DoinikAstha Epaper Version
ঢাকাসোমবার ২৫শে নভেম্বর ২০২৪
ঢাকাসোমবার ২৫শে নভেম্বর ২০২৪

আজকের সর্বশেষ সবখবর

টিকটকের আড়ালে চলছে না না অপরাধ

DoinikAstha
মে ৩১, ২০২১ ১১:২৬ অপরাহ্ণ
Link Copied!

টিকটকের আড়ালে চলছে না না অপরাধ

টিকটক—চার বর্ণের একটি শব্দ। মূলত মজা করার উদ্দেশ্যেই এই অ্যাপটি বানানো হয়েছে। কিন্তু মজার অ্যাপটি এখন সব থেকে বেশি মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মাধ্যমে সমাজে পৌঁছে যাচ্ছে ভুল বার্তা। বাড়ছে ধর্ষণ, নারী পাচার ও কিশোর অপরাধ। আশঙ্কাজনক হারে ছড়িয়ে পড়ছে অশ্লীলতা ও সামাজিক সহিংসতা। টিকটকের ফাঁদে পড়ে ঘটছে ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন বা নারী পাচারের মতো ঘটনা।

টিকটক কী ধরনের অ্যাপ
স্মার্টফোনভিত্তিক অ্যাপ টিকটকের স্লোগান হলো—তোমার দিন বানাও : আসল মানুষ, আসল ভিডিও (মেক ইয়োর ডে : রিয়েল পিপল, রিয়েল ভিডিও)। বইয়ের ভাষায় টিকটিক হলো মাইক্রো ব্লগিং (ভিডিও ব্লগ) অ্যাপ।

যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম বিজনেস ইনসাইডার বলছে, টিকটকের সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৮০ কোটি। ১৫৫টি দেশে ৪০টি ভাষায় চালু আছে এটি। প্রতিদিন ১০০ কোটি ভিডিও দেখা হয়। বিজ্ঞাপন থেকেই মূল আয় টিকটকের। এই বিজ্ঞাপন থেকে টিকটকারও বড় অঙ্কের টাকা আয় করে।

জনপ্রিয় কোনো গানের সঙ্গে ঠোঁট মেলানো (লিপ সিঙ্ক), হিন্দি বা বাংলা ছবির কোনো বিখ্যাত সংলাপ আওড়ানো, নাচ-গান, মজা করা—এমন ভিডিওই সাধারণত বাংলাদেশ থেকে টিকটকে ছাড়তে দেখা যায়। ছোট ছোট অনুপ্রেরণামূলক (মোটিভেশনাল) কথা মজার ভঙ্গিতেও বলে অনেকে।

যাদের ফলোয়ার বেশি, তাদের ভিডিওতে কয়েক হাজার বা লাখের ওপরে ভিউ হয়। ফলে তাদের আয় বেশ ভালো। ফলোয়ার বেশি থাকলে মাসে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা বা এরও বেশি আয় করতে পারেন একজন টিকটকার।

তৈরি হচ্ছে কিশোর গ্যাং, বাড়ছে অপরাধ
টিকটকের কারণে অল্প সময়ে অনলাইন তারকা বনে যাচ্ছে অসংখ্য কিশোর। জনপ্রিয়তা পাওয়া টিকটকারদের বেশির ভাগের বয়স ২০ থেকে ২৫ বছর। তাদের ফলোয়ার সংখ্যা লাখ লাখ। অনেকের এর থেকেও বেশি। পর্যালোচনায় দেখা যায়, বাংলাদেশে জনপ্রিয় টিকটকারদের বেশির ভাগই অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত। কেউ সেলুনে কাজ করে, কেউ দিনমজুরের কাজ করে। কেউবা কোনো দোকানের বিক্রয়কর্মী। এর বাইরে স্কুল, কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা টিকটকে নিজেদের বিলিয়ে দিচ্ছে।

টিকটকের সূত্র ধরে তারকা হওয়ার নেশায় বিভোর কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে। জনপ্রিয়তার নিরিখে তৈরি হয় এলাকাভিত্তিক গ্যাং। এই গ্যাং খোলা জায়গায়, ফুটপাতে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে একত্র হয়ে ভিডিও কন্টেন্ট তৈরির নামে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, ইভ টিজিং, পথচারীদের গতিরোধ, বাইক মহড়াসহ বিভিন্ন অসৌজন্যমূলক আচরণ করে থাকে। এমনকি কবরস্থানের মতো স্পর্শকাতর জায়গায় টিকটক করতে এরা পিছপা হয় না। রাজধানীর রায়েরবাজারে অবস্থিত বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে গেলে এসব চিত্র অহরহ চোখে পড়ে। কখনো কখনো এক এলাকার গ্যাংয়ের সঙ্গে অন্য এলাকার গ্যাংরা বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। অনেক সময় ঠুনকো বিষয়কে কেন্দ্র করে খুনের মতো ঘটনা ঘটে যায়।

 

কিশোর গ্যাং কালচার, চলছে সব ভয়াবহ অপরাধ
চার বছর আগে উত্তরায় ডিসকো বয়েজ ও নাইন স্টার গ্রুপের অন্তর্দ্বন্দ্বে খুন হয় ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবির। আদনান হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়েই আলোচনায় আসে কিশোর গ্যাং। অন্যদিকে রাজধানীসহ জেলা শহরগুলোতেও বেরিয়ে আসে কিশোরদের ‘গ্যাং কালচার’ এবং তাদের সংঘবদ্ধ অপরাধের ভয়ংকর সব চিত্র। এসব গ্যাং সমাজে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করে উদ্বেগ ও আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জানা যায়, এসব গ্যাংয়ের সদস্যরা টিকটকে বেশ সংক্রিয়।

পুলিশের ক্রাইম অ্যানালাইসিস বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকাতেই গত কয়েক বছরে কিশোর গ্যাং গ্রুপের সন্ধান মিলেছে অন্তত ৫০টি, যাদের প্রায় সবাই টিকটক মহলে জনপ্রিয়। এই কিশোর গ্যাং গ্রুপ ক্রমান্বয়ে বাড়ছেই। বিভিন্ন জেলা শহরের কিশোররাও জড়িয়ে পড়ছে পাড়া বা মহল্লাভিত্তিক নানা রকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। নিজেদের প্রয়োজনে তারা তাদের বিভিন্ন কাজে লাগান।

টিকটক যখন ধর্ষণ ও নারী পাচারের ফাঁদ
টিকটকে তারকা বনে যাওয়া কিশোরদের প্রতি তরুণীদের একধরনের আগ্রহ তৈরি হয়। সেই আগ্রহ থেকে তারা কিশোরদের সঙ্গে দলবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন জায়গায় টিকটক করতে চলে যায়। এই সুযোগ নেয় কিশোর গ্যাং। তাদের ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ, নারী পাচারের মতো জঘন্য কাজ করে থাকে। গত কয়েক বছরে এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশি এক তরুণীকে ভারতের কেরালায় নিয়ে যৌন নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর সামনে বেরিয়ে আসছে মানব পাচারের মতো চাঞ্চল্যকর তথ্য। টিকটকের আড়ালে মানব পাচার করছে এমন কয়েকটি চক্রের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। একাধিক টিকটক গ্রুপের সদস্যরা আন্তর্জাতিক নারী পাচার চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে জানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া মাত্র ২০ হাজার টাকায় পাচার করা হয় তরুণীদের। গত পাঁচ বছর ধরে তারা এই কাজ করে আসছে। বাংলাদেশি তরুণীদের বিদেশে ভালো চাকরি ও টিকটকের নায়িকা তৈরির প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করা হয়েছিল। এই চক্রের অন্যতম হোতাসহ কয়েকজন পুলিশের গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছে। যেকোনো সময় তারা গ্রেপ্তার হতে পারে বলে জানা গেছে।

শোবিজ তারকারা যখন টিকটকের শুভেচ্ছাদূত
সাধারণ মানুষের পাশাপাশি শোবিজ তারকারাও মেতে থাকেন টিকটক দুনিয়ায়। তারা মূলত টিকটক বাংলাদেশের শুভেচ্ছদূত হিসেবে কাজ করেন। দেশের জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পীদের কাছে ‘টিকটক বাংলাদেশ’ শাখার পক্ষ থেকে এই মাধ্যমকে আরও বেশি জনপ্রিয় করার জন্য নিয়মিত টিকটক করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। বিনিময়ে তারা আর্থিক সুবিধাও পেয়ে থাকেন। আক্ষরিক অর্থে তারা শুভেচ্ছাদূত হিসেবে কাজ করেন। মৌসুমী, ওমর সানী, পূর্ণিমা থেকে শুরু করে বিদ্যা সিনহা মিম, সাফা কবির, টয়া, তানজিন তিশা, মেহ্জাবীন, ইমরান মাহমুদুল, কোনালসহ অনেকেই এই ভিডিও নির্মাতাদের তালিকায় আছেন।

এ প্রসঙ্গে কথা হয় অভিনেত্রী টয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, “মজা করার জন্য টিকটক করি। কিন্তু কেউ যদি এর মাধ্যমে অপরাধে জড়িয়ে পড়েন, সেটা কাম্য নয়। আমি অবশ্যই এর বিরোধিতা করি। আমি চাই সুন্দর কাজের প্রযুক্তির ব্যবহার হোক।”

তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, টিকটকের কারণে যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ে, তাতে করে শোবিজ তারকারাও এর দায় এড়াতে পারেন না।

টিকটক বন্ধ চান বিশেষজ্ঞরা
বিশ্লেষকরা অনেকেই বলছেন, আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, আকাশ সংস্কৃতি ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা বা তথ্যপ্রযুক্তি কিশোরদের অপরাধপ্রবণতা বাড়ার অন্যতম কারণ। তথ্যপ্রযুক্তির কারণে শিশু-কিশোরদের নৈতিক স্খলন হচ্ছে।

মনোবিজ্ঞানী মেখলা সরকার বলেন, “সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কথিত তারকাখ্যাতি এবং অসময়ে অর্থপ্রাপ্তির লোভে বিপথে যাচ্ছে শিশু-কিশোররা। ব্যাহত হচ্ছে তাদের মানসিক বিকাশ। অনেকে জড়িয়ে পড়ছে গ্যাং কালচারে। ১৭-১৮ বছরের কিশোর-কিশোরীর যদি এসব প্ল্যাটফর্মের কারণে জনপ্রিয়তা তৈরি হয়, তাহলে তার মধ্যে একধরনের সুপেরিয়র হয়ে দেখার প্রবণতা তৈরি হয়। এটা কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করা হবে, তার দায়িত্ব থাকে পরিবারের।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, “টিকটক সমাজের ক্যানসার হয়ে দেখা দিয়েছে। এই মাধ্যমটি শুরু থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা উচিত ছিল। এই ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ায় আমরা চিন্তিত। এটি বিকৃত একটি মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। ফলে চরম সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় ঘটছে কিশোরদের মধ্যে। ক্ষমার অযোগ্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।”
এই অপরাধ বিশ্লেষক আরও বলেন, “এভাবে কিশোর-কিশোরীরা এ ধরনের অপসংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়লে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এই তরুণরা তো আগামী দিনের নেতৃত্ব দেবে। তারা যদি এ ধরনের অসুস্থ সংস্কৃতির ভেতর বড় হয়, তাহলে তারা নেতৃত্ব দেবে কীভাবে? বাংলাদেশের টিকটক কালচার অনেক দূর এগিয়েছে। তবে সার্বিকভাবে প্রাথমিক অবস্থায় রয়েছে। সরকার যদি এখনই এর বিরুদ্ধে স্থায়ী পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে সামনে ভয়াবহ দিন অপেক্ষা করছে।”

টিকটকের ব্যবহার রোধে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে—এমন প্রশ্নের উত্তরে তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন সাব্বির বলেন, “প্রযুক্তিকে আমাদের অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে এই প্রযুক্তি মাঝে মাঝে আমাদের জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দেয়। টিকটক ঠিক তেমন। এটি বন্ধ করে দেওয়ার সময় এসেছে। এই জায়গাটিতে আইসিটি মন্ত্রণালয় ও বিটিসিএল ভূমিকা রাখতে পারে। যত দিন না বন্ধ হচ্ছে তত দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও বেশি সজাগ থাকতে হবে। কোথাও টিকটক ভিডিও করতে দেখলে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।”

সন্তানদের টিকটক থেকে দূরে রাখতে অভিভাবকদের বেশি দায়িত্ব পালন করতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। পরিবারে কিশোর-কিশোরীদের একাকী বা বিচ্ছিন্ন না রেখে যথেষ্ট সময় দিতে হবে। সন্তান কী করে, কার সঙ্গে মেশে, কোথায় সময় কাটায় এসব বিষয়ে পর্যাপ্ত মনিটর করতে পারলেই টিকটকের মতো বিকৃত সংস্কৃতিতে সন্তানের জড়িয়ে পড়া রোধ করা সম্ভব হবে।

বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।
সেহরির শেষ সময় - ভোর ৪:৫৭
ইফতার শুরু - সন্ধ্যা ৫:১৫
  • ফজর
  • যোহর
  • আছর
  • মাগরিব
  • এশা
  • সূর্যোদয়
  • ৫:০২
  • ১১:৪৭
  • ৩:৩৬
  • ৫:১৫
  • ৬:৩১
  • ৬:১৬