ঢাকা ০২:৪০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৫, ২৯ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম:
Logo ইরানকে সহায়তা করায় ভারতীয়সহ ৩২ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা Logo খাগড়াছড়িতে ১৮ বছর পর ধানের শীষের পথ সভায় ওয়াদুদ ভূইয়া Logo নতুন করে পদায়ন করা হলো আরও ৯ ডিসি Logo বাংলাদেশের ১১ জেলাকে সংযুক্ত করে বানাতে চায় ‘গ্রেটার ত্রিপুরা ল্যান্ড’ Logo সীমান্তে সেনা বাড়াচ্ছে ভারত-মিয়ানমার, বাংলাদেশ করছে প্রত্যাহার! Logo আ.লীগের আগ্রাসনের প্রতিবাদে পানছড়িতে যুবদলের বিক্ষোভ মিছিল Logo তাড়াইলে ধলা ইউপি চেয়ারম্যান ঝিনুক গ্রেফতার Logo কিশোরগঞ্জে চবি চাকসুর জিএস সাঈদ বিন হাবিবকে বর্ণাঢ্য সংবর্ধনা Logo কিশোরগঞ্জে জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খানের বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত Logo খাগড়াছড়িতে আ.লীগের মিছিল: সাবেক প্রতিমন্ত্রীসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা

বাংলাদেশের ১১ জেলাকে সংযুক্ত করে বানাতে চায় ‘গ্রেটার ত্রিপুরা ল্যান্ড’

Astha DESK
  • আপডেট সময় : ০৮:৪০:৩১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫
  • / ১০১৬ বার পড়া হয়েছে

এ এইচ এম ফারুকঃ

গত তিন মাস পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা রাজপরিবারের সদস্য প্রদ্যোত বিক্রম মানিক্য দেব বর্মা ভারতের এএনআই নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামকে “গ্রেটার ত্রিপুরা ল্যান্ড”-এর অংশ দাবি করে একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, “চট্টগ্রাম এক সময় বাংলাদেশের ছিল না। চাকমা জনজাতি কখনোই বাংলাদেশের অংশ হতে চায়নি।” এমনকি তিনি ভারত সরকারের কাছে এই ভূখণ্ড দখলের জন্য ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপের আহ্বান জানান। তার এ সাক্ষাৎকার প্রচারিত হবার পর সংশ্লিষ্ট মহলে হৈচৈ পড়ে গিয়েছে।

বোদ্ধা মহল মনে করছেন, তাঁর এই বক্তব্য শুধু ইতিহাসের বিকৃতি নয়, এটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে সরাসরি উস্কানি। একজন রাজপরিবারের প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর এই মন্তব্য রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক এবং আন্তর্জাতিকভাবে বিভ্রান্তিকর।

যা পার্বত্য চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিনের ষড়যন্ত্রকে আরেক দফা উস্কে দেয়ার সামিল। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি, বহুমুখী এবং আন্তর্জাতিকভাবে সমন্বিত প্রচেষ্টা, যার উদ্দেশ্য- বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং আন্তর্জাতিক সহানুভূতি আদায় করে রাষ্ট্রভঙ্গের পথ সুগম করা।

পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশ নিয়ে ষড়যন্ত্রেও এই বহুমুখী প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের উচিত দ্রুত প্রতিবাদ জানানো এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

ইতিহাস যা বলেঃ-
বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, ফেনী ও তৎসংলগ্ন কিছু অঞ্চল একসময় ত্রিপুরা রাজ্যের প্রভাবাধীন ছিল। কিন্তু বৃহত্তর চট্টগ্রাম বা পরবর্তীতে চট্টগ্রামের পাবর্ত এলাকা নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম কখনোই ত্রিপুরা রাজ্যের অংশ ছিল না। ব্রিটিশ আমলে এটি চট্টগ্রাম জেলার পার্বত্য এলাকা Excluded Area হিসেবে স্বীকৃত ছিল এবং সরাসরি ব্রিটিশ প্রশাসনের অধীনে পরিচালিত হতো। পার্বত্য চট্টগ্রামের তৎকালীন স্থানীয় চাকমা, মারমা ও বোমাং জনগোষ্ঠীর কাছে রাজা হিসেবে পরিচিত সার্কেলচিফরাও ব্রিটিশদের সঙ্গে আলাদা চুক্তির মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসিত ভূমি শাসন করতেন, যা ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে কোনো ঐতিহাসিক সংযুক্তি দেখায় না। তারও আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল জনমানবশূন্য।

চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, বম, খিয়াং, লুসাই, পাংখোয়া প্রভৃতি জনগোষ্ঠী ১৭৩০ সালের পর থেকে বার্মা, তিব্বত, মিজোরাম, ত্রিপুরা, মঙ্গোলিয়া ও চীন থেকে বিভিন্ন সময় বিতাড়িত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেছে। ফলে তারা আদিবাসীও নয়, বরং অভিবাসিত জনগোষ্ঠী।

জনবসতির ইতিহাস ও আদিবাসী বিতর্ক
বৃহত্তর চট্টগ্রামে জনবসতির ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাঙালি জনগোষ্ঠীর বসতি ছিল ঐতিহাসিককাল থেকে। হাজার বছরেরও আগে। ব্রিটিশ কর্মকর্তা ফ্রান্সিস বুকাননের ভ্রমণ বিবরণেও তার উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় বাঙালি বসতির অস্তিত্ব নথিভুক্ত করেন। অন্যদিকে, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা প্রভৃতি জনগোষ্ঠী ১৭-১৮শ শতাব্দীতে বার্মা, তিব্বত, মিজোরাম, ত্রিপুরা ও চীন থেকে বিতাড়িত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করে। ফলে তারা অভিবাসিত জনগোষ্ঠী, আদিবাসী নয়।

ধারাবাহিক ষড়যন্ত্র; এক সূত্রে গাঁথা অপতৎপরতাঃ-
পার্বত্য চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রচেষ্টা একদিনে গড়ে ওঠেনি। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি, বহুমুখী এবং আন্তর্জাতিকভাবে সমন্বিত প্রচেষ্টা, যার উদ্দেশ্য- বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং আন্তর্জাতিক সহানুভূতি আদায় করে রাষ্ট্রভঙ্গের পথ সুগম করা। কিছু বিষয় পর্যালোচনা করলেও তাই দেখা যায়। যেমন-

১. জুম্মল্যান্ড দাবি : স্বাধীনতার অনেক পরে এসে পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু উপজাতি “জুম্মল্যান্ড” নামে একটি আলাদা রাষ্ট্রের দাবি তোলে। এই দাবির পেছনে ছিল তথাকথিত জাতিগত স্বাতন্ত্র্য, সাংস্কৃতিক অধিকার এবং ভূমির মালিকানা। যদিও এই দাবির কোনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই, তবুও এটি পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতা সৃষ্টি করে।

২. কুকিচীন রাষ্ট্র গঠনের অপতৎপরতা : সম্প্রতি কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির কিয়দাংশ নিয়ে “কুকিচীন” নামে একটি রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টা চালায়। কেএনএফ-এর কার্যক্রমে দেখা যায়, তারা অস্ত্র সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগের মাধ্যমে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের ভিত্তি গড়তে চায়।

৩. ভারতীয় চাকমা নেতাদের চিঠি : ভারতে অবস্থানরত কিছু চাকমা নেতৃবৃন্দ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে লিখিত চিঠি দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতের অংশ হিসেবে দাবি করেন। তারা অভিযোগ করেন, বাংলাদেশে চাকমা জনগোষ্ঠী নিপীড়নের শিকার। এই চিঠি আন্তর্জাতিক মহলে বিভ্রান্তি ছড়ানোর একটি কৌশল, যা ইতিহাসের বিকৃতি এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

৪. ত্রিপুরা রাজপরিবারের ‘গ্রেটার ত্রিপুরা ল্যান্ড’ দাবি : প্রদ্যোত মানিক্য দেব বর্মার বক্তব্য এই ধারাবাহিক প্রচেষ্টার সর্বশেষ সংযোজন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামকে “পুরানো ভূমি” বলে দাবি করে বলেন, “চাকমা জনজাতি কখনোই বাংলাদেশের অংশ হতে চায়নি।” তিনি ভারত সরকারের কাছে এই ভূখণ্ড দখলের জন্য ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপের আহ্বান জানান।

৫. ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের আন্তর্জাতিক অপতৎপরতা : বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী রাজার কোনো সাংবিধানিক ভূমিকা না থাকলেও, ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় নিজেকে “চাকমা রাজা” পরিচয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে উপস্থাপন করে ‘আদিবাসী রাষ্ট্র’ গঠনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি সিএইচটি কমিশনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতির বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন, যা রাষ্ট্রের অখণ্ডতার প্রশ্নে উদ্বেগজনক।

৬. সিএইচটি কমিশনের ভূমিকা : সিএইচটি কমিশন নামে একটি আন্তর্জাতিক ফোরাম দীর্ঘদিন ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামকে “আদিবাসী ভূমি” হিসেবে চিহ্নিত করে আন্তর্জাতিক মহলে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। এই কমিশনের সদস্যদের মধ্যে কিছু বিদেশি মানবাধিকার কর্মী ও স্থানীয় বামপন্থী নেতৃবৃন্দ রয়েছেন, যারা বাংলাদেশের সংবিধান ও ভূখণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কাজ করছেন।

গণমাধ্যম কমিশনের প্রতিবেদন; সেই ধারারই অংশ
সম্প্রতি গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে ‘আদিবাসী’ শব্দের ব্যবহার এই ধারাবাহিক প্রচেষ্টারই অংশ। এটি শুধু একটি শব্দচয়ন নয়, বরং একটি রাজনৈতিক বার্তা, যা রাষ্ট্রীয় নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এই কমিশনের সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ অতীতে ঈঐঞ কমিশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যা এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্যকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও নিরাপত্তা উদ্বেগ : পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে শুধু অভ্যন্তরীণ নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও উদ্বেগ বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা তাদের নাগরিকদের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ্রমণ বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করেছে, যা এই অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে গভীর উদ্বেগের প্রতিফলন। কানাডা সরকার সম্প্রতি (১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫) তাদের নাগরিকদের পার্বত্য অঞ্চল এড়িয়ে চলার নির্দেশ দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রেরও সতর্কতা রয়েছে তাদের নাগরিকদের প্রতি।

১৮ এপ্রিল ২০২৫ Do Not Travel নির্দেশনা জারি করে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান ভ্রমণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে তারা। এই দুই দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিশ্বজুড়ে উন্নত নজরদারি ও তথ্য বিশ্লেষণ পরিচালনা করে থাকে। তাদের সতর্কতা শুধু পর্যটন নয়, বরং নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণের ফলাফল। তাই ধরে নেওয়া যায়, তাদের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে।

এই সতর্কতা বাংলাদেশের জন্য একটি সতর্কবার্তা- যেখানে আন্তর্জাতিক মহলও পার্বত্য চট্টগ্রামকে উদ্বেগজনক অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করছে। ফলে সরকারের উচিত এই অঞ্চলের নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় নীতির অবস্থান
ধানবানতে গিয়ে শিবের গীত গাওয়ারমত হলেও এখানে বলতে হয়- বাংলাদেশের সংবিধানের ২৩(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: “রাষ্ট্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, উপজাতি, অনগ্রসর ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।” এখানে ‘আদিবাসী’ শব্দের কোনো উল্লেখ নেই।

২০১১ সালে সংবিধান সংশোধনের সময় ‘আদিবাসী’ শব্দ অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব উঠলেও তা প্রত্যাখ্যাত হয়। ২০১৮ সালে তথ্য অধিদপ্তর সাংবাদিকদের উদ্দেশে নির্দেশনা দেয়: “সংবিধান পরিপন্থি ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার বন্ধ করুন।” পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতেও ‘উপজাতি’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, ‘আদিবাসী’ নয়। এই ধারাবাহিকতা স্পষ্ট করে যে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতিতে ‘আদিবাসী’ শব্দের কোনো স্থান নেই।

সরকারের করণীয়; সুপারিশসমূহ
এই বহুমুখী প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের উচিত দ্রুত, সুসংগঠিত এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বিশেষ করে-

১. কূটনৈতিক প্রতিবাদ : ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ জানানো এবং ত্রিপুরা রাজপরিবারের বক্তব্যকে রাষ্ট্রীয় অবস্থান হিসেবে না নেওয়ার নিশ্চয়তা চাওয়া।

২. আন্তর্জাতিক ব্যাখ্যা ও লবিং : জাতিসংঘ, সার্ক, ওআইসি এবং অন্যান্য আঞ্চলিক সংস্থার কাছে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরা এবং সিএইচটি কমিশনসহ অপতৎপরতাকারীদের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে তথ্যভিত্তিক প্রতিবাদ জানানো।

৩. গণমাধ্যমে তথ্যভিত্তিক প্রতিক্রিয়া : বিভ্রান্তিকর প্রচারণা প্রতিহত করতে ইতিহাস, সংবিধান ও জনমতের ভিত্তিতে প্রতিবাদ প্রকাশ এবং সাংবাদিকদের জন্য নীতিমালা পুনর্বিন্যাস।

৪. পার্বত্য চট্টগ্রামে জনমত সংহতকরণ: স্থানীয় জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়িয়ে বিভাজনের রাজনীতি প্রতিহত করা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া।

৫. শিক্ষা ও পাঠ্যবই পর্যালোচনা: পাঠ্যবই, শিক্ষাসামগ্রী ও সরকারি প্রশিক্ষণ মডিউলে ‘আদিবাসী’ শব্দের অপব্যবহার রোধে সংশোধনী আনা জরুরি। সংবিধানসম্মত শব্দচয়ন যেমন ‘উপজাতি’, ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ ইত্যাদি ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

৬. সিএইচটি কমিশনের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবাদ: সিএইচটি কমিশনের আন্তর্জাতিক প্রচারণা ও রিপোর্টগুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবাদ জানিয়ে জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থায় বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরতে হবে।

৭. ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় ও সন্তুু লারমার রাষ্ট্রবিরোধী অবস্থানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা: যদি কোনো ব্যক্তি নিজেকে “রাজা” পরিচয়ে রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণা চালান, তবে তা রাষ্ট্রদ্রোহের আওতায় পড়ে। সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশে রাজতন্ত্রের কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই। তাই তাঁর আন্তর্জাতিক অপতৎপরতা রাষ্ট্রীয়ভাবে পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ আসনে বসে সন্তু লারমার রাষ্ট্র বিরোধী কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

৮. পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ও উন্নয়ন জোরদার : বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রচারণা প্রতিহত করতে পার্বত্য অঞ্চলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে হবে। উন্নয়নই শান্তির ভিত্তি- এই নীতিতে সরকারকে অগ্রসর হতে হবে।

৯. গণমাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতির প্রচার: সাংবাদিকদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ চালু করা যেতে পারে, যেখানে সংবিধান, রাষ্ট্রীয় নীতি ও শব্দচয়ন বিষয়ে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকবে। গণমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর শব্দ ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রেস কাউন্সিলকে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে।

বিভাজনের রাজনীতি নয়; সহাবস্থানের সংস্কৃতি
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি কখনোই ত্রিপুরা রাজ্যের ছিল না, এবং এখানকার জনগণ বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে নিজেদের পরিচয়েই গর্বিত। বরং জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠার দাবি, কুকিচীন রাষ্ট্র গঠন চেষ্টা, চাকমা নেতাদের চিঠি, ত্রিপুরা রাজপরিবারের দাবি, সিএইচটি কমিশনের প্রচারণা এবং সন্তু লারমা ও দেবাশীষ রায়ের অবস্থান-সবই একটি সুপরিকল্পিত রাষ্ট্রবিরোধী প্রচেষ্টার অংশ। যা একই সুতোয় গাথা।
এই প্রচেষ্টাগুলো কখনো মানবাধিকার, কখনো সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য, আবার কখনো ঐতিহাসিক দাবির মোড়কে পরিচালিত হলেও, মূল উদ্দেশ্য একরাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ভাঙা।

বাংলাদেশ সরকার, গণমাধ্যম, এবং সচেতন নাগরিকদের উচিত এই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়ানো। রাষ্ট্রের অখণ্ডতা রক্ষায় ঐতিহাসিক সত্য, সংবিধানের ভাষা এবং জনগণের ঐক্য- এই তিন স্তম্ভকে শক্তিশালী করতে হবে।

সাংবাদিক, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

ট্যাগস :

বাংলাদেশের ১১ জেলাকে সংযুক্ত করে বানাতে চায় ‘গ্রেটার ত্রিপুরা ল্যান্ড’

আপডেট সময় : ০৮:৪০:৩১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫

এ এইচ এম ফারুকঃ

গত তিন মাস পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা রাজপরিবারের সদস্য প্রদ্যোত বিক্রম মানিক্য দেব বর্মা ভারতের এএনআই নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামকে “গ্রেটার ত্রিপুরা ল্যান্ড”-এর অংশ দাবি করে একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, “চট্টগ্রাম এক সময় বাংলাদেশের ছিল না। চাকমা জনজাতি কখনোই বাংলাদেশের অংশ হতে চায়নি।” এমনকি তিনি ভারত সরকারের কাছে এই ভূখণ্ড দখলের জন্য ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপের আহ্বান জানান। তার এ সাক্ষাৎকার প্রচারিত হবার পর সংশ্লিষ্ট মহলে হৈচৈ পড়ে গিয়েছে।

বোদ্ধা মহল মনে করছেন, তাঁর এই বক্তব্য শুধু ইতিহাসের বিকৃতি নয়, এটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে সরাসরি উস্কানি। একজন রাজপরিবারের প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর এই মন্তব্য রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক এবং আন্তর্জাতিকভাবে বিভ্রান্তিকর।

যা পার্বত্য চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিনের ষড়যন্ত্রকে আরেক দফা উস্কে দেয়ার সামিল। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি, বহুমুখী এবং আন্তর্জাতিকভাবে সমন্বিত প্রচেষ্টা, যার উদ্দেশ্য- বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং আন্তর্জাতিক সহানুভূতি আদায় করে রাষ্ট্রভঙ্গের পথ সুগম করা।

পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশ নিয়ে ষড়যন্ত্রেও এই বহুমুখী প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের উচিত দ্রুত প্রতিবাদ জানানো এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

ইতিহাস যা বলেঃ-
বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, ফেনী ও তৎসংলগ্ন কিছু অঞ্চল একসময় ত্রিপুরা রাজ্যের প্রভাবাধীন ছিল। কিন্তু বৃহত্তর চট্টগ্রাম বা পরবর্তীতে চট্টগ্রামের পাবর্ত এলাকা নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম কখনোই ত্রিপুরা রাজ্যের অংশ ছিল না। ব্রিটিশ আমলে এটি চট্টগ্রাম জেলার পার্বত্য এলাকা Excluded Area হিসেবে স্বীকৃত ছিল এবং সরাসরি ব্রিটিশ প্রশাসনের অধীনে পরিচালিত হতো। পার্বত্য চট্টগ্রামের তৎকালীন স্থানীয় চাকমা, মারমা ও বোমাং জনগোষ্ঠীর কাছে রাজা হিসেবে পরিচিত সার্কেলচিফরাও ব্রিটিশদের সঙ্গে আলাদা চুক্তির মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসিত ভূমি শাসন করতেন, যা ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে কোনো ঐতিহাসিক সংযুক্তি দেখায় না। তারও আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল জনমানবশূন্য।

চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, বম, খিয়াং, লুসাই, পাংখোয়া প্রভৃতি জনগোষ্ঠী ১৭৩০ সালের পর থেকে বার্মা, তিব্বত, মিজোরাম, ত্রিপুরা, মঙ্গোলিয়া ও চীন থেকে বিভিন্ন সময় বিতাড়িত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেছে। ফলে তারা আদিবাসীও নয়, বরং অভিবাসিত জনগোষ্ঠী।

জনবসতির ইতিহাস ও আদিবাসী বিতর্ক
বৃহত্তর চট্টগ্রামে জনবসতির ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাঙালি জনগোষ্ঠীর বসতি ছিল ঐতিহাসিককাল থেকে। হাজার বছরেরও আগে। ব্রিটিশ কর্মকর্তা ফ্রান্সিস বুকাননের ভ্রমণ বিবরণেও তার উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় বাঙালি বসতির অস্তিত্ব নথিভুক্ত করেন। অন্যদিকে, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা প্রভৃতি জনগোষ্ঠী ১৭-১৮শ শতাব্দীতে বার্মা, তিব্বত, মিজোরাম, ত্রিপুরা ও চীন থেকে বিতাড়িত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করে। ফলে তারা অভিবাসিত জনগোষ্ঠী, আদিবাসী নয়।

ধারাবাহিক ষড়যন্ত্র; এক সূত্রে গাঁথা অপতৎপরতাঃ-
পার্বত্য চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রচেষ্টা একদিনে গড়ে ওঠেনি। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি, বহুমুখী এবং আন্তর্জাতিকভাবে সমন্বিত প্রচেষ্টা, যার উদ্দেশ্য- বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং আন্তর্জাতিক সহানুভূতি আদায় করে রাষ্ট্রভঙ্গের পথ সুগম করা। কিছু বিষয় পর্যালোচনা করলেও তাই দেখা যায়। যেমন-

১. জুম্মল্যান্ড দাবি : স্বাধীনতার অনেক পরে এসে পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু উপজাতি “জুম্মল্যান্ড” নামে একটি আলাদা রাষ্ট্রের দাবি তোলে। এই দাবির পেছনে ছিল তথাকথিত জাতিগত স্বাতন্ত্র্য, সাংস্কৃতিক অধিকার এবং ভূমির মালিকানা। যদিও এই দাবির কোনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই, তবুও এটি পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতা সৃষ্টি করে।

২. কুকিচীন রাষ্ট্র গঠনের অপতৎপরতা : সম্প্রতি কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির কিয়দাংশ নিয়ে “কুকিচীন” নামে একটি রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টা চালায়। কেএনএফ-এর কার্যক্রমে দেখা যায়, তারা অস্ত্র সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগের মাধ্যমে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের ভিত্তি গড়তে চায়।

৩. ভারতীয় চাকমা নেতাদের চিঠি : ভারতে অবস্থানরত কিছু চাকমা নেতৃবৃন্দ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে লিখিত চিঠি দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতের অংশ হিসেবে দাবি করেন। তারা অভিযোগ করেন, বাংলাদেশে চাকমা জনগোষ্ঠী নিপীড়নের শিকার। এই চিঠি আন্তর্জাতিক মহলে বিভ্রান্তি ছড়ানোর একটি কৌশল, যা ইতিহাসের বিকৃতি এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

৪. ত্রিপুরা রাজপরিবারের ‘গ্রেটার ত্রিপুরা ল্যান্ড’ দাবি : প্রদ্যোত মানিক্য দেব বর্মার বক্তব্য এই ধারাবাহিক প্রচেষ্টার সর্বশেষ সংযোজন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামকে “পুরানো ভূমি” বলে দাবি করে বলেন, “চাকমা জনজাতি কখনোই বাংলাদেশের অংশ হতে চায়নি।” তিনি ভারত সরকারের কাছে এই ভূখণ্ড দখলের জন্য ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপের আহ্বান জানান।

৫. ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের আন্তর্জাতিক অপতৎপরতা : বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী রাজার কোনো সাংবিধানিক ভূমিকা না থাকলেও, ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় নিজেকে “চাকমা রাজা” পরিচয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে উপস্থাপন করে ‘আদিবাসী রাষ্ট্র’ গঠনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি সিএইচটি কমিশনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতির বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন, যা রাষ্ট্রের অখণ্ডতার প্রশ্নে উদ্বেগজনক।

৬. সিএইচটি কমিশনের ভূমিকা : সিএইচটি কমিশন নামে একটি আন্তর্জাতিক ফোরাম দীর্ঘদিন ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামকে “আদিবাসী ভূমি” হিসেবে চিহ্নিত করে আন্তর্জাতিক মহলে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। এই কমিশনের সদস্যদের মধ্যে কিছু বিদেশি মানবাধিকার কর্মী ও স্থানীয় বামপন্থী নেতৃবৃন্দ রয়েছেন, যারা বাংলাদেশের সংবিধান ও ভূখণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কাজ করছেন।

গণমাধ্যম কমিশনের প্রতিবেদন; সেই ধারারই অংশ
সম্প্রতি গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে ‘আদিবাসী’ শব্দের ব্যবহার এই ধারাবাহিক প্রচেষ্টারই অংশ। এটি শুধু একটি শব্দচয়ন নয়, বরং একটি রাজনৈতিক বার্তা, যা রাষ্ট্রীয় নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এই কমিশনের সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ অতীতে ঈঐঞ কমিশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যা এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্যকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও নিরাপত্তা উদ্বেগ : পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে শুধু অভ্যন্তরীণ নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও উদ্বেগ বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা তাদের নাগরিকদের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ্রমণ বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করেছে, যা এই অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে গভীর উদ্বেগের প্রতিফলন। কানাডা সরকার সম্প্রতি (১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫) তাদের নাগরিকদের পার্বত্য অঞ্চল এড়িয়ে চলার নির্দেশ দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রেরও সতর্কতা রয়েছে তাদের নাগরিকদের প্রতি।

১৮ এপ্রিল ২০২৫ Do Not Travel নির্দেশনা জারি করে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান ভ্রমণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে তারা। এই দুই দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিশ্বজুড়ে উন্নত নজরদারি ও তথ্য বিশ্লেষণ পরিচালনা করে থাকে। তাদের সতর্কতা শুধু পর্যটন নয়, বরং নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণের ফলাফল। তাই ধরে নেওয়া যায়, তাদের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে।

এই সতর্কতা বাংলাদেশের জন্য একটি সতর্কবার্তা- যেখানে আন্তর্জাতিক মহলও পার্বত্য চট্টগ্রামকে উদ্বেগজনক অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করছে। ফলে সরকারের উচিত এই অঞ্চলের নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় নীতির অবস্থান
ধানবানতে গিয়ে শিবের গীত গাওয়ারমত হলেও এখানে বলতে হয়- বাংলাদেশের সংবিধানের ২৩(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: “রাষ্ট্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, উপজাতি, অনগ্রসর ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।” এখানে ‘আদিবাসী’ শব্দের কোনো উল্লেখ নেই।

২০১১ সালে সংবিধান সংশোধনের সময় ‘আদিবাসী’ শব্দ অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব উঠলেও তা প্রত্যাখ্যাত হয়। ২০১৮ সালে তথ্য অধিদপ্তর সাংবাদিকদের উদ্দেশে নির্দেশনা দেয়: “সংবিধান পরিপন্থি ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার বন্ধ করুন।” পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতেও ‘উপজাতি’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, ‘আদিবাসী’ নয়। এই ধারাবাহিকতা স্পষ্ট করে যে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতিতে ‘আদিবাসী’ শব্দের কোনো স্থান নেই।

সরকারের করণীয়; সুপারিশসমূহ
এই বহুমুখী প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের উচিত দ্রুত, সুসংগঠিত এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বিশেষ করে-

১. কূটনৈতিক প্রতিবাদ : ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ জানানো এবং ত্রিপুরা রাজপরিবারের বক্তব্যকে রাষ্ট্রীয় অবস্থান হিসেবে না নেওয়ার নিশ্চয়তা চাওয়া।

২. আন্তর্জাতিক ব্যাখ্যা ও লবিং : জাতিসংঘ, সার্ক, ওআইসি এবং অন্যান্য আঞ্চলিক সংস্থার কাছে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরা এবং সিএইচটি কমিশনসহ অপতৎপরতাকারীদের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে তথ্যভিত্তিক প্রতিবাদ জানানো।

৩. গণমাধ্যমে তথ্যভিত্তিক প্রতিক্রিয়া : বিভ্রান্তিকর প্রচারণা প্রতিহত করতে ইতিহাস, সংবিধান ও জনমতের ভিত্তিতে প্রতিবাদ প্রকাশ এবং সাংবাদিকদের জন্য নীতিমালা পুনর্বিন্যাস।

৪. পার্বত্য চট্টগ্রামে জনমত সংহতকরণ: স্থানীয় জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়িয়ে বিভাজনের রাজনীতি প্রতিহত করা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া।

৫. শিক্ষা ও পাঠ্যবই পর্যালোচনা: পাঠ্যবই, শিক্ষাসামগ্রী ও সরকারি প্রশিক্ষণ মডিউলে ‘আদিবাসী’ শব্দের অপব্যবহার রোধে সংশোধনী আনা জরুরি। সংবিধানসম্মত শব্দচয়ন যেমন ‘উপজাতি’, ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ ইত্যাদি ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

৬. সিএইচটি কমিশনের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবাদ: সিএইচটি কমিশনের আন্তর্জাতিক প্রচারণা ও রিপোর্টগুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবাদ জানিয়ে জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থায় বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরতে হবে।

৭. ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় ও সন্তুু লারমার রাষ্ট্রবিরোধী অবস্থানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা: যদি কোনো ব্যক্তি নিজেকে “রাজা” পরিচয়ে রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণা চালান, তবে তা রাষ্ট্রদ্রোহের আওতায় পড়ে। সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশে রাজতন্ত্রের কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই। তাই তাঁর আন্তর্জাতিক অপতৎপরতা রাষ্ট্রীয়ভাবে পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ আসনে বসে সন্তু লারমার রাষ্ট্র বিরোধী কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

৮. পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ও উন্নয়ন জোরদার : বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রচারণা প্রতিহত করতে পার্বত্য অঞ্চলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে হবে। উন্নয়নই শান্তির ভিত্তি- এই নীতিতে সরকারকে অগ্রসর হতে হবে।

৯. গণমাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতির প্রচার: সাংবাদিকদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ চালু করা যেতে পারে, যেখানে সংবিধান, রাষ্ট্রীয় নীতি ও শব্দচয়ন বিষয়ে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকবে। গণমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর শব্দ ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রেস কাউন্সিলকে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে।

বিভাজনের রাজনীতি নয়; সহাবস্থানের সংস্কৃতি
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি কখনোই ত্রিপুরা রাজ্যের ছিল না, এবং এখানকার জনগণ বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে নিজেদের পরিচয়েই গর্বিত। বরং জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠার দাবি, কুকিচীন রাষ্ট্র গঠন চেষ্টা, চাকমা নেতাদের চিঠি, ত্রিপুরা রাজপরিবারের দাবি, সিএইচটি কমিশনের প্রচারণা এবং সন্তু লারমা ও দেবাশীষ রায়ের অবস্থান-সবই একটি সুপরিকল্পিত রাষ্ট্রবিরোধী প্রচেষ্টার অংশ। যা একই সুতোয় গাথা।
এই প্রচেষ্টাগুলো কখনো মানবাধিকার, কখনো সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য, আবার কখনো ঐতিহাসিক দাবির মোড়কে পরিচালিত হলেও, মূল উদ্দেশ্য একরাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ভাঙা।

বাংলাদেশ সরকার, গণমাধ্যম, এবং সচেতন নাগরিকদের উচিত এই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়ানো। রাষ্ট্রের অখণ্ডতা রক্ষায় ঐতিহাসিক সত্য, সংবিধানের ভাষা এবং জনগণের ঐক্য- এই তিন স্তম্ভকে শক্তিশালী করতে হবে।

সাংবাদিক, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।