ফরিদপুরে পদ্মার গর্ভে বিলীন দুই শতাধিক বাড়ি ঘর
মামুনুর রশীদ/ফরিদপুর প্রতিনিধিঃ
ভাঙন আতঙ্ক নিয়েই রাতে ঘরে ঘুমিয়ে ছিলাম। প্রতিবেশীদের চিৎকার শুনে ঘর ছেড়ে বাইরে আসতেই দেখি নদীর গর্ভে প্রতিবেশীর ঘর চলে গেছে। আমার চিৎকারে ঘরের ভীতরে ঘুমিয়ে থাকা অন্য সবাই বেড়িয়ে আসে। তাড়াহুড়া করে স্ত্রী ও ছেলে মেয়েকে নিয়ে গরু-ছাগল ও ঘরের কিছু মালামাল কোন রকম বের করি। কিন্ত ততক্ষণে চোখের সামনে ভাঙন আমার মাথাগুজার ছাঁদখানা তার গর্ভে কেড়ে নেয়। এখন পরিবারের সকলেরে নিয়ে খোলা মাঠের নীচে ।
ভাঙ্গন কবলিত ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার দিয়ারা নারিকেলবাড়িয়া ইউনিয়নের নন্দলাপুর গ্রামের বাসিন্দা শেখ বেলাল এভাবেই নিজের অসহায়ত্বের কথাগুলো বলছিলেন দৈনিক আজকের দর্পণকে।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, গত ২৮ আগস্ট রাত ৯টার দিকে হঠাৎ করে প্রমত্ত পদ্মা নদীর ভাঙন দেখা দেয়। মুহুর্তের মধ্যে ভাঙ্গনের খেলায় উপজেলার দিয়ারা নারিকেলবাড়িয়া ইউনিয়নের শত শত পরিবারের মাথাগুজার ঠাই ঘর বাড়িসহ নদীর গর্ভে চলে যায় ঘরবাড়ি ও মালামাল। অনেক গ্রামবাসীর ভাষ্যমতে, গত এক সপ্তাহে ভাঙ্গন শুরু হয় প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে পদ্মা নদীর ভাঙন শুরু হয়। এ পর্যন্ত প্রায় দুই শতাধীক ঘরবাড়ি বিলীন হয়েছে পদ্মার পেটে।
বিশেষ করে চলতি বর্ষা মৌসুমে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢল ও প্রবল বর্ষণের ফলে তীব্র স্রোতের কারণে নদীতে ভাঙন শুরু হয়। অত্র ইউনিয়টির প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ভাঙন দেওয়ায় চরম ঝুঁকিতে রয়েছে পদ্মা পাড়ের শত শত ঘর, ফসলি জমি ও গ্রামবাসীদের স্থাপনা।
ইতমধ্যে ভাঙ্গনের কবলে সব হারিয়েছেন যারা সেসকল ভাঙনকবলিতরা আশ্রয় নিয়েছে স্থানীয় স্কুল ঘর ও খোলা মাঠে। কিন্ত সেখানকার আশ্রয়ে থাকা জনজীবনে খাদ্য, চিকিৎসা, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন ধরনের সংকট দেখা দিয়েছে। অভিযোগ ক্ষিতগ্রস্থ পরিবারগুলোকে সাহায্যের জন্য সরকারি-বেসরকারি সংস্থা থেকে কেউ এগিয়ে আসছে না কোন বলে জানায় স্থানীয়রা।
সরেজমিনে সংবাদ সংগ্রহ কালে দেখা যায়, পদ্মার তীব্র স্রোতে ইউনিয়নটির নন্দলাপুর, নুরুদ্দিন সরদারের কান্দি, জহুরুল হক বেপারীর কান্দি ও কুদ্দুস মোল্যার কান্দি গ্রামের প্রায় শতাধিক মানুষ নদী ভাঙনের কবলে নিরাপত্তাহীন হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। নদী ভাঙনের শঙ্কায় পদ্মার পাড় থেকে সরে যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। নদী ভাঙনের ফলে ইউনিয়নটিতে বিছিন্ন রয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ। এ কারণে অনেকটাই নিরাপত্তাহীন এলাকায় পরিণত হয়ে পড়েছে পদ্মা নদীর ভাঙ্গনকবলিত এলাকায়। এছাড়া ভাঙন রোধে সরকারের পক্ষ থেকে জরুরীভাবে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহনের প্রতি জোর দাবী জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
নুরুদ্দিন সরদার কান্দি গ্রামের আলী হোসেন বলেন, নদী ভাঙ্গনে আমাদের সব নিয়ে গেছে। আমাদের কোন কর্মও নেই। পরিবার নিয়ে অর্ধ-অনাহারে দিন কাটাচ্ছি। সরকারি ভাবে সাহায্য সহযোগীতা না পেলে পরিবার নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মমতাময়ী মায়ের কাছে কাছে আমাদের জন্য সাহায্য কামনা করছি।
কুদ্দুস মোল্যার কান্দি গ্রামের রাহিমা বেগম জানান, সন্তানদের নিয়ে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ করে এলাকাবাসীর ডাক-চিৎকার শুনে বাইরে এসে দেখি নদীতে সবকিছু বিলীন হয়ে যাচ্ছে। স্বামী, সন্তান নিয়ে দ্রুত ঘরের মালামাল সরিয়ে নিতে নিতেই মুহূর্তের মাঝে সবকিছু শেষ হয়ে যায়। খুব অসহায় অবস্থায় জীবন-যাপন করছি জানিয়ে বলেন, নদীর ভাঙন রোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও সরকারের কাছে আমাদের পদ্মা পাড়ের মানুষের জন্য স্থায়ী সমাধান প্রার্থনা করেন। তার মতে তাহলে হয়ত আর কেউ তাদের মোট ভিটে-মাটি হারাবেন না।
নারিকেলবাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোঃ নাসির হোসেন বলেন, আমাদের ইউনিয়নটি পদ্মা নদী বেষ্টিত হওয়ায় প্রতি বছরই ভাঙনের শিকার হয়। ভাঙন রোধে টেকসই বাঁধ নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও সরকারের কাছে আবেদন করেছি। আমরা আশা করছি ভাঙন রোধে খুব শীঘ্রই সরকার কার্যকারী পদক্ষেপ নিবে। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে ইউনিয়নে প্রায় আড়াই শতাধিক মানুষ ভাঙন কবলিত রয়েছে। তাদের নামের তালিকা করে তাদেরকে সাহায্য সহযোগীতা করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আহসান মাহমুদ রাসেল বলেন, আমি ক্ষতিগ্রস্থদের নামের তালিকা করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছি। তথ্য সংগ্রহের কাজ চলমান রয়েছে। এবিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ভাঙন প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য কাজ করছে উপজেলা প্রশাসন।