পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় পরে আবার চন্দ্রাভিযানে যাচ্ছে মানুষ – আর কারা যাচ্ছেন সেই অভিযানে, তাদের নাম ঘোষণা করেছে মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসা। অনেকদিন ধরেই এ নিয়ে মাঝে মধ্যে খবর বেরুচ্ছিল, তবে সোমবার ব্যাপারটা চূড়ান্ত হয়েছে।
আজ থেকে প্রায় ৫৪ বছর আগে, ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে প্রথমবারের মত চাঁদের বুকে নেমেছিলেন নাসার দুই নভোচারী নিল আর্মস্ট্রং আর এডউইন অলড্রিন, আর লুনার মডিউলে করে চাঁদ প্রদক্ষিণ করছিলেন তৃতীয় নভোচারী মাইকেল কলিন্স। এর পরে চাঁদের বুকে শেষবার মানুষ নেমেছিল ১৯৭২ সালে। এবার নাসা যে নভোচারী দলটি ঘোষণা করেছে – তারা অবশ্য চাঁদের বুকে নামবেন না, কিন্তু তাদের এই মিশন পরবর্তী কোন একটি দলের চাঁদে অবতরণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
প্রথম চন্দ্রাভিযানে – বা এমনকি শেষটিতেও – নভোচারীরা সবাই ছিলেন শ্বেতাঙ্গ পুরুষ। কিন্তু এবারের চারজনের দলটিতে বিরাট এক পরিবর্তন এসেছে, এতে আছেন একজন নারী – ক্রিস্টিনা কখ, আর একজন কৃষ্ণাঙ্গ নভোচারী -ভিক্টর গ্লোভার। বাকি দুজন হলেন রিড ওয়াইজম্যান আর জেরেমি হ্যানসেন। এই দলটির তিনজন মার্কিন নাগরিক, আর একজন ক্যানাডিয়ান। সোমবার টেক্সাসের হিউস্টনে এক অনুষ্ঠান করে দলটির নাম ঘোষণা করা হয়েছে। একটি ক্যাপসুলে করে তারা চাঁদ প্রদক্ষিণ করবেন – হয়তো আগামী বছরই, বা ২০২৫ সালের কোন এক সময়।
বলা হয়, ১৯৭২ সালের পর চাঁদে মানুষ নামানো যে বন্ধ হয়ে যায় – এর কারণ অনেকগুলো। একটি কারণ – অর্থ। চন্দ্রাভিযান বা মহাকাশ অভিযান প্রচণ্ড রকমের ব্যয়বহুল। ১৯৬৯ সালে প্রথমবার চাঁদের মাটিতে মানুষের পা রাখা নিশ্চয়ই সারা পৃথিবীতে আলোড়ন এবং উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু ১৯৭০এর দশকে এসব অভিযানের পক্ষে মার্কিন জনগণ এবং রাজনীতিবিদদেরও সমর্থন ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছিল। ফলে ১৯৭২এ অ্যাপোলো ১৭-র পর চাঁদে মানুষ পাঠানো অনির্দিষ্টকালের জন্য থেমে যায়।
তাছাড়া অনেকে বলেন, ওই সময়টা ছিল মার্কিন-সোভিয়েত স্নায়ুযুদ্ধ ও সর্বক্ষেত্রে তীব্র প্রতিযোগিতার যুগ। তবে ১৯৬৯ সালে লুই আর্মস্ট্রং ও এডউইন অলড্রিনের চাঁদে নামার মধ্যে দিয়ে মার্কিন মহাকাশ কর্মসূচির ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবার পরই আমেরিকানরা ধীরে ধীরে এ ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। নাসাও ধীরে ধীরে তাদের মহাকাশ কর্মসূচিকে স্কাইল্যাব, স্পেস শাটল, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন ইত্যাদি কর্মসূচির দিকে নিয়ে যায়।
অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৮৬ মহাকাশে স্থাপন করে ‘মির’ স্পেস স্টেশন। পরবর্তীকালে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র মহাকাশ কর্মসূচিতে সহযোগিতাও শুরু করে। শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সময় থেকে মার্কিন মহাকাশ কর্মসূচিতে চাঁদ ও মঙ্গল গ্রহে অভিযানের মত উদ্যোগগুলো আবার জায়গা পেতে শুরু করে। রকেট ও মহাকাশ যান তৈরিতে এগিয়ে আসে বেশ কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, তাদের সাথে নানা কর্মকান্ডে যুক্ত হয় নাসা-ও। তারই ধারাবাহিকতায় এসেছে আর্টেমিসের মত কর্মসূচি – যার লক্ষ্য আবার চাঁদের বুকে মানুষ পাঠানো।
বলা হচ্ছে, এই অভিযানটি হবে মূলত ১৯৬৮ সালের অ্যাপোলো-৮ অভিযানের অনুরূপ। সেটিই ছিল চাঁদে মানুষের প্রথম যাত্রা – প্রথম স্পেসফ্লাইট। সেই নভোচারীরাই চাঁদের দিগন্তে পৃথিবীর ‘উদয়ের’ সেই বিখ্যাত ছবিটি তুলেছিলেন, ঠিক যেভাবে আমরা পৃথিবী থেকে সূর্য বা চাঁদ ওঠার ছবি তুলি। কিন্তু এবারের অভিযানটি – যাকে গ্রিক পৌরাণিক সূর্যদেবতা অ্যাপোলোর যমজ বোনের নামে ‘আর্টেমিস’ কর্মসূচি নাম দেয়া হয়েছে – তা হবে অনেক আলাদা।
এতে ব্যবহৃত হচ্ছে একবিংশ শতাব্দীর সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। নাসা এ জন্য যে বিশেষ রকেট তৈরি করেছে তার নাম ‘স্পেস লঞ্চ সিস্টেম’ এসএলএস – আর এতে সংযুক্ত থাকবে যে ক্যাপসুল বা মহাকাশযানটি তার নাম ‘ওরায়ন’ – এর ভেতরেই থাকবেন নভোচারীরা। গত বছর নভেম্বর মাসে আর্টেমিস ওয়ান এসএলএসের প্রথম রকেটটিকে পরীক্ষামূলক যাত্রায় পাঠানো হয়। ১০০ মিটার লম্বা এই রকেট ছিল নাসার তৈরি করা এ যাবৎকালের সবচেয়ে শক্তিশালী রকেট।
এতে ছিল ২৭ লক্ষ লিটার তরল হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন জ্বালানি। এতে যে ‘থ্রাস্ট’ বা রকেটটির ওপরদিকে ওঠার জন্য উর্ধ্বমুখী চাপ তৈরি হয়- তার পরিমাণ ৩৯ মেগানিউটন বা ৮৮ লক্ষ পাউণ্ড। এই রকেটটি ওরায়ন ক্যাপসুলকে চন্দ্রপৃষ্ঠের ৮০ মাইল দূরত্বে নিয়ে যায়। ওরায়ন ক্যাপসুলটি সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে ঠাসা থাকলেও এটা দেখতে কিন্তু অনেকটা সেই ১৯৬৯ সালের চন্দ্রযান লুনার মডিউলের মতই।
এর কারণ খুবই সহজ। এই যানটিকে নভোচারীদের বহন করে নিয়ে যেতে হবে, আবার নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসতেও হবে। ফিরে আসার সময় যখন এটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকবে তখন এর গতিবেগ হবে প্রায় অকল্পনীয় রকমের দ্রুত – ঘন্টায় ২৪ হাজার মাইল। এর নিচের দিকে যে তাপপ্রতিরোধী ঢাকনা থাকবে তা তখন বাতাসের সাথে ঘর্ষণের ফলে ভীষণ উত্তপ্ত হয়ে যাবে এবং একে ৩,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপ সহ্য করার উপযুক্ত হতে হবে। তা নাহলে অবতরণের সময় মহাকাশযানে আগুন ধরে যাবে।
এই তাপ ও গতির প্রতিক্রিয়া সহ্য করার জন্য এই কৌণিক গঠনটাই সবচেয়ে উপযুক্ত – সে কারণেই আগেকার ডিজাইনটিই প্রায় অপরিবর্তিত রাখা হচ্ছে। পৃথিবীতে ফিরে আসার সময় এটির গতি ঘন্টায় ২৪,০০০ মাইল থেকে মাত্র ১৭ মাইলে নামিয়ে আনার জন্য ১১টি প্যারাশুট এর সাথে যুক্ত থাকছে। যানটির সমুদ্রে আছড়ে পড়ার জন্য ঘন্টায় ১৭ মাইলই হচ্ছে নিরাপদ গতি।
এই ওরায়নের ভেতরে এমন সব প্রযুক্তি থাকবে যা ১৯৬৯ সালের চন্দ্রাভিযানের সময় কেউ কল্পনাও করতে পারেননি। এতে থাকবে একটি ক্রু মডিউল যাতে থাকবেন নভোচারীরা এবং অন্যান্য সরঞ্জাম। ইউরোপিয়ান সার্ভিস মডিউল নামের অংশটিতে থাকবে বিদ্যুতের ব্যবস্থা এবং মহাকাশযানটিকে চালানোর প্রযুক্তি। এর সামনের দিকে থাকবে লঞ্চ অ্যাবর্ট সিস্টেম বা এলএএস – যা কোন বিপদ বা জরুরি অবস্থা দেখা দিলে ওরায়নকে তা এড়াতে সহায়তা করবে। মহাশূন্যের গভীরে যে উচ্চমাত্রার তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ – তা থেকে রক্ষার ব্যবস্থা থাকবে এই ক্যাপসুলের ভেতরে।
সূত্র: বিবিসি