অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবা উবার ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। রাজধানীর বাস সার্ভিস অত্যন্ত নিম্নমানের হওয়ায় খরচ একটু বেশি হলেও অনেকেই এই সেবার ওপর নির্ভরশীল। তবে এই জনপ্রিয়তার পাশাপাশি উবারের বিরুদ্ধে যাত্রী আর চালকদের অভিযোগও বাড়ছে। মাঝেমধ্যেই উবারের অস্বাভাবিক ভাড়ার হার, চালকরা যাত্রীদের পছন্দের গন্তব্যে যেতে না চাওয়া, নগদ অর্থে ভাড়া পরিশোধের শর্তে রাজি না হলে চালকদের কল কেটে দেওয়ার অভিযোগ গ্রাহকদের। গ্রাহকদের আরও একটি বড় অভিযোগ উবার রেন্টাল সার্ভিস নিয়ে। এই সার্ভিসে যাত্রী তার চাহিদা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের জন্য একটি গাড়ি ভাড়া নিতে পারেন। কিন্তু ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে এক ঘণ্টা অথবা ১০ কিলোমিটারের হিসাবে যাত্রীরা প্রতারণার অভিযোগ করেছেন। অন্যদিকে উবার চালকদের অভিযোগ, বিকাশে ভাড়ার ক্ষেত্রে যাত্রীদের ৩০ শতাংশ ছাড়ের টাকা চালকদের ভাড়ার টাকা থেকে কেটে রাখা হচ্ছে। কোন এলাকার যাত্রী পেতে ইচ্ছুক তা নির্ধারিত করে দিলেও উবার থেকে উল্টোদিকের এলাকার গন্তব্যে ট্রিপ দেওয়া হচ্ছে। ভাড়ার হার অস্বাভাবিক ওঠানামার কারণেও যাত্রীদের সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত বচসা হচ্ছে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে উবারের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, উবারের ভাড়া একটি সুনির্দিষ্ট গাণিতিক পদ্ধতিতে যাত্রীর যাত্রা শুরুর স্থান এবং গন্তব্যের দূরত্বের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে তাদের গতিশীল ভাড়া নির্ধারণের পদ্ধতি যাত্রী এবং চালক দু’পক্ষের জন্যই সহায়ক হয়।
যাত্রীদের অভিযোগ: যারা নিয়মিত উবার ব্যবহার করেন এমন দশজন যাত্রীর সঙ্গে আলাপ করলে তারা প্রত্যেকেই জানান, সাম্প্রতিক সময়ে উবার ব্যবহারের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, কল দেওয়ার পর অধিকাংশ উবার চালক ফোন করে যাত্রীর কাছে জানতে চান, তিনি কোথায় যাবেন। গন্তব্য পছন্দ না হলে উবার চালক কেটে দেন। অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে নিয়মিত উবার ব্যবহার করা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম বলেন, ট্রিপের কল হওয়ার পরপরই চালক ফোন করে কিংবা চালককে ফোন করলে চালক প্রথমেই জানতে চান ‘কোথায় যাবেন’? এরপর গন্তব্য পছন্দ না হলে ‘যাবেন না’ বলে ফোন কেটে দেন। কিছু কিছু চালক ‘ট্রিপ ফরওয়ার্ড’ করে দেন। কিন্তু অধিকাংশ চালক নিজেরা ট্রিপ বাতিল করেন না। ফলে যাত্রীদের ট্রিপ বাতিল করতে হয় এবং অনেক ক্ষেত্রেই ৩০ টাকা জরিমানা দিতে হয়। আরেকজন নিয়মিত যাত্রী সরকারি চাকুরে মিজানুর রহমান জানান, একটা সমস্যা হচ্ছে, অনেক চালক ট্রিপ পাওয়ার পর ফোন করে শর্ত দিয়ে দেন, ভাড়া নগদ অর্থে পরিশোধ না করা হলে তিনি যাবেন না। এ কারণে তার মতো অনেকেই ব্যাংকের কার্ডে কিংবা বিকাশে ভাড়া যারা পরিশোধ করতে চান তারা বিপাকে পড়ছেন।
যুবলীগের বিতর্কিতরা বাদ,ছাত্রলীগের কয়েক নেতার ঠাঁই
যাত্রীরা জানান, কভিড-১৯ মহামারির কারণে লকডাউনের পর পুনরায় উবার চালু হওয়ার পর ভাড়া অপেক্ষাকৃত বেড়েছে। প্রতি গন্তব্যেই আগের চেয়ে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেশি ভাড়া আসছে। তবে মাঝেমধ্যে ভাড়ার হার অত্যন্ত অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে।
উবার রেন্টাল আকর্ষণ হারাচ্ছে: ভাড়ার ক্ষেত্রে দ্বৈতনীতির কারণে আকর্ষণ হারাচ্ছে উবারের ‘উবার রেন্টাল’ সার্ভিস। এই সার্ভিসে যাত্রী তার চাহিদা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের জন্য একটি গাড়ি ভাড়া নিতে পারেন। এমনকি সারাদিনের জন্য কিংবা এক শহর থেকে আরেক শহরে যাওয়ার সুবিধাও পেতে পারেন এই সার্ভিসের মাধ্যমে। কিন্তু ‘উবার রেন্টালে’ ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে এক ঘণ্টা অথবা ১০ কিলোমিটারের হিসাবে ভাড়া নির্ধারণ করার কারণে উবার রেন্টালে অস্বাভাবিক ভাড়া উঠছে এবং আকর্ষণ হারাচ্ছে বলে যাত্রীদের সঙ্গে আলাপ থেকে জানা গেছে। এ ব্যাপারে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, এক ঘণ্টা অথবা ১০ কিলোমিটারে জন্য একটি গন্তব্যে নির্ধারিত সর্বনিম্ন ভাড়া ৪৪৯ টাকা। এ ক্ষেত্রে প্রতি ঘণ্টার পর মিনিটে ৪ টাকা এবং আর ১০ কিলোমিটারের পর প্রতি কিলোমিটারের জন্য ২২ টাকা হারে ভাড়া দিতে হবে যাত্রীদের। দেখা যাচ্ছে রাস্তা ফাঁকা থাকলে এক ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটারের অনেক বেশি দূরত্ব অতিক্রম করা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে উবার ঘণ্টার হিসাবে নয়, ১০ কিলোমিটারের হিসাবে প্রতি কিলোমিটার ২২ টাকা করে ভাড়া যোগ করছে। অন্যদিকে রাস্তায় যানজট থাকলে প্রতি কিলোমিটার নয়, ঘণ্টার হিসাবে প্রতি মিনিটের জন্য ৪ টাকা করে অতিরিক্ত ভাড়া যোগ করছে। ফলে উভয়ক্ষেত্রেই যাত্রীরা অতিরিক্ত ভাড়া দিচ্ছেন। বিশেষ করে যারা ঢাকার পাশে গাজীপুর কিংবা সাভারে যাওয়ার জন্য উবার রেন্টাল সার্ভিস নিচ্ছেন, তাদের অস্বাভাবিক ভাড়া দিতে হচ্ছে যা রেন্ট-এ কার সার্ভিসের প্রায় দ্বিগুণ। যেমন ঢাকা থেকে গাজীপুরে রেন্ট-এ কারের সিঙ্গেল ট্রিপের (শুধু যাওয়া) ভাড়া আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা। কিন্তু উবার রেন্টালে এই ভাড়া পাঁচ হাজার টাকার বেশি উঠে যাচ্ছে। শহীদুল ইসলাম নামে একজন যাত্রী জানান, তিনি একবার গাজীপুরে গিয়ে যাওয়া-আসার জন্য অস্বাভাবিক ভাড়ার কবলে পড়ে উবার রেন্টাল ব্যবহার ছেড়ে দিয়েছেন।
চালকদের অভিযোগ: আলাপকালে একাধিক চালক অভিযোগ করেন, উবার অ্যাপে চালকদের পছন্দমতো গন্তব্য নির্ধারণ করে রাখার ব্যবস্থা আছে। সে অনুযায়ী তারা ‘লোকেশন’ নির্দিষ্ট করে রাখেন। বিশেষ করে রাতের দিকে যে ট্রিপ শেষ হিসেবে নিতে চান সে ক্ষেত্রে অধিকাংশ চালকই ‘লোকেশন’ নির্দিষ্ট করে দেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই উবার নির্দিষ্ট করা লোকেশেনের উল্টো দিকের ট্রিপও দিয়ে দিচ্ছে। ফলে চালকরা যাত্রীদের না যাওয়ার কথা বলছেন। তবে চালকদের অধিকাংশই মনে করেন, যদি কোনো চালক না যেতে চান তাহলে তার নিজেরই ‘ট্রিপ ফরওয়ার্ড’ কিংবা বাতিল করে দেওয়া উচিত।
চালকরা আরও অভিযোগ করেন, বিকাশে ভাড়ার ক্ষেত্রে যাত্রীদের ৩০ শতাংশ ডিসকাউন্টের টাকা চালকদের ভাড়ার টাকা থেকে কেটে রাখা হচ্ছে। উবার নির্ধারিত ২৫ শতাংশের সঙ্গে ডিসকাউন্টের সঙ্গে ভাড়া থেকে আরও ১০ শতাংশ কাটা হচ্ছে। এ কারণে চালকরা মূলত বিকাশে ভাড়া পরিশোধের ক্ষেত্রে আপত্তি জানাচ্ছেন। ভাড়ার হার খুব বেশি ওঠানামার কারণেও যাত্রীরা বিভ্রান্ত হয়ে চালকদের সঙ্গে ঝগড়া করছেন।
উবারের বক্তব্য: এসব বিষয়ে জানার জন্য সমকালের পক্ষ থেকে ই-মেইলে উবারের বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। জবাবে উবারের একজন মুখপাত্র ই-মেইল বার্তা দিয়ে জানান, উবারে ভাড়া একটি অ্যালগরিদম ব্যবহার করে গণনা করা হয় যা যাত্রার শুরু থেকে গন্তব্য, গন্তব্যের রুটে যানজট, গাড়ির সরবরাহ এবং চাহিদা অনুযায়ী নির্ধারিত হয়ে থাকে। এই গতিশীল ভাড়া নির্ধারণের পদ্ধতি যাত্রী এবং চালক দু’পক্ষের জন্যই সহায়ক হয়।
উবার মুখপাত্র জানান, যাত্রীরা এবং চালক উভয়ের কাছেই উবার ভদ্র এবং পেশাদার আচরণ প্রত্যাশা করে। তবে অপ্রত্যাশিত কারণে যাত্রী বা চালক কোনো পক্ষ ট্রিপ বাতিল করতে বাধ্য হতে পারেন। এ ক্ষেত্রে উবার ট্রিপ বাতিল সীমিত রাখার নীতিকেই উৎসাহিত করে। তাছাড়া উবার অ্যাপে ‘ফিডব্যাক’ ব্যবহার করে যাত্রী এবং চালক উভয়ই যে কোনো ধরনের অভিযোগ জানাতে পারেন। অভিযোগ এবং পরামর্শ উবারের সামগ্রিক গ্রাহকের অভিজ্ঞতা উন্নত করতে সহায়তা করে।
তবে উবারের এই মুখপাত্র উবার রেন্টাল এবং বিকাশে ভাড়া পরিশোধ-সংক্রান্ত যাত্রী অভিযোগের বিষয়ে কোনো জবাব দেননি।