জিততে হলে পাড়ি দিতে হত রানের মহাসমুদ্র। তীরেই তরী ডুবিয়ে সেই আশা শেষ হয়েছিল আগেই। অপেক্ষা বাড়ালেন কেবল মাহমুদউল্লাহ। তার দুর্দান্ত সেঞ্চুরির পরও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বিশাল ব্যবধানে হেরে গেছে বাংলাদেশ।
মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে মঙ্গলবার আসরের ২৩তম ম্যাচে বাংলাদেশের হার ১৪৯ রানের। ৩৮৩ রানের লক্ষ্যে ২০ বল বাকি থাকতে ২৩৩ রানেই শেষ হয় সাকিব আল হাসানের দলের ইনিংস।
১৪০ বলে ১৭৪ রানের বিধ্বংসী ইনিংস খেলে ম্যাচের নায়ক কুইন্টন ডি কক। ব্যাট হাতে পার্শ নায়কের ভূমিকায় ছিলেন হেনরিক ক্লাসেন (৪৯ বলে ৯০), এইডেন মার্করাম (৬৯ বলে ৬০) ও ডেভিড মিলার (১৫ বলে ৩৪)।
তাদের তাণ্ডবে বাংলাদেশের হারের গল্প লেখা হয়ে গিয়েছিল মূলত প্রথম ইনিংসেই। অপেক্ষা ছিল হারের ব্যবধান বাংলাদেশ কত কমাতে পারে সেটা দেখার। সেই কাজটা ভালোমতই করলেন মাহমুদউল্লাহ। সতীর্থদের আসা-যাওয়ার ব্যস্ততার মাঝে এই মিডল অর্ডার করেছেন ১১১ বলে ১১১ রান। আসরে সুযোগ পাওয়া তিন ম্যাচেই রান পেলেন তিনি।
দারুণ সব শটে এই অভিজ্ঞ ব্যাটার দেখিয়েছেন এমন উইকেটে কিভাবে টিকে থেকে অবলীলায় রান তোলা যায়।
আসরে ৫ ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার এটি চতুর্থ জয়। সমান সংখ্যক ম্যাচে বাংলাদেশের চতুর্থ হার। ৮ পয়েন্ট নিয়ে নিউজিল্যান্ডকে টপকে ১০ দলের তালিকায় দুইয়ে উঠে এসেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। নিউজিল্যান্ডেরও সমান ৮ পয়েন্ট হলেও নেট রান রেটে এগিয়ে প্রটিয়ারা। ৫ ম্যাচে শতভাগ জয়ে এই তালিকার শীর্ষে স্বাগতিক ভারত।
দারুণ ব্যাটিং উইকেটেও ব্যর্থ বাংলাদেশের ব্যাটাররা। দক্ষিণ আফ্রিকার যিনিই বল হাতে নিয়েছেন, পেয়েছেন উইকেটের দেখা। ৬২ রানে ৩টি নেন কোয়েৎজে। ২টি করে নেন জানসেন, উইলিয়ামস ও রাবাদা।
সপ্তম ওভার থেকে শুরু হয় বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের উইকেটে আসা-যাওয়া। পথ দেখান তানজিদ হাসান। ঠিক পরের বলেই সাজঘরের পথ ধরেন নাজমুল হোসেন শান্ত। রানের চাকা এক ঘাট ঘুরতেই নেই হয়ে যান দলপতি সাকিবও।
তিন জনই আউট হন শর্ট বলে। তিনটি ক্যাচই উইকেটের পিছন থেকে নেন ক্লাসেন। মার্কো জানসেনের লেগ স্টাম্পের বাইরের বলে আউট হন তানজিদ ও শান্ত। সাকিব আউট লিজাড উইলিয়ামসের অফ স্টাম্পের অনেক বাইরের বলে অজানা এক শটে। বিনা উইকেটে ৩০ থেকে ৩১ রানে ৩ উইকেট!
ধৈর্য রাখতে পারেননি মুশফিকুর রহিম, লিটন দাস, মেহেদি হাসান মিরাজরাও। জেরাল্ড কোয়েৎজির অফ স্টাম্পের বাইরে শর্ট লেংথের বলে মুশফিক আউট সরাসরি ডিপ থার্ডে ক্যাচ দিয়ে। উইকেটে লম্বা থেকেও স্বস্তি কাটাতে পারছিলেন না লিটন। তাকে মুক্তি দেন কাগিসো রাবাদা। ঘুরিয়ে খেলতে গিয়ে মিস করে হয়ে যান এলবিডব্লু। মিরাজ আউট সুইপ করতে গিয়ে বাউন্ডারিতে ক্যাচ দিয়ে।
অবাক করার ব্যাপার হলো মাহমুদউল্লাহ ইনিংসের সবচেয়ে বড় জুটিটি গড়েন নবম উইকেটে মুস্তাফিজকে নিয়ে। ৫৬ বলে ৬৮ রানের সেই জুটিতে মুস্তাফিজের অবদান ১৯ বলে ১১।
বিশ্বকাপে বাংলাদেশের নবম উইকেটে সর্বোচ্চ জুটি এখন এটিই। আগের সর্বোচ্চ জুটিতেও ছিলেন মাহমুদউল্লাহ, ২০১১ সালে ইংল্যান্ডকে হারানো ম্যাচে শফিউল ইসলামকে নিয়ে তিনি যোগ করেছিলেন ৫৮ রান।
এর আগে হাসান মাহমুদকে নিয়ে ৪৯ বলে ৩৭ ও নাসুম আহমেদকে নিয়ে ৩৯ বলে ৪১ রানের জুটিতে নেতৃত্ব দেন মাহমুদউল্লাহ।
রাবাদার বল শর্ট বলে ফাইন লেগে খেলে সিঙ্গেলে মাহমুদউল্লাহ স্পর্শ করেন তিন অঙ্ক। উদ্যাপনে লাফ দিয়েছেন, এরপর আঙুল দিয়ে ইশারা করেছেন ওপরের দিকে। এরপর দিয়েছেন সিজদা। সেঞ্চুরি উদযাপনেও মনে হলো নির্বাচকদের একটা বার্তা দিলেন এই অভিজ্ঞ ব্যাটার।
বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান তিনি। ২০১৫ সালে টানা দুই ম্যাচে ১০০ পেরিয়েছিলেন। বিশ্বকাপে এটি তার তৃতীয় শতক।
অথচ বিশ্বকাপের আগে এশিয়া কাপের দলেও ছিলেন না তিনি। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে দলে ফেরানো হয়। এরপর বিশ্বকাপ দলেও জায়গা পান।
কোয়েৎজের বলে লং অনে ক্যাচ দিলে শেষ হয় ১১টি চার ও ৪টি ছক্কায় সাজানো তার ইনিংস। এতকিছুর পরও মাহমুদউল্লাহকে এই ম্যাচে কম সংখ্যক সমর্থকই মনে রাখবেন। ম্যাচটি যে আগেই নিজের করে নিয়েছেন ডি কক।
এর আগে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৪২৮, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩১১ ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩৯৯ রানের পাহাড় গড়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।
২০১৫ বিশ্বকাপে এক আসরে সর্বোচ্চ ৪ বার ৩০০ রানের স্কোর গড়েছিল প্রটিয়ারা। এবার নিজেদের পঞ্চম ম্যাচেই সেটি ছুঁয়ে ফেলল তারা। সব মিলিয়ে রেকর্ডটি ইংল্যান্ডের। ২০১৯ সালের চ্যাম্পিয়নরা ৩০০ রানের স্কোর গড়েছিল ৬ বার।
ডি কক খেলেন ১৪০ বলে ১৭৪ রানের খুনে ইনিংস। আগের ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঝড়ো সেঞ্চুরি করা ক্লাসেনের ব্যাট এদিন ছিল আরও উত্তাল। হাসানের বলে ডিপ পয়েন্টে মাহমুদউল্লাহর হাতে ধরা পড়ার আগে খেলেন ৪৯ বলে ৮ ছক্কা ও ২ চারে ৯০ রানের ইনিংস। মিলার অপরাজিত থাকেন ১৫ বলে ৪ ছক্কা ও ১ চারে ৩৪ রানে।
পঞ্চম উইকেটে ফিফটি আসে স্রেফ ২০ বলে। এই জুটি থেকে আসে ২৫ বলে ৬৫ রান।
৩৬ রানে ২ উইকেট তুলে নিয়ে শুরুটা ভালোই ছিল বাংলাদেশের। এর পরের গল্পটা কেবলই ডি কক-ক্লাসেনদের। শুরুর ধাক্কা সামাল দেওয়ার পথে ডি ককের সাথে তৃতীয় উইকেটে ১৩৭ বলে ১৩১ রানের জুটি গড়েন এইডেন মার্করাম। মার্করাম ৬৯ বলে ৬০ রান করে আউট হন সাকিবকে হাঁকাতে গিয়ে লং অনে।
এরপর ক্লাসেনের সাথে ডি কক ১৪২ রানের বিধ্বংসী জুটি গড়েন স্রেফ ৮৭ বলে। শেষ পর্যন্ত তাকে থামান হাসান মাহমুদ। এর আগে ১৪০ বলে ১৫টি চার ও ৭ ছক্কায় ১৭৪ রানের ইনিংসে গড়েন দারুণ কীর্তি।
আসরের ৫ ম্যাচে এটি তার তৃতীয় শতক। প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকান হিসেবে এক বিশ্বকাপে ৩ বা এর বেশি সেঞ্চুরি পেলেন ডি কক। ১০১ বলে তিন অঙ্ক স্পর্শ করেন বাঁহাতি এই ব্যাটার। ওয়ানডেতে এটি তার ২০তম শতক। এর আগে আসরে শ্রীলঙ্কা ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি।
সেঞ্চুরির আগেই ফিরতে পারতেন তিনি। ৩৪তম ওভারে ক্লাসেনের ডাকে সাড়া দিতে দেরি করে ফেলেছিলেন, কাভার থেকে স্ট্রাইক প্রান্তে করা নাজমুলের থ্রো সরাসরি স্টাম্প ভাঙতে পারলে রানআউট হয়ে ফিরতে হতো ডি কককে ৯৮ রানে দাঁড়িয়েই।
এক বিশ্বকাপে এর আগে ৩ বা এর বেশি সেঞ্চুরি করেছেন ছয় জন। ডি ককের সামনে সামনে সুযোগ আছে এটি বাড়িয়ে নেওয়ার।
বাংলাদেশ ব্যবহার করে সাতজন বোলার। বোলিং কোটা পূরণ করেননি কেউই। ২ উইকেট নিয়ে সফলতম বোলার হাসান। এজন্য ৬ ওভারে তাকে গুনতে হয়েছে ৬৭ রান। ওভারপ্রতি প্রায় সাড়ে আট করে রান দিয়েছেন মুস্তাফিজ ও শরিফুল। সেই তুলনায় মিরাজ ছিলেন মিতব্যয়ি। ৯ ওভারে ৪৪ রানে নেন ১ উইকেট।
দক্ষিণ আফ্রিকা: ৫০ ওভারে ৩৮২/৫(ডি কক ১৭৪, হেন্ডরিকস ১২, ডুসেন ১, মার্করাম ৬০, ক্লাসেন ৯০, মিলার ৩৪*, জানসেন ১*; অতিরিক্ত ১০; মুস্তাফিজ ৯-০-৭৬-০, মিরাজ ৯-০-৪৪-১, শরিফুল ৯-০-৭৬-১, সাকিব ৯-০-৬৯-১, হাসান ৬-০-৬৭-২, নাসুম ৫-০-২৭-০, মাহমুদউল্লাহ ৩-০-২০-০)।
বাংলাদেশ: ৪৬.৪ ওভারে ২৩৩ (তানজিদ ১২, লিটন ২২,নাজমুল ০, সাকিব ১, মুশফিকুর ৮, মাহমুদউল্লাহ ১১১, মিরাজ ১১, নাসুম ১৯, হাসান ১৫, মোস্তাফিজুর ১১, শরীফুল ৬*; অতিরিক্ত ১৭; জানসেন ৮-০-৩৯-২, উইলিয়ামস ৮.৪-১-৫৬-২, কোয়েৎজি ১০-০-৬২-৩, রাবাদা ১০-১-৪২-২, মহারাজ ১০-০-৩২-১)।