভাইরাসজনিত পরিস্থিতি এবং নেতাদের অনীহায় ব্যর্থ হচ্ছে সারাদেশে দলের জেলা কমিটি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ। এ পরিস্থিতিতে নেতাদের জবাবদিহির আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে হাইকমান্ড।
দলীয় সূত্র জানিয়েছে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচনের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে নানামুখী পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছে বিএনপি হাইকমান্ড।
এ লক্ষ্যে প্রথমেই তৃণমূল থেকে দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে চায় তারা। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙে পুনর্গঠন করতে চাইছে তারা। তৃণমূলের পরিস্থিতি জানতে থানা, পৌর, ইউনিয়নসহ সব পর্যায়ের কমিটির হালনাগাদ তথ্য চেয়ে জেলা নেতাদের কাছে চিঠি দিয়েছে হাইকমান্ড। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দ্রুততম সময়ের মধ্যে কমিটি পুনর্গঠনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকরা মৌখিকভাবে নির্দেশনাও দিয়েছেন। এসব নির্দেশনার মাধ্যমে সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের একটা জবাবদিহির মধ্যে আনতে চাচ্ছে দলটির হাইকমান্ড।
কভিড-১৯ মহামারির পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির সব পর্যায়ের কমিটি গঠন ও পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার সময়সীমা গত ২৩ মার্চ থেকে পাঁচ দফায় বাড়িয়ে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়েছিল। এ নির্দেশনা গত ২০ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তুলে নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্যবিধি মেনে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
বিতর্কিত ও অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে কঠোর অবস্থানে আওয়ামী লীগ
বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা জানান, ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে দলকে শক্তিশালী করার কোনো উদ্যোগই সফল করতে পারছে না দলের হাইকমান্ড। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি হয়নি দলটির। যে প্রক্রিয়ায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সংগঠনকে শক্তিশালী করতে চেয়েছেন, তাতে এতদিনে অনেক জেলা কমিটি পূর্ণাঙ্গ হওয়ার কথা। দলের মেয়াদোত্তীর্ণ সাংগঠনিক ইউনিটের বাইরে ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটিও গঠন হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু কার্যত তা হয়নি।
নেতারা জানান, গত প্রায় দুই বছরে দলের সাংগঠনিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সফলতার মধ্যে রয়েছে কাউন্সিলের মাধ্যমে ছাত্রদলের কমিটি গঠন। সেই কমিটিও আংশিক অবস্থায় রয়েছে। এ ছাড়া ৮১টি সাংগঠনিক কমিটির মধ্যে ২৩টি জেলায় আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। কোনো কাউন্সিল ছাড়াই আংশিক থেকে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়েছে ১০টি জেলায়। ভেঙে দেওয়া হয়েছে তিনটি কমিটি।
আহ্বায়ক কমিটিগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল তিন মাসের মধ্যে কাউন্সিলের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ করার। মেয়াদ শেষ হলেও এগুলোর কাউন্সিল করতে পারেননি দায়িত্বশীল নেতারা। মেয়াদ শেষে এক বছর পর যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা দল, কৃষক দল, শ্রমিক দল, জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস), তাঁতী দল, মৎস্যজীবী দল, ওলামা দল ও মহিলা দলের অবস্থা আরও খারাপ।
অবশ্য কেন্দ্রীয়ভাবে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটি গঠনে সফলতা না এলেও সারাদেশে জেলা-উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটি গঠনে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে। এতে তৃণমূলে ব্যাপক সাড়া পড়েছে বলে মনে করছে দলের হাইকমান্ড।
দল পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার শুরুতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনায় প্রত্যেক বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকরা মিলে দলের সাংগঠনিক চিত্র তৈরি করে পৃথকভাবে বৈঠক করেছিলেন। প্রতিটি জেলার নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে তিনি পর্যায়ক্রমে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করতে থাকেন এবং তিন মাসের মধ্যে কাউন্সিলের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের কঠোর নির্দেশনাও দেন। কিন্তু তারা নির্দেশনা বাস্তবায়নের তেমন চেষ্টাই করেননি। এর মধ্যে গত মার্চ থেকে করোনার প্রভাবে কয়েক দফা দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করা হয়। আর এটিকেই এখন দায়িত্ব এড়ানোর অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানো হচ্ছে বলে অভিযোগ জেলার পদবঞ্চিত নেতাকর্মীদের।
দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, জেলার নেতারা কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠনে ব্যর্থ হলে নতুন যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে কেন্দ্র। বদল হতে পারে জেলার নেতৃত্ব। এমনটাই ইঙ্গিত দিচ্ছেন দলের শীর্ষ নেতারা। তারা বলছেন, যে কোনো মূল্যে দলকে শক্তিশালী করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে।
এদিকে নারায়ণগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর ও ফরিদপুরে এক বছরের বেশি সময় ধরে বিএনপির জেলা কমিটি নেই। এগুলোতে আহ্বায়ক কমিটি গঠনের কাজ চলছে। চলতি মাসে এসব কমিটি ঘোষণা করা হতে পারে। মাদারীপুরের জেলা কমিটির সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। সারাদেশে বিএনপির সাংগঠনিক ইউনিট কমিটির মধ্যে লালমনিরহাট, জয়পুরহাট, কুষ্টিয়া, বরগুনা, জামালপুর, শেরপুর, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, খাগড়াছড়ি ও ঢাকা জেলা বাদে অন্যান্য সব জেলার কমিটিই মেয়াদোত্তীর্ণ। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর ৪৯ সদস্যের ঢাকা জেলা বিএনপির আংশিক কমিটি গঠন করা হয়। এই সাংগঠনিক ইউনিটের মেয়াদ দুই বছর আগে শেষ হয়েছে। কিন্তু গত বছরের ২৪ মার্চ কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হয়েছে।
সেই হিসেবে আগামী বছরের ২৪ মার্চ পর্যন্ত বর্তমান কমিটির মেয়াদ রয়েছে বলে জানিয়েছে বিএনপির দপ্তর শাখা। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির মধ্যে বরিশাল উত্তর জেলা শাখা ২০১০ সাল, বরিশাল মহানগর শাখা ২০১৩ সাল, বরিশাল দক্ষিণ জেলা শাখা ২০১৪ সাল, পিরোজপুর জেলা শাখা ২০১২ সাল, পটুয়াখালী জেলা শাখা ২০১৫ সাল, নরসিংদী জেলা শাখা ২০১১ সাল, কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা শাখা ২০১১ সাল এবং চট্টগ্রাম উত্তর জেলা শাখা ২০১৪ সাল থেকে এখনও বহাল রয়েছে।
এদিকে পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় ভেঙে দেওয়া কমিটিগুলোর নেতারা কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠনের কোনো প্রস্তুতিও নিতে পারেনি। এমনকি জেলার নেতারা কাউন্সিলের জন্য সময় বাড়ানোর কোনো আবেদনও করেননি। কবে নাগাদ তাদের দায়িত্ব সম্পূর্ণ করতে পারবেন- তাও জানাতে পারছেন না তারা। এ পরিস্থিতিতে দলের হাইকমান্ড যে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে দলকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে, তা সহসা আলোর মুখ দেখতে পারবে না বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা।
অবশ্য বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, দলের পুনর্গঠন একটি চলমান প্রক্রিয়া। করোনার কারণে সাংগঠনিক কার্যক্রম দীর্ঘদিন স্থগিত থাকার পর আবারও শুরু হয়েছে। যথাসময়ে পুনর্গঠনের কাজ শেষ করা হবে।
সমকাল