ফরিদপুরে বর্ষা মৌসমে শোভা পাচ্ছে চালতা ফুল
ফরিদপুর প্রতিনিধিঃ
ছয় ঋতুর দেশে প্রকৃতির খেয়াল কিছুটা পরিবর্তনের সূর বাঁধলেও সেই চিরাচরিত নিয়ম তান্ত্রিক ধারায় আজও ষড় ঋতুরাজে বর্ষার কদম-কেয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফুটতে শুরু করে চালতার ফুল। বিশেষ করে ফরিদপুর জেলা সদরের বিভিন্ন ইউনিয়ন এলাকার গ্রামাঞ্চলে ও জেলার উপজেলায় বর্ষায় মৌসুমের অপরুপ সৌন্দর্য পূর্ণতায় শোভা পাচ্ছে চালতা ফুল।
এ ফুল ধবধবে সাদা রঙের। মধ্যে বড্ড মিষ্ট হলদে নীলাভ পাপড়ি। সুরভিত এই ফুলের সাধারন দৃষ্টিতে ব্যাস ১৫ থেকে ১৮ সেন্টিমিটার। ফুলে পাঁচটি মোটা পাপড়ি থাকে। বৃতিগুলো পাপড়িকে ঘিরে রাখে।
পাপড়ির শুভ্রতা, হলুদ পরাগ ও তারকাবৃত্তির গর্ভদন্ড চালতা ফুলের মোহনীয় রূপ প্রকৃতিজুড়ে এমন মৌসমে প্রতিবছরই ঝিলিক তুলে বলে আজও তুলছে প্রকৃতি প্রেমিক মনে মোহিনী ঝিলিক। মুগ্ধ সৌন্দর্য পিপাসুরাও।
তথাপি বিলুপ্ত অধুনা কদমের পরে বর্ষাকে চেনা যায় চালতার ফুলে।
চালতা ফুল খুবই ক্ষণস্থায়ী। ভোরবেলাতে ফোটা ফুলের পাপড়ি সন্ধ্যায় ঝরে পড়ে। চালতা ফুলের প্রকৃত রূপ দেখতে হলে দুপুর হওয়ার আগেই দেখতে হয়। তাইত আজকাল হঠাৎ এ ফুলের দেখা পাওয়া অনেকটা ষাটের দশকের কোন এক প্রকৃতির আবিষ্কারের মতোই। কারন ষাটের দশকের থেকে নব্বই দশকের দিকে বাংলার কোন গায়ের পথে হাটলে বাড়ির পাশের আঙিনায় বা কোন বিদ্যালয়ের পাশে চালতা গাছ দৃশ্যমান ছিল।
কিন্তু আজকাল তেমটি কারো চোখে পড়ে বলে সহসাই একথা বলা যায় না। কালের সাক্ষাৎ হয়ে গ্রামীণ জনপদের কোথাও চালতা গাছের দেখা মিলতে পারে বৈকি কিন্তু সহসায় আমরা শহরের বুকে বসবাসকারীরা বলতে সেটা পারছি না। কারন চালতা গাছ আজকাল অনেকটা দূলর্ভেই পরিণত হচ্ছে বটে এমন অভিমত কৃষি পরিবারের সদস্যদের।
চালতায় রয়েছে বিবিধ খাদ্যগুণ ১.চালতা ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, ভিটামিন ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’-এর ভালো উত্স। ২.প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘সি’ থাকায় এই ফল স্কার্ভি ও লিভারের রোগ প্রতিরোধ করে। ৩.চালতায় রয়েছে বিশেষ ধরনের কিছু অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা জরায়ু ও স্তন ক্যানসার প্রতিরোধ করে। ৪.চালতায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আঁশ যা বদহজম ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
৫.চালতায় উপস্থিত আয়রন রক্তের লোহিতকণিকার কার্যক্রমে সহায়তা করে। রক্তের সংবহন ঠিক রাখে। চালতার বিভিন্ন উপাদান হার্টের নানা রোগ প্রতিরোধেও সহায়তা করে। ৬.চালতা পেটের নানা অসুখ প্রতিরোধে সহায়তা করে। ডায়রিয়া সারাতে কাঁচা চালতার রসের তুলনা নেই। ৭.রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে চালতা। ৮.ঠাণ্ডা ও কাশির জন্য পাকা চালতার রস চিনি মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়। ৯.কিডনীর নানা রোগ প্রতিরোধেও সহায়তা করে চালতা। ১০. অন্ত্রে বাসা বাঁধা কৃমির বিরুদ্ধে লড়াই করতে চালতা অসাধারণ ক্ষমতা রাখে। ১১. পাকস্থলিতে যাদের আলসার আছে, তাদের জন্য উপযুক্ত ওষুধ হতে পারে চালতা। ১২.শুধু ফল নয়, চালতার মূল ও পাতারও রয়েছে ঔষধিগুণ। মচকে গিয়ে ব্যথা পেলে সেখানে চালতা গাছের মূল ও পাতা পিষে প্রলেপ দিলে ব্যথা কমে যায়।
শুধু খাদ্য হিসেবে নয়, রূপচর্চার উপাদান হিসেবেও রয়েছে চালতার ব্যবহার। যেমন ১৩.কাঁচা চালতার জলে মিশিয়ে চুলের গোড়ায় নিয়মিত লাগালে চুল পড়া কমে যায়। ১৪.কাঁচা চালতার রসের সাথে পেঁয়াজের রস মিশিয়ে সপ্তাহে দুবার চুলের গোড়ায় লাগালে খুশকি দূর হয়ে যাবে। ১৫.চালতার রসের সাথে চালের গুঁড়া মিশিয়ে স্ক্রাবার হিসেবে ব্যবহার করলে মরাকোষ পরিষ্কারের পাশাপাশি ত্বক হয়ে ওঠে উজ্জ্বল ও কোমল।
চালতার আদি নিবাস দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। বৈজ্ঞানিক নাম Dillenia indica। শ্রীলঙ্কা, চীন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বেশ কিছু দেশে চালতা জন্মে। ইংরেজিতে Elephant Apple নামে পরিচিত। বিশেষত এটি ভারতবর্ষীয় উদ্ভিদ হিসেবে পরিচিত।গাছ উচ্চতায় প্রায় ২০ মিটার পর্যন্ত হয়। শাখা-প্রশাখা অবিন্যস্ত ও প্রসারিত। সবুজ পাতা খাঁজকাটা ধরনের। আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলে গাছটির দেখা মেলে। গাছটি থেকে শক্ত কাঠ হয়। এছাড়াও নৌকা তৈরিতে ব্যবহার করা হয় চালতার কাঠ।
সরজমিনে ফরিদপুর জেলার বেশ কিছু এলাকায় ঘুরে ঘুরে দেখা যায় চালতে গাছের ডালে ডালে ছেয়ে গেছে ফুলে ফুলে । অধুনা চালতা গাছের অপরূপ দৃশ্যে মুগ্ধ করছে সবাইকে।চালতে ফুলের এই সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে শিশুরা তাদের খেলার অনুষঙ্গ হিসেবে বেছে নিয়েছে এই ফুলকে।
সীমা, সরলা, নামে এক দুই নববধূ বলেন, চালতে ফুল জানিয়ে দেয় বর্ষাকালের রুপ । আমরা এই ফুল দিয়ে চুলের খোপায় পড়েছি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে এই বৃক্ষ লাগানো প্রয়োজন। তা না হলে আগমী প্রজন্ম এ বৃক্ষ অপরূপ দৃশ্যে মুগ্ধ থেকে বঞ্চিত হবে। তারা জানতে পারবে না চালতা গাছ নামের কোন ঔষধী ফল ছিল।
ভাঙ্গা সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক একজন শিক্ষার্থী মাসুম মিয়া বলেন, ভাঙ্গা সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের সাথে একটা বিশাল আকারের চালতা গাছ ছিল। বিদ্যালয়ের শুরু হওয়ার আগে ও টিফিন পিরিয়ডে আমাদের বন্ধুরা (আশির দশকে) মিলে সময় কাটাতাম ঐ চালতা গাছের ছায়ার নিচে। সে সময় বয়েজ এন্ড গার্লস একসাথে ছিল। শহরের বুকে একটাই মাধ্যমিক বিদ্যালয় ভাঙ্গা সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়।
সাংবাদিক সনথ চক্রবর্তী বলেন, আমাদের বাড়ির পাশের একজন প্রতিবেশীর আঙিনায় চালতা গাছ ছিল। চালতার ফুল আসলে আমরা ছোট বেলায় খেলা করার জন্য চুপটি করে চালতার ফুল পারতাম সহপাঠীরা মিলে। কোন একদিন চালতার ফুল পারতে গিয়ে কাকিমার হাতে ধরা পড়ে আমার বাবা মায়ের কাছে নালিশ করায় বড্ড বকা খেতে হয়। ঘটনাটি আজও স্বপ্ন মনে হলেও সাংবাদিকতা পেশায় আসার পর চালতার যে পুষ্টি গুনাগুণ জানতে পারি সেই দৃষ্টি কোণ থেকে বলতে চাই আসুন আমাদের গ্রামীণ জনপদের নুরলদীন ফিরিয়ে আনার লক্ষে নতুন প্রজন্মের জন্য একটা করে চালতা গাছের চারা রোপণ করি।
সদরপুর উপজেলার হাট কৃষ্টপুরের নিতাই দাস জানান, তার পিসির বাড়িতে একটি চালতা গাছ রয়েছে। বর্ষা মৌসুমে চালগাছে ফুল আসে। গোটা গাছ জুড়ে যখন চালতার সাদা ফুল ফুটে ওঠে তখন চালতা ফুলের একটা মৌ মৌ ঘ্রান বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের প্রয়োজনে আমাদেরকে চালতা গাছ রোপন করতে হবে। তানা হলে দেখা যাবে একদিন চালতা গাছ বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
ভাঙ্গা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার তরুণ কুমার সাহা জানান, উপজেলার বারটি ইউনিয়ন এলাকায় বেশ চালতা গাছের দেখতে পাওয়া যায়। এর মধ্যে শুধু পৌরসভার বিভিন্ন ওয়াড এলাকায় দুই শতাধীক চালতা গাছ বিভিন্ন বসতবাড়ি ও ভীটে মাটিতে রয়েছে বলে জানান।
তিনি আরও জানান চালতার বীজ থেকে চারা উৎপাদন হয়ে থাকে। এজন্য কৃষি অফিস নয় যে কোন হটিকালচার থেকে চালতা গাছ সংগ্রহ করা যায়।
ফরিদপুর জেলা কৃষি অফিসার জিয়াউল হক দৈনিক আস্থার প্রতিবেদককে জানান চালতা ফল ফরিদপুরের ঐতিহ্যবাহী একটি ফল। জেলার প্রতিটি বাড়িতেই একটি করে চালতা গাছের দেখা পাওয়া যাবে। কারন বাড়িতে কোন মেহমান আসলে যতই আপ্যায়িত করা হোকনা কেন চালতার আচার থাকবেই। এটাই ফরিদপুরের একটা ঐতিহ্য বলে নিজের মন্তব্য তুলে ধরেন জেলা কৃষি কর্মকর্তা।